উপদেষ্টাদের স্বচ্ছতা এবং নৈতিক দায় ও দায়িত্বের প্রশ্ন

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের সঙ্গে নিয়ে পুষ্পস্তবক অর্পণ করে মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। গতকাল সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধেছবি: পিআইডি

স্বৈরাচারের পতন হয়েছে। বিপ্লবীদের বাসনা অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়েছে। এই বিপ্লবাত্মক ঘটনাকে প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শপথ গ্রহণকারী নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস দ্বিতীয় স্বাধীনতা হিসেবে বর্ণনা করেছেন। এই স্বাধীনতার স্থায়িত্বের জন্য সরকারের উপদেষ্টারা শপথ নিয়েই রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অর্থাৎ উপদেষ্টারা বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা সংস্কারকের ভূমিকা পালন করবেন। এ জন্য সংস্কারকদের মধ্য থেকেই সংস্কারের শুরু হওয়াটা নৈতিকভাবে প্রয়োজন।

৩৫ দিনব্যাপী রক্তাক্ত জুলাই বিপ্লবের বিশেষ পরিপ্রেক্ষিতে দেশের দায়িত্ব ও সংস্কারের জন্য দায়িত্ব নেওয়া সব উপদেষ্টা ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য। বর্তমান উপদেষ্টাদের অনেককেই আমরা চিনলেও সবাইকে আমরা চিনি না। ঠিক কে, কোন উপদেষ্টার নাম প্রস্তাব করেছেন এবং কেন করেছেন, তার বিস্তারিত তথ্যও আমাদের জানা নেই। কেউই আমাদের আনুষ্ঠানিক ভোটে নির্বাচিত নন। আমরা এটাও জানি, এ অবস্থায় নির্বাচিত হওয়ার কোনো সুযোগ ছিল না। উল্লেখ্য, বিগত সময়ে আমরা দেখেছি, ব্যক্তিবিশেষকে দেবতাতুল্য ভাবা এবং সেইভাবে ভক্তি করা গণতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য মঙ্গলজনক নয়।

প্রাসঙ্গিকভাবেই জানানো প্রয়োজন, উপদেষ্টারা এ মুহূর্তে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের স্থলে দায়িত্ব পালন করছেন। যে ক্ষমতাযন্ত্র ব্যবহার করে এর আগে দুর্নীতিগ্রস্ত জনপ্রতিনিধিরা সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন, বর্তমান উপদেষ্টাদের হাতে সেই একই যন্ত্রের চাবি। আপনাদের অধীনে সেই একই দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন। এ ক্ষমতাযন্ত্র ব্যবহার করে কোনো উপদেষ্টা তাঁর সম্পদ বৃদ্ধি বা ব্যক্তিস্বার্থের উদ্ধারে কাজ করবেন না, এটাই প্রত্যাশা। কিন্তু প্রত্যাশার বিপরীতে বাস্তবিক জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা সম্পূর্ণ ভিন্ন বিষয়।

ফলে উপদেষ্টাদের নৈতিক দায়িত্ব হলো তাঁদের যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, স্বার্থ ও সম্পদ নিজে উদ্যোগে প্রকাশের মাধ্যমে জনগণের কাছে নিজেদের স্বচ্ছভাবে উপস্থাপন করা।

২০০৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সম্পদ বিবরণী প্রকাশ করতে আদেশ দিয়েছিলেন। ২০২৩ সালের সংশোধিত গণপ্রতিনিধিত্ব আইন অনুযায়ী সম্পদের বিবরণীতে মিথ্যা তথ্য দিলে প্রার্থিতা বাতিলের বিধান রয়েছে। যদিও জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচনের সময় হলফনামায় সম্পদের তথ্য দিলে তা সরকারের কোনো প্রতিষ্ঠান কখন ক্ষতিয়ে দেখবে সেটা স্পষ্ট নয়। এসব বিষয় নিশ্চয়ই তারা সংস্কার করবেন। পত্রিকার মাধ্যমে আমরা সংসদ সদস্যদের অন্তত ২০০, ৪০০ বা ১০০০ গুণ সম্পদ বাড়ার তথ্য ও বিশ্লেষণ জানতে পারছি। সম্পদ ও ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশের বাধ্যবাধকতা বিষয়ে উপদেষ্টাদের জন্য প্রযোজ্য কোনো আইন নেই। ১৯৯১ সাল থেকে এখনো পর্যন্ত কোনো তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী সরকারের কোনো উপদেষ্টা তাঁর সম্পদের বিবরণী প্রকাশ করেছেন, এমন কোনো তথ্য আমার জানা নাই। আইনের বাধ্যবাধকতা না থাকলেও সংস্কার প্রতিশ্রুতি প্রদানকারীদের নৈতিক ভিত্তি তৈরির জন্য স্বচ্ছতার প্রয়োজন রয়েছে।

বর্তমানে যেকোনো গুজব অথবা অপপ্রচারের কাল ও সীমানা দুটোই ব্যাপক বিস্তৃত। উপদেষ্টাদের বিষয়ে মিথ্যা অভিযোগ ও গুজব হতে পারে প্রতিবিপ্লবীদের অন্যতম হাতিয়ার। অর্থাৎ সরকারের দায়িত্বপ্রাপ্তদের বিষয়ে গুজব ও অপপ্রচার বৃদ্ধি পাওয়ার খুব সম্ভাবনা রয়েছে। এ জন্য যাচাইযোগ্য তথ্য উন্মুক্ত থাকলে নাগরিক সাংবাদিক এবং সংবাদমাধ্যম উভয় গুজব খারিজে শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারবেন।

উপদেষ্টাদের বর্তমান যোগ্যতা, সম্পদ ও স্বার্থ জনগণকে জানানোর জন্য নিচের ৭টি প্রশ্ন বা মতামত উপস্থাপন করলাম—
১.
আমরা আশা করি উপদেষ্টারা তাঁদের এবং তাঁদের ঘনিষ্ঠজনদের আয়কর ও সম্পদ বিবরণী জনগণের নিকট প্রকাশ করবেন। ঘনিষ্ঠজন বলতে বোঝাচ্ছি আপনার স্বামী/স্ত্রী, পিতা ও মাতা, সন্তান এবং ভাই-বোন।
২.
আমরা জানতে চাই আপনি আইন মান্যকারী সুনাগরিক ছিলেন কি না। আপনি কি নিয়মিত ট্যাক্স দিয়েছেন? আপনি কি কখনো আদালতে অভিযুক্ত হয়েছেন? হলে সেগুলোর তালিকা এবং বর্তমান অবস্থা কী? আপনি কি কখনো আইন ভঙ্গের জন্য কোনো জরিমানা দিয়েছেন?
৩.
শেয়ারবাজারে আপনার এবং আপনার ঘনিষ্ঠজনদের বিনিয়োগ থাকলে তার পোর্টফোলিও জানতে চাই।
৪.
বর্তমান সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে কে কে আপনার আত্মীয়? আত্মীয় বলতে আমরা পিতৃকুল ও মাতৃকুলের সঙ্গে রক্ত ও বিবাহ–সম্পর্কিত ব্যক্তিদের ধরতে পারি।
৫.
আমরা জানতে চাই আপনি বর্তমানে কোন প্রতিষ্ঠানে দায়িত্বে আছেন এবং পূর্বে ছিলেন। আপনি উপদেষ্টা থাকাকালে আপনার প্রতিষ্ঠানসমূহের দায়িত্বে কে থাকবেন? আপনার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সরকারের কোনো প্রকার সংশ্লেষ আছে কি?
৬.
আপনার শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং কর্ম অভিজ্ঞতা কী?
৭.
আপনার রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা কী কী ছিল এবং আছে?

এসব তথ্যের জন্য আপনাদের প্রস্তুতি না থাকলে এবং সাহায্যের প্রয়োজন হলে আপনারা বর্তমানে আপনাদের অধীন সরকারি কর্মচারীদের সাহায্যের জন্য ব্যবহার করতে পারেন। এসব তথ্য bangladesh.gov.bd অথবা cabinet.gov.bd ওয়েবসাইটে আলাদা সেকশন করে প্রকাশ করা যেতে পারে, যাতে উপদেষ্টাদের সম্পদ, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা ও স্বার্থের তথ্য গণমাধ্যম, নাগরিক সাংবাদিক ও রাষ্ট্রীয় সংস্থা বর্তমান ও পরবর্তী সময়ে বিশ্লেষণ ও ক্ষতিয়ে দেখতে পারেন।

এসব তথ্য প্রকাশে যদিও বর্তমান উপদেষ্টারা আইনগতভাবে বাধ্য নন, কিন্তু বর্তমান বিপ্লবের চেতনার স্বার্থে নৈতিকভাবে প্রয়োজন। পাশাপাশি, স্ব-উদ্যোগে এসব তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে বিপ্লবী সরকারের স্বচ্ছতার আগ্রহ ক্ষমতাসীনদের প্রতি জনগণের আস্থা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।

উপদেষ্টাদের তালিকায় দেখা বোঝা যায়, এখানে সাবেক আইনজীবী, সাবেক কূটনীতিক, আইনের শিক্ষক, নারী নেত্রী, বেসরকারি সংস্থার নির্বাহীরা আছেন। উপদেষ্টাদের শিক্ষাগত যোগ্যতায় দেখা যায় আইন, অর্থনীতি, এনজিও, পরিবেশ, মানসিক স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা বেশি। হতাশার বিষয়, উপদেষ্টা তালিকার মধ্য নেই কৃষি, তথ্যপ্রযুক্তি, যন্ত্র প্রকৌশল, ক্রীড়া, স্থাপত্য প্রকৌশল অথবা ন্যাচারাল সায়েন্স বিষয়ে কোনো পেশাজীবী/বিজ্ঞানী/শিক্ষক। উপদেষ্টাদের তালিকা ছোট, এখানে সব বিষয়ের প্রতিনিধিত্ব সম্ভব নয়। সে কারণেই একই বিষয়ে শিক্ষা ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষকে অধিক অন্তর্ভুক্ত না করাটা  সমীচীন ছিল। রাষ্ট্র পরিচালনা ও সংস্কারের জন্য ভিন্ন ভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা ও জ্ঞান প্রয়োজন। ব্যক্তির প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব টেবিল আলোচনার জন্য সহায়ক হতে পারে, কিন্তু প্রতিষ্ঠানের সমস্যার গভীরে প্রবেশের জন্য সংশ্লিষ্ট শিক্ষা ও অভিজ্ঞতার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে। রাজনৈতিক নেতৃত্বের পেশাগত অনভিজ্ঞতা স্বাভাবিকভাবেই আমলা নির্ভরশীলতা তৈরি করে। আমলাতন্ত্র হলো স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অন্যতম খুঁটি।

আমলা নির্ভরশীলতার চক্র ভঙ্গ না হলে বিপ্লব বেহাতের আশঙ্কা সৃষ্টি হতে পারে।

সুতরাং, উপদেষ্টারা কি স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি সৃষ্টির নৈতিক দায়বদ্ধতা থেকে এই নিবন্ধে প্রস্তাবিত তথ্য প্রকাশের উদ্যোগ নেবেন? আমাদের কি জানাবেন, আপনার দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয় বা বিভাগ বা তার দপ্তর সংস্থা পরিচালনা করার জন্য আপনার কী কী যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা আছে? যদি আপনি উপলব্ধি করেন, দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আপনার যথেষ্ট জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নেই, তাহলে নৈতিকভাবে আপনি কী করবেন? আপনি দায়িত্ব শেষে, পদত্যাগ অথবা ক্ষমতা হস্তান্তর যে প্রক্রিয়া হোক না কেন, আপনার সম্পদের স্থিতি হিসাব দেশবাসীকে দেবেন কি?

লেখক: মো. জাহিদুল ইসলাম