সিভিল সার্ভিসের বৈষম্য কতটা বিলোপ হলো
এক মাসের বেশি বয়সী অন্তর্বর্তী সরকার সব সমস্যার সমাধান এত অল্প সময়ে করতে পারবে না, এটাই স্বাভাবিক। একটি বিশেষ ক্যাডারে এই সময়ে তিনবার পদোন্নতি দেওয়া হলেও একই সময় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ অথবা মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের কোনো পদোন্নতির আদেশ আমরা দেখি নাই। ‘অনেক ক্যাডারের ৩৭তম ব্যাচ ২০১৯ সালে নবম গ্রেডে যোগদানের পর ফিডার পদে পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ২০২৪ সালে ষষ্ঠ গ্রেডে পদোন্নতি পেয়েছে। অপর দিকে শিক্ষা ক্যাডারের ৩১তম ব্যাচের অনেকে পরবর্তী উচ্চতর গ্রেডে (ষষ্ঠ) পদোন্নতির সব শর্ত পূরণ করা সত্ত্বেও ১১ বছরের অধিক সময় ধরে নবম গ্রেডেই কর্মরত আছেন। ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান পর গঠিত সরকার স্বল্প সময়ে জনপ্রশাসনের বঞ্চনা, বৈষম্য ও অবিচারের সমাধান হওয়া সম্ভব হলে অন্যদের বেলায়ও কেন নয়? শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে প্রজাতন্ত্রের সব কর্মচারীর সঙ্গে সম আচরণ করতে হবে। তার সততা, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা ও অর্জনকে আবশ্যিকভাবে মূল্যায়ন করতে হবে। ১৯ আগস্ট হতে বিভিন্ন আদেশে ৮৯৮ জনপ্রতিনিধি এবং ২০ আগস্ট শিক্ষা মন্ত্রণালয় দেশের সব বেসরকারি স্কুল ও কলেজের গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটির সভাপতিদের অপসারণ করে পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের। অথচ অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য জেলার শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের স্কুল ও কলেজ গভর্নিং বডি ও ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া যেত। সার্ভিস (রি–অর্গানাইজেশন অ্যান্ড কন্ডিশন) অ্যাক্ট ১৯৭৫’ অনুযায়ী একই গ্রেডে এবং স্কেলের কর্মকর্তাদের মধ্যে বেতন-ভাতা ও সুবিধার ক্ষেত্রে কোনো বৈষম্য করার সুযোগ নেই। নীতিনির্ধারকদের অনেকে মনে করেন, একই পরীক্ষা দিয়ে চাকরিতে এলেও প্রত্যেকের মেধাক্রম অভিন্ন নয়। অধিকতর মেধাবীরা তাদের পছন্দ অনুসারে আকর্ষণীয় চাকরিগুলো পাবেন, এটাই স্বাভাবিক।
যেহেতু পছন্দক্রম এবং মেধাক্রমের সমন্বয়ে চূড়ান্ত ফলাফল নির্ধারিত হয় এবং দেখা যায় অধিকাংশ চিকিৎসক, প্রকৌশলী এবং অনেক কৃষিবিদ ও শিক্ষা ক্যাডার কর্মকর্তা মেধাক্রমে শীর্ষে থাকার পরও শুধু সংশ্লিষ্ট পেশার প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা থাকার কারণে এবং শিক্ষাজীবনের অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে দেশ ও জাতির সেবার ব্রত নিয়ে যোগদান করেন এসব ক্যাডারে। তাই মেধাক্রমে পেছনের দিকে থাকা প্রার্থীরা চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ অথবা শিক্ষক হিসেবে যোগ দিয়েছেন এমন ধারণার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়।
চাকরির সুযোগ-সুবিধা সাধারণত নির্ধারণ করা হয় তার কর্মপরিধি অনুসারে। তবে এ নিয়মের ব্যত্যয় ঘটে শুধু চিকিৎসক, শিক্ষক, প্রকৌশলীদের ক্ষেত্রে। যেমন পররাষ্ট্র ক্যাডার কর্মকর্তারা বিদেশে পদায়নকালে বিদেশ ভাতা, আপ্যায়ন ভাতা, চিকিৎসার সব সুযোগ, সন্তানদের পড়াশোনার ভাতা পান এবং সরকারি ব্যয়ে নিতে পারেন একজন গৃহপরিচারক।
রাষ্ট্রদূতেরা সরকারি খরচে একজন বাবুর্চি ও একজন মালি নিয়োগ দিতে পারেন। তেমনি মাঠ প্রশাসনে কর্মরত থাকাকালে একজন জেলা প্রশাসক (ডিসি) বা পুলিশ সুপার (এসপি) সহায়ক কর্মচারীর সুবিধা পান তাদের বাসভবনে। আছে ভালো গাড়ির সুবিধাও। তাদের জুনিয়র সহকর্মীরাও কর্মপরিধি বিবেচনায় ক্ষেত্রবিশেষে গাড়ির সুবিধা পেয়ে থাকেন।
প্রশাসন ক্যাডারের উপসচিব সমপর্যায়ের পঞ্চম গ্রেডের কর্মকর্তারা গাড়ি কেনার জন্য ৩০ লাখ টাকা সুদমুক্ত ঋণ ও গাড়ি ব্যবস্থাপনার জন্য প্রতি মাসে ৫০ হাজার টাকা পাচ্ছেন প্রায় একই ধরনের সুবিধাদি পাচ্ছেন অনেক নন-ক্যাডার এবং ব্যাংকাররাও। এগুলো সবই যেমন যৌক্তিক তেমনি প্রকৌশলী, চিকিৎসক, কৃষিবিদ ও শিক্ষকদের এসব সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা অত্যন্ত দুঃখজনক ও অমর্যাদাকরও বটে। প্রশাসন, পুলিশ, অন্য ক্যাডার, নন–ক্যাডার, ব্যাংকার, অনেক ক্ষেত্রে ছাত্রদের জন্য এমনকি কর্মচারীদের জন্য যাতায়াত ব্যবস্থা থাকলেও শিক্ষকদের জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই। থানায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সত্যিকার অর্থে যেমন একাধিক গাড়ির প্রয়োজন ঠিক তেমনি শিক্ষকদের পাঠদানের নিমিত্তে ল্যাপটপ প্রয়োজনীয় উপকরণ ও মোবাইল ভাতা প্রয়োজন।
সরকার বৈদেশিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মকর্তাদের দক্ষ করার যে উদ্যোগ নিয়েছে, তাতে প্রশাসনের জন্যই সিংহভাগ অন্য ক্যাডারের জন্য মাত্র ৩০ ভাগ রাখার যে অনুশীলন চলছে, তা অযৌক্তিক। সুযোগ-সুবিধাদি অনেক ক্ষেত্রেই অভিন্ন হবে না, এতে অস্বাভাবিক কিছু নেই তবে কৃষিবিদ, প্রকৌশলী ও শিক্ষকদের জন্য উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের ক্ষেত্রে বৃত্তির প্রাধিকার ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও পেশাগত উৎকর্ষ সাধনের জন্য জরুরি। কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এই যে, উচ্চ শিক্ষাবৃত্তি প্রাপ্তদের তালিকায় কৃষিবিদ, প্রকৌশলী অথবা শিক্ষকেরা দিন দিন সংখ্যালঘু হয়ে পড়েছেন। যদিও প্রতি ক্যাডার, সাব-ক্যাডারে গঠনকাঠামো একই রকম নয়, তবুও একই সময়ে চাকরিতে প্রবেশ করে বিভিন্ন ক্যাডারে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে পদোন্নতি বেমানান।
যদিও চাকরির ধরন ও নিয়োগপদ্ধতি ভিন্ন তবুও নবম গ্রেডে একই যোগ্যতা নিয়ে যোগদান করেও স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তিন বছরে এবং প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা দুই বছরে চলে যাচ্ছেন ষষ্ঠ গ্রেডে। অন্যদিকে, ক্যাডার কর্মকর্তাদের সেখানে ক্ষেত্রবিশেষে ১০ থেকে ১২ বছর লেগে যাচ্ছে। তবে আন্তরিক হলে যোগ্যতা অর্জন সাপেক্ষে সুপারনিউমারারি (সংখ্যাতিরিক্ত পদ) পদোন্নতি অথবা ব্যাচভিত্তিক পদোন্নতি কিংবা উচ্চতর গ্রেড প্রদান করেও সমস্যার সমাধান করা যায়।
এক ক্যাডারের শিডিউলভুক্ত পদে অন্য ক্যাডার পদায়নের সুযোগ না থাকলেও প্রাইমারি, কারিগর, ব্যানবেইজ, এনটিআরসিএ, এনসিটিবি মাদ্রাসা, উপানুষ্ঠানিকসহ শিক্ষা ক্যাডারের শিডিউলভুক্ত অনেক দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে প্রশাসন ক্যাডারের পদায়ন দেওয়া হয়েছে। এমনকি বিভাগীয় শহরগুলোতে পোস্টিং দুর্নীতির অজুহাতে মন্ত্রণালয় নিজেদের হাতে নিয়ে নিয়েছে। অন্য ক্যাডারের কিছু ব্যক্তির দুর্নীতির অভিযোগ যখন আসে, তখন কি দায়িত্ব অথবা দপ্তর সেই ক্যাডারের হাত থেকে নিয়ে নেওয়া হয়? শুধু তা–ই নয়, বিসিএস খাদ্য, সমবায়, পরিসংখ্যানসহ অন্যান্য ক্যাডারের শীর্ষ পদগুলোয়ও কর্মরত থেকে ওই ক্যাডার কর্মকর্তাদের নিয়ন্ত্রণ করছেন প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা। উপসচিব পদোন্নতি পাওয়া সবার সমান অধিকার। কেননা, উপসচিব হতে ওপরের দিকের পদগুলো সরকারের।
কিন্তু নিকট অতীতের একটি সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে প্রশাসন ক্যাডারের ৭৫ শতাংশ এবং বাকি ২৫ শতাংশে ২৫ ক্যাডারের কর্মকর্তারা পদোন্নতি পাচ্ছেন কৌলিন্য প্রথার স্রষ্টা রাজা বল্লাল সেন নবগুণবিশিষ্টদের কুলীন উপাধি দিয়েছিলেন। আচার, বিনয়, বিদ্যা, প্রতিষ্ঠা, তীর্থ দর্শন, নিষ্ঠা, শান্তি, তপ ও দানের মতো গুণের ‘কুল লক্ষণ’ বা ‘নবগুণ’ ও কর্মের ভিত্তিতে প্রতি ৩৬ বছর শেষে একবার কুলীন ও অকুলীন নির্বাচিত করতেন।
কুলমর্যাদা লাভার্থে সবাই ধার্মিক ও গুণবান হতে চেষ্টা করত। কিন্তু লক্ষণ সেনকৃত ব্যবস্থায় তা বংশানুক্রমিক হয়ে গিয়ে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে এবং কালানুক্রমে তা বিলুপ্ত হয়ে যায়। ঠিক তেমনি উপসচিব থেকে ওপরের পদগুলো যেহেতু সরকারের, তাই এই পদগুলোয় পদোন্নতির ক্ষেত্রে কোনো প্রথা অনুসরণ না করে সিভিল সার্ভিসের সদস্যদের মধ্য থেকে নির্দিষ্ট সময়ান্তে উন্মুক্ত পরীক্ষা, বিগত চাকরিজীবনের দক্ষতা, সততার বিচারে ওই পদে পদোন্নতি দেওয়া সময়ের দাবি অন্যথায় সিভিল সার্ভিসের মান নিম্নগামী হয়ে তা কৌলীন্য প্রথার পরিণতি বরণ করলে অবাক হওয়ার অবকাশ থাকবে না। নিকট অতীতে সাবেক সরকারপ্রধানের নির্দেশে তথ্য ক্যাডারের শীর্ষ পদ প্রধান তথ্য কর্মকর্তা, শিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালকের পদসহ অনান্য ক্যাডারের একটি করে পদ গ্রেড-১ উন্নীত করা হয়েছে। পক্ষান্তরে প্রশাসন ক্যাডারে সচিব ও সিনিয়র সচিব পদে অনুমোদিত পদের সংখ্যা প্রায় ৮১টি। যেখান বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষককেরই কর্মজীবনে গ্রেড-১ যাওয়ার সুযোগ ঘটে, সেখানে সব ক্যাডারের অধিকাংশ কর্মকর্তার কর্মজীবনের ইতি টানতে হয় গ্রেড-৪ গিয়ে।
প্রশাসন ক্যাডারে অনুমোদিত প্রায় ১২০টি অতিরিক্ত সচিব পদের বিপরীতে অনান্য ক্যাডারের গ্রেড-২ কর্মকর্তাদের সংখ্যা অপ্রতুল। সমগ্র শরীরকে বঞ্চিত করে কেবল মুখে রক্ত জমলে তাকে স্বাস্থ্য বলা যায় না, তেমনি সব ক্যাডারকে বঞ্চিত করে সুবিধাদি একটি বিশেষ ক্যাডারে পুঞ্জীভূত করে দক্ষ ও সময়োপযোগী সিভিল সার্ভিস গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
রাজা ষোড়শ লুইয়ের সময়ে ফ্রান্সে প্রভাবশালী বুর্জোয়াদের উত্থান যাঁরা আনুষ্ঠানিকভাবে তৃতীয় এস্টেটের (সাধারণ) অংশ ছিল কিন্তু নিজেদের একটি ভিন্ন দল গড়ে তুলে পাদ্রিরা (প্রথম এস্টেট) এবং অভিজাত্যদের (দ্বিতীয় এস্টেট) সঙ্গে রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিল ফলে একটি বিপ্লবী বায়ুমণ্ডল এবং জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়। সংকট সমাধানে রাজা ১৭৮৯ সালে এস্টেট-জেনারেলকে ডেকেছিলেন। এটি যখন অচলাবস্থায় এসেছিল, তখন তৃতীয় এস্টেটের প্রতিনিধিরা রাজার ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটি জাতীয় পরিষদ গঠন করেছিলেন, যা ফরাসি বিপ্লব শুরুর বার্তা দিয়েছিল।
তেমনিভাবে বৈষম্যহীন সিভিল সার্ভিস গঠনে বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের (বিসিএস) ২৫টি ক্যাডার নিয়ে গঠিত ‘আন্ত ক্যাডার বৈষম্য নিরসন পরিষদ’ একগুচ্ছ দাবি পেশ করেছে যা বঞ্চিত, ক্ষুব্ধ ও অস্থিতিশীল সিভিল সার্ভিসের বহিঃপ্রকাশ। আন্তক্যাডার বৈষম্য নিয়ে যা কিছুই বলা হোক না কেন, তার সবই চর্বিতচর্বণ তবে ২০১২ এবং ২০১৭ সালে তৎকালীন সরকারের কর্তাব্যক্তি বৈষম্য নিরসনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। জুলাই বিপ্লব শেষে অন্দোলন ব্যতীরেকে সব বৈষম্যের অবসান কার্যকর হবে, এমন প্রত্যাশায় প্রহর গুনছেন সিভিল সার্ভিসের সদস্যরা।
*লেখক: সচিব তালুকদার, বিসিএস, (সাধারণ শিক্ষা)