কোটাবৈষম্য, শিক্ষক আন্দোলন, প্রশ্নপত্র ফাঁস: কোথায় এসে দাঁড়াল উচ্চশিক্ষা
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু বলেছিলেন, ‘দ্য কান্ট্রি ইজ গুড ইফ দ্য ইউনিভার্সিটিজ অব দ্য কান্ট্রি আর গুড।’ বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা প্রত্যক্ষ করলে দেশের ভালো-মন্দ অবস্থা সহজেই বিবেচনা করা যাবে। কোটাবৈষম্য, শিক্ষক আন্দোলন আর নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের কেলেঙ্কারি বর্তমানের শিক্ষাব্যবস্থাকে অচল করে দিচ্ছে। সম্প্রতি ‘প্রত্যয়’ স্কিম বাতিলের দাবিতে শিক্ষকদের কর্মবিরতি, কোটা পুনর্বহালের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং অন্যদিকে পিএসসির নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা উচ্চশিক্ষায় এক বিরাট স্থবিরতা সৃষ্টি করছে। যা শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার মনমানসিকতায় ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।
সরকার কর্তৃক নির্দেশিত সর্বজনীন পেনশনের ‘প্রত্যয়’ কর্মসূচির প্রজ্ঞাপন বাতিলের দাবিসহ আরও তিনটি দাবি নিয়ে ১ জুলাই থেকে বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী একযোগে কর্মবিরতি পালন করছেন। কর্মবিরতির কারণে ক্লাস, পরীক্ষাসহ সব একাডেমিক কাজ স্থগিত; শ্রেণিকক্ষ, অফিস, লাইব্রেরিসহ প্রশাসনিক ভবনে তালা ঝোলানো প্রভৃতি শিক্ষার্থীদের চরম দুর্ভোগ সৃষ্টি করছে। প্রশাসনিক অফিস থেকে সনদসংক্রান্ত কাজসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সেবা নিতে এসেও ফিরে যেতে হচ্ছে শিক্ষার্থী ও তাঁদের অভিভাবকদের। ৯ জুলাই প্রথম আলোর এক প্রতিবেদনে উঠে এল, ‘জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী জাপানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তি পেয়েছেন। তাঁকে ১৬ জুলাইয়ের মধ্যে মূল সনদের কপি পাঠানোর জন্য বলা হয়েছে। যেটি জাপানে পাঠাতে অন্তত পাঁচ দিন সময় প্রয়োজন। কিন্তু পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকের কার্যালয়ে এসে সবকিছু বন্ধ পেয়ে ফিরে গেছেন।’ আবার ১ জুলাই থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২৩-২৪ সেশনের অনার্স প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ক্লাস শুরু হওয়ার কথা ছিল, যা কর্মবিরতির জন্য স্থগিত করা হয়েছে। এদিকে গুচ্ছভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক প্রথম বর্ষের ভর্তি কার্যক্রম স্থগিতসহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের ফাইনাল পরীক্ষা পর্যন্ত স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে দেশের প্রায় সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষ থেকেই শুরু হতে যাচ্ছে সেশনজট।
শিক্ষকদের দাবি যখন আন্দোলনে রূপ নেয়, তখনই শিক্ষার্থীমহলে শুরু হলো আরেক প্রতিবাদের ঝড়।
গত ৫ জুন হাইকোর্ট যখন সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের পরিপত্রকে অবৈধ বলেন এবং ৫৬ শতাংশ কোটা নীতি বহালের ঘোষণা দেন, তখন থেকেই সাধারণ শিক্ষার্থী ও চাকরিপ্রত্যাশীদের অন্তরে প্রতিবাদের ক্ষোভ জ্বলে ওঠে। ১ জুলাই থেকে শিক্ষকদের দাবি আদায়ের আন্দোলন শিক্ষার্থীদের তাঁদের অধিকার আদায়ের জন্যে বিদ্রোহী করে তোলে। ৫৬ শতাংশ কোটা বহাল মানে সরকারি চাকরিতে মেধার চেয়ে কোটাকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া, যা একজন সাধারণ শিক্ষার্থীর মেধাকে অবমাননা করা হয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করে শিক্ষার্থীরা কোটাপ্রথা বাতিলের যৌক্তিক দাবি নিয়ে রাজপথে নামেন। অথচ শিক্ষক আন্দোলন বা শিক্ষার্থী আন্দোলন—কোনোটারই এখন পর্যন্ত কোনো সমাধান দিতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। উচ্চশিক্ষায় এখন অচলাবস্থা সৃষ্টি হচ্ছে।
শিক্ষক আন্দোলন আর শিক্ষার্থীদের বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন শেষ হতে না হতেই টেলিভিশনের পর্দায় ভেসে আসে বিসিএসসহ বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর। সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটায় নিয়োগের পর মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ মাত্র ৪৪ শতাংশ থাকে। ৪৪ শতাংশ মেধায় নিয়োগের ব্যবস্থায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের সুব্যবস্থা দেখে শিক্ষার্থীরা স্তম্ভিত। তাঁরা এখন বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলছেন। দেশের হাজারো শিক্ষার্থী ও তাঁদের পরিবার–পরিজনের আস্থার জায়গা পিএসসি। সেই পিএসসি যখন বছরের পর বছর প্রশ্নপত্র ফাঁসের মধ্য দিয়ে আমলা নিয়োগ করে যাচ্ছে, তখন এ দেশের শিক্ষার্থীদের ভরসার জায়গা আর কোথায় থাকে? শিক্ষার ওপরই–বা কী ভরসা রাখতে পারেন এ দেশের শিক্ষার্থীরা?
শিক্ষাই যদি জাতির মেরুদণ্ড হয়ে থাকে, তাহলে বর্তমানে আমাদের দেশের মেরুদণ্ড কোথায় গিয়ে ঠেকল, তা ভাবা যায়! সৎ, যোগ্য, মেধাবী ব্যক্তির পরিবর্তে দেশ পরিচালনায় স্থান পাচ্ছেন অযোগ্য আর দুর্নীতিবাজ লোকেরা। এভাবে চলতে থাকলে দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যেমন ধ্বংস সৃষ্টি হবে, তেমনি নষ্ট হবে দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অবস্থাও। সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষার্থীদের উচ্চশিক্ষার প্রতি বাড়বে অনীহা। ফলে প্রজন্মান্তরে মেধা থাকা সত্ত্বেও কৃষকের সন্তান কৃষক, দিনমজুরের সন্তান দিনমজুর থাকবে আর অযোগ্য দুর্নীতিবাজদের সন্তান থাকবে দেশ পরিচালনার শীর্ষে। যোগ্য ব্যক্তির অভাবে বাংলাদেশ বিশ্বের বুকেও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে না। ফলে শতাব্দীর পর শতাব্দী বাংলাদেশ থেকে যাবে যোগ্যতাহীন, মেধাহীন অনগ্রসর জাতি হিসেবে। কাজেই কর্তৃপক্ষের উচিত দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ নিয়ে উচ্চশিক্ষায় মানসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করা।
লেখক: মাইফুল জামান ঝুমু, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়