মাইন্ড গেমে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ব জয়

ট্রফি হাতে অস্ট্রেলিয়ার উৎসব
এএফপি

অস্ট্রেলিয়ার শুরুটা কিন্তু এবার খুব একটা ভালো হয়নি। বরং প্রথম চার ম্যাচে দুই হারে তাদের সেমিফাইনালে ওঠা নিয়েই অনিশ্চয়তা দেখেছিলেন অনেকে। সেই অস্ট্রেলিয়া ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং টানা ১০ ম্যাচ জিতে হট ফেবারিট তকমা পাওয়া এবং পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে অতিমানবীয় ক্রিকেট খেলা পরাক্রমশালী ভারতের বিপক্ষে জয়লাভ করে ষষ্ঠবারের মতো বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।

ফাইনাল খেলে জয়লাভ করার অভিজ্ঞতা, চাপ মোকাবিলা করার সক্ষমতা—সবকিছু ছাপিয়ে এবার তারা দেখিয়েছে মাইন্ড গেমের জাদু। শুরুটা করেছিলেন মিচেল মার্শ। ভারতের একটি জনপ্রিয় স্পোর্টস চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি অস্ট্রেলিয়ার ৪৫০ রানের বিপরীতে ভারতের ৬৫ রানে অলআউটের ঘোষণা দিয়ে আপাতদৃষ্টে হাস্যরসাত্মক (ভারতের ফর্ম বিবেচনায়) পরিবেশের সৃষ্টি করেন। আসলে এটা সূক্ষ্ম একটা কৌশল।

রিকি পন্টিংয়ের সর্বকালের সেরা দল একসময় অন্য সব দলকে বলেকয়ে হারাত। প্রায় দুই দশক আগে একবার দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে শেন ওয়ার্নকে সিরিজের ফলাফল নিয়ে প্রশ্ন করা হলে উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমরা সিরিজ ৩-০–তে জিতব।’ হার্শেল গিবস-গ্যারি কারস্টেন আর পোলক-ডোনাল্ডদের দক্ষিণ আফ্রিকা দলটাকে সত্যিই তাঁরা ৩-০ ব্যবধানে পরাজিত করেন। খেলার পাশাপাশি অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের স্লেজিংয়ের ধারও ছিল তুখোড়! মাঠে খেলার আগে মাঠের বাইরে কথার লড়াই ছিল তাঁদের কৌশলের একটা অংশ। গিলক্রিস্ট, পন্টিং, ম্যাকগ্রা কিংবা সাইমন্ডস—কেউ কারও চেয়ে কম ছিলেন না। প্যাট কামিন্সের অস্ট্রেলিয়া সে রকম দল নয়। এমনকি স্বীকৃতি ব্যাটসম্যানরাও ছিলেন কিছুটা অফ ফর্মে। বোলিংয়েও কামিন্স, স্টার্কদের সেরাটা দেওয়া হয়নি।

তারপরও মার্শ যেন বেছে নিলেই পূর্বসূরিদের সেই পন্থা। সঙ্গ পেলেন অধিনায়ক প্যাট কামিন্সের। আহমেদাবাদে এক লাখের বেশি দর্শককে চুপ করিয়ে দিতে চাইলেন তিনি। ম্যাচের আগের দিন দিলেন মোক্ষম চাল। দলের স্টাফদের নিয়ে পিচের ছবি তোলা, ভিডিও করে আলোচনায় অস্ট্রেলিয়া। পরে ম্যাচের দিন সাফ জানিয়ে দিলেন পিচ নিয়ে তাঁর কোনো মাথাব্যথাই ছিল না। আসলে পিচ তিনি খুব একটা বোঝেনও না। তাঁদের লক্ষ্য যেকোনো পরিস্থিতিতে ম্যাচ জয়! এখানে তাঁর কৌশলের প্রশংসা না করলেই নয়!

আহমেদাবাদের গ্যালারিতে ঢেউ তুলেছে নীল রং। মাঠে ভারতকে সমর্থন দিতে এভাবেই হাজির হয়েছিলেন সমর্থকেরা। তবে এই নীলের ঢেউ থামিয়ে হলুদ উৎসব করেছে অস্ট্রেলিয়া

এরপরে মাঠের লড়াই। শুরুতে টস জিতে সবাইকে অবাক করে ভারতকে ব্যাটিংয়ে পাঠান কামিন্স। দ্বিতীয় ইনিংসে ডিউ ফ্যাক্টরের চেয়ে এখানে ছিল আরেক সূক্ষ্ম কৌশল। আগে ব্যাট করলে ভারত ৪০০–এর বেশি স্কোর করবে, এ আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরাতে তাদের আগে ব্যাটিংয়ে পাঠানোটা একরকম চ্যালেঞ্জ ছিল। অতি আত্মবিশ্বাসী ভারত অকল্পনীয়ভাবে টসে হেরে ব্যাটিং পেয়ে যেন দ্বিধান্বিত হয়ে গিয়েছিল। রোহিত শর্মা দারুণ শুরু করলেও বাকিদের অবস্থা ছিল হতাশাজনক। অর্ধশত করলেও বিরাট কোহলি আর লোকেশ রাহুলের ব্যাটিংয়ে সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। অস্ট্রেলিয়ান বোলাররা ভারতের ব্যাটসম্যানদের মন পড়ে ফেলেছিলেন। একের পর এক স্লোয়ার বাউন্সারে কুপোকাত করেন ব্যাটসম্যানদের। ১৪৮ রানে চার উইকেটের পতন হলে ভারত যখন রবীন্দ্র জাদেজাকে মাঠে নামায়, তখন অস্ট্রেলিয়ানরা আবারও মাইন্ড গেম খেলে। যতই ফর্ম খারাপ যাক, সূর্যকুমারকে বসিয়ে রবীন্দ্র জাদেজাকে নামানোটা ছিল ভারত ক্রিকেট দলের আত্মবিশ্বাসে চিড় ধরার লক্ষণ। পঞ্চম উইকেট জুটির ব্যাটিংয়ের সময় পরপর দুই বলে ওভারথ্রোতে রান দেওয়ার পর কট বিহাইন্ডের আবেদন যেন রবীন্দ্র জাদেজার খেলার মনোযোগ ও বিশ্বাসে চিড় ধরায়। সুযোগ লুফে নেয় অস্ট্রেলিয়া। ফলাফল পরের বলে ৩৫.৫ ওভারে দলীয় ১৭৮ রানের মাথায় জাদেজা কট বিহাইন্ড! এরপর সূর্যকুমারকে একের পর স্লোয়ার বাউন্সারে নাজেহাল করেন স্টার্ক, কামিন্স, হ্যাজেলউড আর মিচেল মার্শ। মাত্র ১৮ রান করে অজি পেসার জশ হ্যাজেলউডের দ্বিতীয় শিকার হন তিনি। প্যাট কামিন্সের ক্যাপ্টেন্সির বরাতে মাত্র ২৪০ রানে অলআউট ভারত। বিরতির পর দ্বিতীয় ইনিংসে নেমেই ধুন্ধুমার ব্যাটিং শুরুর ইঙ্গিত দেন ডেভিড ওয়ার্নার ও ট্রাভিস হেড। অফ স্টাম্পের বাইরের বল কাট করতে গিয়ে মাত্র ৭ রানে আউট ওয়ার্নার। ৪৭ রানে তিন উইকেট খুইয়ে বসে অস্ট্রেলিয়া। অপর প্রান্তে তখনো হেড খেলছেন। কোনো প্রকার চাপ না নিয়ে দারুণ একের পর এক শট খেলে গেছেন। লাবুশেন ছিলেন যোগ্য সঙ্গী। একজন এক প্রান্ত আগলে রেখেছিলেন আরেকজন চোখধাঁধানো শট খেলে যাচ্ছিলেন। যেন আফগানিস্তানের সঙ্গে খেলা ম্যাচের পুনরাবৃত্তি! বুঝে গিয়েছিলেন ব্যাট হাতে টিকে থাকলেই ফাইনাল জেতা হয়ে যাবে! ১৪০ মিলিয়ন মানুষের প্রত্যাশা আর এই দুই ব্যাটসম্যানের সৃষ্টি করা চাপে যেন ভেঙে পড়েন শামি–সিরাজরা। ট্রাভিস হেড আর মারনাস লাবুশেনের প্রবল আত্মবিশ্বাসী ব্যাটিংয়ে বিবর্ণ হয়ে যায় বোলিং। বেদনায় নীল আহমেদাবাদের পুরো গ্যালারি। একরকম হেসেখেলেই ৭ ওভার বাকি থাকতেই ম্যাচ জিতে যায় অস্ট্রেলিয়া। আতশবাজির আলোকচ্ছটা জানান দেয় ষষ্ঠবারের মতো আইসিসি মেন্স ওয়ার্ল্ড কাপ-২০২৩–এ চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়া।

দারুণ বোলিং, দুর্দান্ত ফিল্ডিং আর ট্রাভিস হেডের সেঞ্চুরি ছাপিয়ে মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ে এদিন অস্ট্রেলিয়া ছিল সেরা। ভারত পরাজয় বরণ করে নিল ব্যাট–বলের প্রতিযোগিতার চেয়ে কামিন্সদের ক্রিকেট–মস্তিষ্কের কাছে। আর অস্ট্রেলিয়া আরেকবার জানান দিল, তারাই ফাইনালের অবিসংবাদিত রাজা!
লেখক: রবিউন নাহার তমা, শিক্ষক ও লেখক