পুরোনো দিন, নতুন বই—এক অনন্ত ডিসেম্বর
কুয়াশা মিশিয়ে দুধসাদা লাউ ফুলের শরীরে শিশির রেখে ডিসেম্বরে শীত নামে গ্রামের পথঘাটে। এই মাসটি এলে আমার ভেতরটায় সবসময়ই এক অদ্ভুত নরম আলো জ্বলে ওঠে—সময়ের দূরাশার ভেতর থেকে ভেসে আসে স্কুলজীবনের গন্ধ, সেই অচেনা কিন্তু আপন শৈশবের কোলাহল। প্রাইমারি আর পরে হাই স্কুল—দুটো সময়ই ডিসেম্বর ছিল আমাদের জন্য এক ধরনের উৎসব। বার্ষিক পরীক্ষা মানে যেমন উত্তেজনা, তেমনি ভারী দুশ্চিন্তাও। পরীক্ষার শেষ দিনটায় আমরা স্কুলের বারান্দা দিয়ে ছুটতাম, আর আকাশটা সেদিন যেন আরও নীল হয়ে উঠত। ৩১ ডিসেম্বরের সকাল হয়ে উঠত সম্পূর্ণ অন্য রকম। ফল প্রকাশের উৎকণ্ঠা আর নতুন শ্রেণিতে ভর্তির কাগজপত্র মিলিয়ে সেদিনের বাতাসে একধরনের তাঁজা গন্ধ ভাসত। ফলাফলের কাগজ হাতে পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের আরেকটি অপেক্ষা শুরু হতো—নতুন বইয়ের জন্য। আমাদের হাতে তুলে দেওয়া হতো নতুন বই। সেই বই হাতে আসত—মলাটে মোড়া, একেবারে নতুন—তখন মনে হতো পৃথিবীটা যেন আমাদের জন্য নতুন করে লেখা হচ্ছে। প্রাইমারি স্কুল জীবনে আমার বন্ধুদের মধ্যে আজগর, শহিদ, কাউছার, আরিফ কিংবা হাইস্কুলে হেলাল, নয়ন, সোহেল, মোশাররফ, সুবর্ণা, তাসলিমা, তানজিনা, শারমিনসহ আরও অনেকের কথা মনে পড়ে। এদের কেউ দেশে ভালো চাকরি করছে, কেউ সংসারী হয়ে ভালো গৃহিণী কিংবা কেউ বিদেশে। কিন্তু আমাদের অনেক দিন দেখা হয় না।
নতুন বইয়ের গন্ধ ছিল এক অদ্ভুত আবেশ। অনেকটা মায়ের আঁচলে থাকা ধোঁয়া-রোদমাখা পরিচিত সুবাসের মতো। আমি বইয়ের পাতাগুলো একে একে উল্টে দেখতাম—চিত্রগুলো, অক্ষরগুলো, সাদা পাতার সারি। যেন কোনো অচেনা দরজা খুলে গেল এবং আমি ঢুকে গেলাম নতুন এক বছর, নতুন এক সম্ভাবনার ভুবনে। বই নষ্ট না হওয়ার জন্য যত্ন করে মলাট দিতাম। কেউ রঙিন কাগজ ব্যবহার করত, কেউ ফুল আঁকত, কেউ নাম লিখত খুব পরিচ্ছন্ন করে। সেই সামান্য সাজসজ্জায় আমরা যেন নিজেরাই একটু একটু করে বড় হয়ে উঠতাম। এসব এখন অনেক দূরের স্মৃতি। বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবন শেষ করে কর্মস্থলের সময়-ঘড়িতে আটকে থাকা আমি মাঝেমধ্যে তাকিয়ে দেখি—এই ডিসেম্বরও আগের মতোই আসে, ঠান্ডা বাতাসও একই রকম থাকে, কিন্তু নতুন বইয়ের টেবিলটিকে আর দেখি না। দেখি না সেই কোলাহল, দেখি না নতুন মলাটের ঝকঝকে আকুলতা।
তারপরও, এই মাসের ভেতর ঢুকে গেলে মনে হয়, কোথাও যেন কেউ আমাকে আবার ডাকছে—একটা ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে, দুপুরের রোদে লাল-ইটের দেয়াল পেরিয়ে উঠোনে দাঁড়াতে। বার্ষিক পরীক্ষার ঘাম, উত্তীর্ণ হওয়ার উল্লাস, নতুন বইয়ের ঘ্রাণ—সব মিলিয়ে ডিসেম্বর আমার কাছে এখনো এক অমলিন উপন্যাসের প্রথম অধ্যায়। প্রতিবারই এই মাসে মনে হয়, জীবন যত দূরেই যাক, শৈশবের পাতাগুলো নষ্ট হয় না কখনো। শুধু নতুন বছরের মতো আমরাও এগিয়ে যাই, কিন্তু বুকের গভীরে গুছিয়ে রাখা সেই নতুন বইয়ের গন্ধ আমাদের চিরকালই আবার ছোট করে দেয়।
লেখক: পাবলিক রিলেশন্স অফিসার, আশা ইউনিভার্সিটি।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]