অরুণের স্কুলযাত্রা
বাইরে তুমুল বৃষ্টি। ঘুমে আচ্ছন্ন অরুণ। বিদ্যুৎ নেই। কম্বল মুড়িয়ে দারুণ ঘুম হচ্ছিল অরুণের। হঠাৎ আকাশ চমকে উঠল। তাৎক্ষণিক বুক ধক করে উঠল অরুণের। ঘুম ভেঙে গেল। ঘরের জানালা খুলে দেখল বাইরে বিরূপ আবহাওয়া। ততক্ষণে বৃষ্টির তীব্রতা কমে গেছে। বাইরে এখন গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। কালো মেঘগুলো আকাশ চষে বেড়াচ্ছে। কিছুক্ষণ পরপর মেঘগুলো গলে বৃষ্টি আছড়ে পড়ছে পৃথিবীর কোলে। চারপাশে সুনসান নীরবতা। কাকপক্ষীর শব্দও নেই। গাছগুলো নিস্তব্ধ। পাতাগুলো বৃষ্টিতে ভিজে সিক্ত। অরুণ জানালার ফাঁক দিয়ে একটি পাতাবাহারগাছের দিকে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। অরুণের পছন্দ গাছ দেখা। বৃষ্টি দেখা। জোছনা দেখা। বৃষ্টির জলে অবগাহন করায় পাতাবাহারগাছটি অসম্ভব সুন্দর লাগছে। পাতা-গুল্ম থেকে বৃষ্টির জল গড়িয়ে পড়ছে। অরুণের সূক্ষ্মদর্শী চোখ নিবিড়ভাবে দেখছে পাতার শরীর বেয়ে জল গড়িয়ে পড়া। যখন জল পাতার ওপর আছড়ে পড়ছে, পাতাগুলো নড়ে যাচ্ছে। পাতার শরীর সিক্ত করে যখন নিচে পড়ে যাচ্ছে ছিটেফোঁটা বৃষ্টি, তখন পাতাগুলোর মাথা ঈষৎ নুইয়ে আসছিল। মাঝেমধ্যে মৃদু হাওয়া বয়ে যাচ্ছিল।
পাতাবাহারগাছটির পাতাগুলো হাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দোল খেয়ে যাচ্ছে। আর ঠান্ডায় অরুণের গায়ের লোমগুলো খাড়া হয়ে যাচ্ছে। অরুণ কম্বল টেনে নিল। গায়ে জড়িয়ে নিয়ে আবার জানালায় হেলান দিয়ে অপলক দৃষ্টিতে দেখছে বৃষ্টির জলফোঁটা ও পাতার জলবিলাস। হঠাৎ একটা মাছি ভনভন করে পাতার ওপর এসে বসল। অরুণ আরও একটু কাছে এসে জানালার গ্রিল ঘেঁষে বসল। মাছির দুটি পা দোলানো, দুটি হাত দোলানো, পাখা মেলে চট করেই স্থান পরিবর্তন দেখছে অরুণ। এ রকম করেই চলল কিছুক্ষণ। এরপর ঘড়ির কাঁটার ঠকঠক শব্দ কানে আসল। ৯টা বেজে ১৫ মিনিট। অরুণের স্কুল পৌনে ১০টায়। আজ বৃষ্টিস্নাত দিন, মেঘাচ্ছন্ন আকাশের কারণে সময় টের পায়নি।
পাতাবাহারগাছটির জলবিলাস দেখা চুকিয়ে দ্রুত বিছানা ছেড়ে উঠল অরুণ। খুব দ্রুত পরিপাটি হয়ে স্কুলের উদ্দেশে রওনা হলো খালি পায়ে! কারণ, গত কিছুদিন অরুণের জুতা ছেঁড়া। পায়ে দেওয়ার কোনো উপায় নেই। দ্রুত পরিপাটি হয়ে রওনা হলো। অরুণ সময়ের গুরুত্ব দিতে জানে। তাই মিনিটের কাঁটা ধরে সময়কে বিচার করে। বাসা থেকে স্কুলের দূরত্ব ১ কিলোমিটার। পায়ে হেঁটে অরুণ চলছিল। সামনে দেখা গেল হলুদ ব্রিজ। তার একটু সামনেই ধোলাইচাঁপা বাজার। ধোলাইচাঁপা বাজারে ভেতরগলিতে গিরিশ চাচার দোকানে গেল। মুচি চাচাকে সালাম দিল আনন্দভরা মুখে। চাচার হাতে ময়লা লেগে ছিল। অরুণ আগবাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করল। এরপর গিরিশ চাচার পরিবারের খোঁজখবর নিল। চাচি কেমন আছেন? আপনার বাচ্চাগুলো কেমন আছে? শরীর-স্বাস্থ্য ভালো তো, চাচা? ইত্যাদি জিজ্ঞেস করল। অরুণ প্রায়ই গিরিশ চাচার সঙ্গে গল্প করে। চাচাও তার সঙ্গে গল্প করতে দারুণ আগ্রহী। অরুণের কথাবার্তা ও সৌজন্যে চাচার চোখ ছলছল কর ওঠে মাঝেমধ্যে! সবিস্ময়ে কখনো বলে ওঠে, ‘তুই একটা ভালো ছেলে। একদিন অনেক বড় হবি।’ অরুণের বদ্ধমূল বিশ্বাস, কিছু কিছু মানুষকে খুব সহজে খুশি করা যায়। অরুণ চর্মকার গিরিশ চাচার সঙ্গে আহ্লাদের সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে। সালাম দেয়। পরিবারের খোঁজখবর নেয়। এতেই গিরিশ চাচা এত বেশি খুশি হন, তাঁর মুখে অসম্ভব সুন্দর আনন্দের হাসি চিকচিক করে। আজ গল্পের আসর বড় করা যাবে না। অরুণের স্কুল দেরি হয়ে যাচ্ছে। চট করে অরুণ জুতাজোড়া খুলে গিরিশ চাচাকে দিল। চাচা খুব দ্রুত সেলায় করে দিলেন। ২০ টাকা এল পারিশ্রমিক। অরুণ গিরিশ চাচাকে টাকা দিয়ে বরাবরের মতোই খুবই হাসিমাখা সৌজন্যে চাচার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করে স্কুলের দিকে দ্রুতবেগে রওনা দিল।
চলতে চলতে অরুণ দেখল রাস্তায় একটা ইঁদুরছানার রক্তাক্ত লাশ পড়ে আছে। পচন ধরেছে। বিশ্রী গন্ধও বের হচ্ছে। কোনো গাড়ি হয়তো পিষে দিয়ে গেছে! অরুণ একটু থামল। গাছ থেকে একটি পাতা ছিঁড়তে গেল। তখন ছিল ফাগুন মাসের প্রথম সপ্তাহ। গাছগুলো নতুনভাবে সেজে উঠেছে। কচি কচি পাতাগুলো, ফুলগুলো দেখতে অপূর্ব সুন্দর লাগছিল। অরুণ সাহিত্যমনা ছেলে। সে বিশ্বাস করে, যে একবার কবিতার প্রেমে পড়ে যায় তাকে পৃথিবীর কোনো কিছু টানতে পারে না। আর যে কবিতা ভালোবাসে, সাহিত্য পছন্দ করে সে এমন সুন্দর গাছের কচি সবুজ পাতা ছিঁড়তে পারে না! তাই গাছের জীবন্ত সবুজ পাতাটি না ছিঁড়ে নিচে পড়ে থাকা কয়েকটি পাতা নিল। এরপর পাতায় মুড়িয়ে ইঁদুরছানাটিকে খালে ফেলে দিতে গেল। হঠাৎ অরুণ থেমে গেল! বুদ্ধি এল একে পুঁতে ফেলা উচিত। কারণ, এর দ্বারা পানি দূষিত হবে। অরুণ রাস্তার কিছুটা নিচে নেমে ছোট একটি গর্ত করে মৃত ইঁদুরছানাটিকে পুঁতে দিল মাটিতে। এরপর পুকুরের আরও খানিকটা নিচে নেমে হাত ধুয়ে আবার পুরোদমে রওনা দিল স্কুলের দিকে। চলতে লাগল। আবহাওয়ার অবস্থা কেমন-কেমন। হঠাৎ ঝুম বৃষ্টির মতো আসে। কিছুক্ষণ পর আকাশে মেঘ কেটে গেলে বৃষ্টি থেমে যায়। এরপর আস্তে আস্তে সূর্য হেসে ওঠে। হঠাৎ রোদ, হঠাৎ বৃষ্টি—এ রকম করে চলছিল প্রকৃতি। মাঝেমধ্যে বিদ্যুৎ চমকায় বজ্রের মতো। অরুণ ভয় পেয়ে ওঠে! তবু হাঁটে। এভাবেই চলতে লাগল।
এরপর স্কুলে পৌঁছাল অরুণ। স্কুলের মাঠে কাদা, বৃষ্টিতে ভিজে ঘাসগুলো পিছলে হয়ে গেছে। অরুণ সাবধানে পা ফেলছে। তার স্যান্ডেল কম দামি। তার ওপর অনেকগুলো সেলাই পড়েছে গিরিশ চাচার হাতে! সুতরাং একটু হেরফের হলে পিছলে পড়ার আশঙ্কা ঢের বেশি। কাদামাখা সবুজ মাঠ পেরিয়ে অরুণ স্কুলে এল। এতক্ষণে প্রথম ক্লাসটি শেষ! হাঁটতে হাঁটতে অরুণের হঠাৎ চোখ পড়ল পতাকার দিকে। বৃষ্টির সঙ্গে ঝড়–হাওয়া থাকায় পতাকাদণ্ডের নিচে খুব অসহায়ের মতো পড়ে আছে পতাকা! অরুণের বুক ফেটে গেল যেন! দ্রুত এগিয়ে গেল। পতাকা হাতে তুলে মাথায় নিল। চুমু খেল। ইশারায় স্যালুট দিল। এরপর ঠিক করে দিল পতাকা। এখন অরুণ ক্লাসে যাবে। ক্লাসের দিকে দৃষ্টিপাত দিতেই অরুণ দেখল একজন বৃদ্ধ মানুষ মাঠ পেরিয়ে আসতে চাচ্ছেন। কাঁপা কাঁপা হাত তাঁর। স্কুলের পেছনে অনেকগুলো বাসাবাড়ি। সেখানে অনেকেই থাকেন। তিনিও থাকেন সেখানে। অরুণ এগিয়ে গেল তাঁর দিকে। অরুণ কাছে গিয়ে দেখল উনি রহমান দাদা! যিনি সরাসরি এ দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। যুদ্ধে তাঁর পায়ে দুটো গুলি লেগেছিল। এখন তিনি লাঠিতে ভর করে হাঁটাচলা করেন। পাড়াগাঁয়ের শিশু, তরুণ যুবারা রহমান দাদার কাছে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনতে যায়। দাদা যখন মুক্তিযুদ্ধের গল্প বলতে শুরু করেন। তখন তাঁর চোখ ভিজে আসে। ফ্যালফেল করে কেঁদেও দেন মাঝেমধ্যে। ১৯৭১–এর পাকিস্তান বাহিনীর ভয়াবহ নৃশংসতার গল্প বলতে গিয়ে তাঁর গলা খচখচ করে। হাতের সাদা বর্ণ ধারণ করা লোমগুলো খাড়া হয়ে যায়। যাহোক অরুণ রহমান দাদাকে এগিয়ে দিল। দ্বিতীয় পিরিয়ডের ঘণ্টা শেষ।
লেখক: মো. কামরুল হাসান, শিক্ষার্থী, সুবর্ণচর, নোয়াখালী