সুফিয়া

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

মকবুলের কফিন গ্রহণের জন্য হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছে তার স্ত্রী সুফিয়া। সঙ্গে আছে ১৫ বছরের মেয়ে মরিয়ম। সদ্য বয়ঃসন্ধিতে পা দেওয়া মেয়েটা বাবার লাশ নিতে এসেছে!

বিমানবন্দরের এদিকটায় অনেক মানুষ অপেক্ষা করছে। সৌদি আরব থেকে সৌদি এয়ারলাইনসের ফ্লাইট ল্যান্ড করেছে কয়েক ঘণ্টা আগে। ইমিগ্রেশন শেষ করে দুয়েকজন করে বের হচ্ছে। বহুদিন পরে প্রিয়জনকে কাছে পেয়ে অনেকের চোখ আনন্দ–অশ্রুতে সিক্ত। কিন্তু সুফিয়া এবং তার মেয়ে অশ্রুহীন চোখে অপলক তাকিয়ে আছে, কখন পুলিশ এসে কফিন হস্তান্তর করবে!

সুফিয়ার বয়স ত্রিশ কি বত্রিশ বছর হবে। দুই মেয়ে এবং এক ছেলের মা। পড়াশোনা তেমন করতে পারেনি। কন্যাদায়গ্রস্ত পিতার সে সামর্থ্যও ছিল না। কোনো রকমে এইচএসসি পাশ করার পরে পাশের গ্রামের মকবুলের সঙ্গে বিয়ে হয়। মকবুল পোলট্রি ফার্মের ব্যবসা করতো, বেশ ভালো আয় রোজকার ছিল। বিয়ের তিন বছর স্বপ্নের মতো কেটেছে সুফিয়ার। এর মধ্যে দুই মেয়ের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু অভাগীর সুখ বেশি দিন থাকে না। নিয়তির নির্মম আঘাতে সব সুখ অন্ধকারের চোরাবালিতে হারিয়ে যায়! হঠাৎ ফার্মে মড়ক শুরু হয়; এক সপ্তাহের মধ্যে একটা মুরগিও অবশিষ্ট থাকে না।

মকবুল কর্মঠ মানুষ। সে এতো সহজে হাল ছেড়ে দেয় না। কিছুদিন পরে সঞ্চয় আর কিছু ধারদেনা করে নতুনভাবে শুরু করে। কিন্তু মাস যেতে না যেতেই আবার মড়ক লাগে এবং দুই দিনের মধ্যে সব বাচ্চা শেষ হয়ে যায়! মকবুল এবার বুঝতে পারে, ব্যবসা পরিবর্তন করতে হবে। কিন্তু মূলধন ছাড়া তো ব্যবসা হবে না। এ অসময়ে মকবুলকে সংসার থেকে আলাদা করে দেয় তার বাবা। পাওনাদারের চাপ, নতুন সংসারের খরচ সবকিছু মিলে দিশাহারা হয়ে যায় সুফিয়া-মকবুল দম্পতি।

গ্রামের অনেক মানুষ বিভিন্ন দালাল ধরে বিদেশে যাচ্ছে। বিদেশে গেলে ভালো আয় হবে, ধারদেনা পরিশোধ করে বউ–বাচ্চা নিয়ে একটু সচ্ছলতার সঙ্গে চলতে পারবে, এই চিন্তা থেকে মকবুল বিদেশে যাওয়ার জন্য সুফিয়ার কাছে অনুমতি চায়। কীভাবে কী করতে হবে সেটা নিয়ে গ্রামের ঠান্ডু দালালের সঙ্গে আলোচনা করে। প্রথম প্রথম সুফিয়া সায় দেয় না। পরে অবশ্য সবকিছু বিবেচনা করে বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেয়।

এমনিতেই ঋণে জর্জরিত মকবুলের সহায়সম্পদ বলতে বিলের ধারের এক টুকরা ধানি জমি ছাড়া কিছু নেই। শেষ সম্বল এই জমি বিক্রি করে ঠান্ডু দালালের হাতে সব টাকা তুলে দেয় সে। কিছুদিন পরে সৌদি চলে যায় মকবুল। যাওয়ার সময় অন্তঃসত্ত্বা সুফিয়া অনেক কেঁদেছিল। সে হয়তো বুঝতে পেরেছিল, এটাই তাদের শেষ দেখা!

প্রথম আলো ফাইল ছবি

মকবুল চলে যাওয়ার পর সবকিছুর দায় পড়ে সুফিয়ার ওপর। একে তো সে অন্তঃসত্ত্বা, তারপর থাকা, খাওয়ার সমস্যা; শরীর ঠিকমতো চলে না অন্যদিকে পাওনাদারের টাকার চাপ! বিশেষ করে দেবর মজিদ টাকার জন্য সকাল–বিকাল কথা শোনায়। দাঁতে দাঁত চেপে সব সহ্য করে সুফিয়া। মাস তিনেক পরে সে ফটফুটে এক ছেলে সন্তানের জন্ম দেয়।

মকবুল বিদেশে গিয়ে প্রথম প্রথম কিছুটা সমস্যায় পড়লেও সবকিছু তাড়াতাড়ি সামলে নেয়। ধারদেনা পরিশোধের জন্য দ্রুত বাড়িতে টাকা পাঠায়। ঋণ থেকে মুক্তি পেয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচে সুফিয়া। তারপর তিনটা বাচ্চা নিয়ে আস্তে আস্তে সংসার সাজায় সে। মাটির ঘর পরিবর্তন করে ইটের ঘর তৈরি করে। টেলিভিশন কেনে, ফ্রিজ কেনে; মেয়েদের স্কুলে পাঠায়! পরের বছর জমি কেনে। বাবা-মা, শ্বশুর-শ্বাশুড়িকে নিয়ম করে টাকা দেয়। এখন কোনো কিছুর অভাব নেই তার। সবকিছু থাকলেও প্রিয়জনের অভাব জীবনের পরতে পরতে অনুভব করে সুফিয়া। মকবুলের অপেক্ষায় কাটিয়ে দেয় জীবনের স্বর্ণালি এক যুগ!

এক যুগ পরে মকবুল বাড়ি আসতে মনস্থির করে। মেয়ে মরিয়ম অনেক বড়ো হয়েছে, আগামী মাসে এসএসসি পরীক্ষা দেবে। মকবুল তিন মাসের ছুটি নেয়। এ কথা শুনে আনন্দে চোখ ছলছল করে মরিয়মের! আর কয়েক দিন পরেই এক অসীম অপেক্ষার অবসান হবে। সুফিয়ার আনন্দটা একটু অন্যরকম! সাজুগুজু করে, গুনগুনিয়ে গান গায়! মায়ের এই পরিবর্তন মরিয়ম খেয়াল করে কিন্তু কিছু বলে না, শুধু মিটমিট করে হাসে।

সেদিন বিকেলে হঠাৎ সুফিয়ার ফোনে অপরিচিত নম্বর থেকে রিং আসে। প্রথম কয়েকবার রিসিভ করে না। একা থাকে তাই অনেকেই ভিন্ন ধান্দা নিয়ে সময়ে–অসময়ে জ্বালাতন করে। বিরতিহীনভাবে রিং আসতেই থাকে। অবশেষে অনেক বিরক্তি নিয়ে ফোন ধরে। অপরিচিত সেই ব্যক্তি প্রথমে পরিচয় জিজ্ঞেস করে, তারপর এই নিষ্ঠুর সংবাদ দেয়, মকবুল ইহলোকে নেই!

সুফিয়ার বাড়িতে শোকের মাতো শুরু হয়! মুহূর্তের মধ্যেই এ খবর গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। কীভাবে মকবুল মারা গেল সে কথা জানতে ছুটে আসে পাড়াপ্রতিবেশী। চারদিক থেকে আত্মীয়স্বজন বাড়িতে আসতে থাকে। সবাই অশ্রুসিক্ত, কেহ সুফিয়াকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা খুঁজে পায় না! কেউ জানে না কীভাবে কী হলো।

সেই রাতে সুফিয়ার ফোনে আবার কল আসে। মকবুলের ছোট ভাই মজিদ ফোন ধরে জানতে পারে, মকবুল রাতে ঘুমের মধ্যে মারা যায়। কিন্তু এই ফোন আর মজিদ হাতছাড়া করে না। একটু পরপর ফোন আসে আর সে ফিসফাস করে কথা বলে। মজিদ তার বাবা এবং অন্য দুই ভাইকে নিয়ে সলাপরামর্শ করে। এখন তাদের চোখেমুখে শোকের ছিটেফোঁটাও নেই।

সকাল হতেই সব পরিষ্কার হয়ে যায়। প্রকাশ পায় আসল ঘটনা। মকবুল যে মালিকের কাজ করতো সে ক্ষতিপূরণ হিসেবে কিছু টাকা দেবে মকবুলের পরিবারকে। সৌদি শেখের সামান্য অর্থকড়ি বাংলাদেশের অনেক টাকা। সেই টাকার কথা শুনে মকবুলের ভাইয়েরা ছলচাতুরী শুরু করে, ভাগবাটোয়ারা কীভাবে করা যায়, সেই চেষ্টা চালাতে থাকে। দাবি জানায়, টাকা যেনো মকবুলের বাবার কাছে আসে। দেনদরবার শুরু হয়, ব্যাপারটা ফয়সালা করতে চেয়ারম্যানসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত হয়! সবাই টাকা মকবুলের বাবার কাছে দেয়ার অনুরোধ করে। কিন্তু সৌদি শেখ কোনোভাবেই টাকা মকবুলের বাবার কাছে দেবে না। দোভাষীর মাধ্যমে তাঁর সাফ কথা, মকবুলের স্ত্রী যার নাম বলবে, টাকা তার কাছে যাবে। অন্য কারোর কথা সে শুনবে না। শেখ বুঝতে পেরেছে টাকার ওপর শকুনের লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে। টাকার কাছে মৃত্যু হেরে গেছে! সুফিয়া এসবের কিছুই জানে না। একটু পরপরই সে মূর্ছা যাচ্ছে!

একে একে তিন দিন পার হয়ে যায়। সুফিয়া ছাড়া কেউ মকবুলের লাশের কথা বলে না। পরিবারের কাছে মকবুলের মৃত্যুর চেয়ে তার টাকার বণ্টন বড় ইস্যু হয়ে গেছে। দেবর ভাসুর নানানভাবে তাকে হুমকি দিচ্ছে! আসলে কেউ মকবুলকে চায় না, সবাই তার টাকা চায়।

চার দিন পরে দোভাষীর মাধ্যমে সৌদি শেখ কথা বলে সুফিয়ার সঙ্গে। শেখ অনেক দুঃখ প্রকাশ করে। আসমান জমিন কসম কেটে বলে, মকবুলের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। যেহেতু মকবুল ১০ বছর ধরে আমার কাজ করছে, সে জন্য আমি সামান্য কিছু ক্ষতিপূরণ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এবং ক্ষতিপূরণের টাকাটা আপনার কাছেই দিতে চাই। সুফিয়া কথা বলতে পারে না, ডুকরে কেঁদে দেয়। এর তিন দিন পরে সুফিয়ার অ্যাকাউন্টে টাকা চলে আসে। শেখ লাশ পাঠানোর সব ব্যবস্থা করে দেয়।

টাকা সুফিয়ার কাছে এসেছে শুনে ক্রোধে অগ্নিশর্মা হয়ে যায় তার শ্বশুর, দেবর, ননদ সবাই। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে; গায়ে হাত তোলে। এই টাকার ভাগ নাকি সবাই পাবে। সুফিয়া ফ্যালফ্যাল করে ওদের মুখের দিকে তাকিয়ে ভাবে, বিপদের সময় কেউ মকবুলকে এতটুকু সহায়তা করেনি, এমনকি বিদেশে যাওয়ার পরে ধারের টাকা নিয়ে নানাভাবে অপমান অপদস্ত করেছে। তারপরও মকবুল বিদেশে থেকে সবাইকে সাহায্য করেছে। এখন মানুষটা মারা যাওয়ার পর তার এতিম বাচ্চাদের হক আত্মসাৎ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। ওদের প্রতি ঘেন্না হয় সুফিয়ার।

আজকে মকবুলের কফিন আসবে। টাকার ভাগ পায়নি বলে ভাইয়েরা সে কফিনের জন্য বিমানবন্দরে যাবে না। এমনকি জন্মদাতা পিতাও লাশ গ্রহণ করতে অস্বীকার করে। সুফিয়া বুঝে গেছে, জীবনের বাকি সময়টা এসব হায়েনাদের সঙ্গে লড়াই করেই তাকে চলতে হবে। তাই ভোরে মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে বিমানবন্দরে এসেছে। অপেক্ষা করছে মকবুলের কফিন গ্রহণ করার জন্য। বিমানবন্দরে এসে পুলিশকে অনুরোধ করেছে একটা অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করে দেবার।

খানিক পরে পুলিশ সুফিয়াকে ডেকে নিয়ে অফিশিয়াল ফর্মালিটিস সম্পূর্ণ করে। তারপর মকবুলের কফিন অ্যাম্বুলেন্সে উঠানো হয়। একই অ্যাম্বুলেন্সে উঠে সুফিয়া এবং মরিয়ম। মা–মেয়ে অপলক দৃষ্টিতে কফিনের দিকে তাকিয়ে থাকে! সাইরেন দিতে দিতে চলতে থাকে অ্যাম্বুলেন্স। কফিনে থাকা মকবুলের গন্তব্য থাকলেও অল্পবয়সী বিধবা সুফিয়া জানে না তার গন্তব্য কোথায়! গন্তব্যহীন সুদীর্ঘ এ যাত্রায় সে সম্পূর্ণ অসহায় একা ও নিঃসঙ্গ!

*লেখক: রূপক, মিরপুর, ঢাকা

নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]