ছাত্রজীবনের হালখাতা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বছর শেষে যেমন একজন দোকানদার পুরোনো হিসাব মেলে ধরে নতুন খাতা খোলে, তেমনি আমিও আজ ছাত্রজীবনের হালখাতা খুলে বসেছি। এ খাতায় আছে স্বপ্ন, সংগ্রাম, সাফল্যের হাসি, আবার আছে ব্যর্থতার নিঃশব্দ কান্না।

প্রথম পাতায় লেখা—স্বপ্ন। ছোটবেলায় বইয়ের পাতায় আঁকা বিজ্ঞানীর ছবি দেখে আমি ভাবতাম, একদিন আমিও কিছু আবিষ্কার করব। আমিও ডাক্তার হয়ে অন্যের পাশাপাশি হব। কিন্তু বাস্তবের কঠিন পাঠে বুঝেছি, শুধু ইচ্ছা নয়, অধ্যবসায়ই মানুষকে গড়ে তোলে।

এই খাতায় লাভ-ক্ষতির হিসাব শুধু নম্বর বা সার্টিফিকেটে নয়, আছে প্রতিটি নিশীথ রাতের ক্লান্তি, প্রতিটি অপ্রাপ্তির দীর্ঘশ্বাস আর হৃদয়মননে একমুঠো অদম্য স্বপ্নের উড়ান।

ছাত্রজীবন অনেকের কাছে স্বাধীনতার অবকাশ কিন্তু আমার কাছে যুদ্ধের ময়দান, যেখানে অস্ত্র হলো বই, আর প্রতিপক্ষ-অনিশ্চয়তা। যে বয়সে অনেকেই শুধু ক্লাসের আড্ডা আর ক্যানটিনের চা নিয়ে মগ্ন থাকে, সে বয়সেই আমাকে পরিবারের কিছুটা হাল ধরতে হয়েছে। সংসারের অস্থিরতার ভেতর দাঁড়িয়ে একদিকে নিজের পড়াশোনা, অন্যদিকে চার-পাঁচটা টিউশন, যেন জীবনের এক অনবরত দৌড়। অনেক রাতে ঘরে ফিরে ক্লান্ত শরীরে বই খুলেছি, শুধু এই বিশ্বাসে যে একদিন এই সংগ্রাম বৃথা যাবে না। এই সবই যেন সেই যুদ্ধের ক্ষতচিহ্ন।

তবু ক্লান্ত জীবনের মধ্যেও বন্ধুরা ছিল আশ্রয়। আর শিক্ষকদের সান্নিধ্যও ছিল এক অনন্য প্রেরণা। তাঁদের কথায় ছিল জীবনের পাঠ, যেগুলো বইয়ের পাতায় লেখা থাকে না। কেউ বলতেন, ‘পরিশ্রম মানেই সৌভাগ্য তৈরি করা।’ কেউ শিখিয়েছেন কীভাবে হোঁচট খেয়েও উঠে দাঁড়াতে হয়। তাঁদের ছায়াতলে আজও নিজেকে খুঁজে পাই। ক্লাস শেষে ক্যাম্পাসের পুরোনো বেঞ্চে বসে আড্ডার ঢেউ যেন মুহূর্তেই মুছে দিত সমস্ত ক্লান্তি। কেউ স্বপ্ন দেখত বিসিএস, কেউ বিদেশ যাওয়ার, কেউ আবার কেবল বাঁচার। সেই হাসিগুলো এখন স্মৃতির পাতায় অমলিন।

নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

তবু বাস্তবতার কড়া শাসন প্রতিদিন মনে করিয়ে দেয়—জীবন কোনো গল্প নয়, এটি হিসাবের খাতা। ক্লাসের ভেতরে যত জ্ঞানই শিখি, বাইরে বেরোলেই টিকে থাকার প্রশ্নটা আরও কঠিন হয়ে ওঠে। সমাজ জিজ্ঞেস করে, ‘চাকরি কবে হবে?’ পরিবার তাকিয়ে থাকে নিঃশব্দ আশায়। আর আমি শুধু নিজের ভেতর এক অদৃশ্য লড়াই চালিয়ে যাই।

বন্ধু হারানোর, সুযোগ হারানোর, ক্লাস মিস করার আফসোস আছে, কিন্তু সবকিছুর ভেতরেও এই ছাত্রজীবনই আমাকে মানুষ হতে শিখিয়েছে। শিখিয়েছে স্বপ্ন দেখা সহজ, কিন্তু সেই স্বপ্নকে বাঁচিয়ে রাখা এক বিশাল দায়িত্ব।

দিনশেষে আমি হয়তো এখনো গন্তব্যে পৌঁছাইনি, কিন্তু পথ হারাইনি। আমি জানি, এই অগণিত দায়িত্ব, এই অবিরাম পড়াশোনা, এই প্রতিটি ঘামবিন্দু একদিন আমার পরিচয় হবে। যে সমাজ আজ প্রশ্ন করে, ‘তুমি কোথায় দাঁড়িয়ে?’ একদিন সেই সমাজই উত্তর দেবে, ‘সে এখন নিজের অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে।’

আমি বিশ্বাস করি এবং এটাই সত্য ‘সংগ্রামই আসল শিক্ষক, ব্যর্থতাই আসল পাঠ্যপুস্তক।’ প্রতিটি মাসের শেষে টিউশন ফি দিয়ে বাবার মুখে ছোট্ট একটুখানি হাসি দেখতে পাই, সেটাই আমার সবচেয়ে বড় বেতন। প্রতিটি সকালেই নতুন সংকল্প করি—আজও থামব না। কারণ, আমার হালখাতার শেষ পৃষ্ঠাটি এখনো অসম্পূর্ণ।

এই পৃষ্ঠায় দেনা–পাওনার হিসাব মেলানো হবে। দেনা হচ্ছে ঘুমহীন রাতের, ক্লান্ত চোখের, অপূর্ণ স্বপ্নের। আর পাওনা কিছু ভালোবাসা, কিছু অর্জন, আর এক অদম্য বিশ্বাস—আমি হারিনি। হিসাবের খাতায় যদি দেনা থেকে যায়, তাহলে আরেকটু চেষ্টা দিয়ে নিজেকে প্রাঞ্জল করেই চেপে থাকা জগদ্দল পাথর নামিয়ে নেব। আর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হব—‘যেটুকু পাইবার মতো সেটুকু পাইয়াই যেন সুখী হতে পারি।’

শিক্ষার্থী: গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়