পরিবেশ দিবসে স্লোগান হোক ‘গাছ লাগান, গাছ বাঁচান ও পরিবেশ বাঁচান’
৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। পরিবেশ-সংক্রান্ত বিশ্বের সবচেয়ে বড় ইভেন্ট। ভূমির গুণাগুণ পুনরুদ্ধার, মরুকরণ প্রতিরোধকে প্রাধান্য দিয়ে এ বছরের থিম হলো—‘Our land. Our future.We are Generation Restoration.’ অর্থাৎ ‘আমাদের জমি। আমাদের ভবিষ্যৎ। আমরাই পুনরুদ্ধার প্রজন্ম।’
১৯৭৪ সাল থেকে প্রতিবছর পৃথিবীব্যাপী ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা, সরকার, পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন কর্তৃক দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এবার সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে দিবসটি।
আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে, অর্থাৎ মাটি, পানি, বায়ুসহ অন্যান্য উদ্ভিদ ও প্রাণী নিয়েই আমাদের পরিবেশ। এ পরিবেশের সঙ্গে মানুষের রয়েছে এক নিবিড় সম্পর্ক। আমরা বুক ভরে যে নিশ্বাস নিই, আমাদের খাদ্য ও জীবনধারণের জন্য অপরিহার্য পানি—সবই আসে প্রকৃতি থেকে। আসলে মানুষ, প্রকৃতি ও জীবজগৎ পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত।
পরিবেশের অবিচ্ছেদ্য উপাদান হলো ভূমি। বাংলাদেশে ভূমিক্ষয় ও মাটির গুণাগুণ হ্রাসের অন্যতম কারণ হলো ব্যাপকভাবে বনভূমি নিধন, সার কীটনাশকের অপব্যবহার, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কারণে উপকূল অঞ্চলে লবণাক্ততা, কৃষিজমিকে অন্য কাজে ব্যবহার, ইটভাটা ইত্যাদি।
বাংলাদেশে ২০১৬ সালের বন জরিপ অনুযায়ী, দেশের মোট গেজেটভুক্ত বনভূমির পরিমাণ দেশের আয়তনের প্রায় ১২ শতাংশ। তবে এর প্রকৃত পরিমাণ নিশ্চিতভাবেই আরও কম হবে। এ জরিপ অনুযায়ী, দেশের ৩৫ জেলায় সরকারি বনভূমি রয়েছে। এককভাবে সুন্দরবন দেশের সবচেয়ে বড় একক বনভূমি। এটি আমাদের জাতীয় বন। এ ছাড়া চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, বৃহত্তর সিলেট, গাজীপুর ও টাঙ্গাইলের বনভূমি উল্লেখযোগ্য।
বনভূমির বিনাশ ও অন্যান্য কাজে এর ব্যবহার করা বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বেই জীববৈচিত্র্য হ্রাস ও ভূমিক্ষয়ের অন্যতম কারণ। ২০২০-এর মে মাসে বিশ্ব কৃষি সংস্থার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক দশকে নানা পদক্ষেপের কারণে বন ধ্বংসের পরিমাণ কমলেও এখনো পৃথিবীতে প্রতিবছর প্রায় ১ কোটি হেক্টর বনভূমিকে ধ্বংস করে কৃষিজমিতে রূপান্তরসহ অন্য কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে।
সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, গাজীপুরের সংরক্ষিত বনাঞ্চলসহ বনের বিশাল অংশ দখলে নিয়ে বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ দীর্ঘদিন ধরে বাণিজ্যিক স্থাপনা গড়ে তুলেছে। কার্যকর মনিটরিংয়ের অভাবে সেখানকার বনের জমি দখল করে কারখানা, খামার, হ্যাচারি, আলিশান রিসোর্ট, পিকনিক ও শুটিং স্পট নির্মাণ করেছে পৌনে দুই শতাধিক প্রতিষ্ঠান। দেড় শতাধিক প্রতিষ্ঠান ও প্রায় ২০ হাজার ব্যক্তির দখলে আছে ১০ হাজার একরেরও বেশি বনভূমি, যা খুবই হতাশাজনক ব্যাপার।
কিছুদিন আগে ভারতের সীমান্ত-সংলগ্ন শেরপুরের ঝিনাইগাতী উপজেলার কাংশা ইউনিয়নের গারো পাহাড়ে শাল-গজারির বনের অন্তত ১৫ থেকে ২০টি স্থানে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এ সময় পাহাড়ের গাছ ও বনবীথি পুড়ে যায়। বনের জমি দখল আর লাকড়ি সংগ্রহ করতে দুর্বৃত্তরা পাহাড়ে আগুন দিয়ে থাকে বলে অভিযোগ আছে।
ময়মনসিংহের কাদিগড় জাতীয় উদ্যানের বৃক্ষনিধন কার্যক্রম চলে অনেকটাই প্রকাশ্যে। অসাধু কিছু ব্যক্তি কর্তৃক পরিবেশ আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে জাতীয় উদ্যানের পাশেই স্থাপন করা হয়েছে অন্তত ১৫টি করাতকল। যেখানে এই সংরক্ষিত বনের গাছ ব্যবহার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ আছে।
বাংলাদেশে বন উজাড় হয়েছে অনেকটা ফ্রি স্টাইলে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ভাওয়াল, মধুপুর ও বৃহত্তর ময়মনসিংহের বনভূমি। প্রতিবছর বর্ষা এলেই একটা স্লোগান শোনা যায়, ‘গাছ লাগান, পরিবেশ বাঁচান’। কিন্তু বাস্তবতা হলো কেবল গাছ লাগিয়ে পরিবেশ বাঁচানো সম্ভব নয়। স্লোগান হওয়া উচিত, ‘গাছ লাগান, গাছ বাঁচান ও পরিবেশ বাঁচান।’
সম্প্রতি সাজ্জাদুজ্জামান সজল নামের একজন ফরেস্ট কর্মকর্তাকে বনখেকোরা কক্সবাজারে সংরক্ষিত বনের গাছ কাটায় বাধা দেওয়ায় নির্মমভাবে হত্যা করে। এ ছাড়া দেশের নানা প্রান্তে বন বিভাগের কর্মীদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে। জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে বনভূমির রয়েছে গভীর সম্পর্ক। স্থলজ জীববৈচিত্র্যের ৮০ ভাগের উৎস হলো বন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণেও বনভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সম্প্রতি রিমালের আঘাতে সুন্দরবনের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, যা কাটাতে দীর্ঘদিন লাগবে। এর আগে সেখানে অগ্নিকাণ্ডেও ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
বন বিভাগের দেওয়া তথ্যমতে, ২০০৭ সালে সিডরের পর সুন্দরবনে ৪০টি হরিণ, ১টি বাঘ ও ১টি তিমির মরদেহ পাওয়া যায়। ২০০৯-এ ঘূর্ণিঝড় আইলার পর ৩টি হরিণ ও ১টি শূকরের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। ২০১৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত হওয়া ঘূর্ণিঝড়গুলোতে বাঘ, হরিণসহ অন্য কোনো বন্য প্রাণীর ক্ষতি হয়নি। ২০২১ সালের ঘূর্ণিঝড় ইয়াসে চারটি হরিণের মরদেহ পাওয়া যায়। এবার রিমালের প্রভাবে কমপক্ষে শতাধিক হরিণ, বুনো শূকরসহ অন্যান্য বন্য প্রাণীর মৃত্যু হয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রত্যক্ষ প্রভাবেই বঙ্গোপসাগর-সংলগ্ন এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা ও ক্ষয়ক্ষতি বাড়ছে বলে ধরে নেওয়া যায়।
পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণকে বর্তমান সরকার শুধু গুরুত্বই দেয়নি দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধানেও অন্তর্ভুক্ত করেছে। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।’
এ ছাড়া পরিবেশ সংরক্ষণে অসংখ্য আইন প্রণয়ন করা হয়েছে। গড়ে তোলা হয়েছে জাতীয় উদ্যান, সাফারি পার্ক, অভয়ারণ্য। এমনকি পরিবেশ আদালত পর্যন্ত রয়েছে। তবু বৃক্ষনিধন, কৃষিভূমির অপব্যবহার, ভূমিদস্যুতা, জীবের প্রতি সহিংসতা, নদীদূষণ, বায়ুদূষণ থেমে নেই।
করোনাকালে পরিবেশ দূষণ অনেকাংশেই কমে গিয়েছিল। কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতেও ফিরে এসেছিল ডলফিন। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন ও গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের ওপর বাংলাদেশের তেমন কোনো হাত নেই। কিন্তু এর সবচেয়ে বড় শিকার হলো বাংলাদেশ। আসন্ন বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্ব মোড়লদের কাছ থেকে অধিকার ও ক্ষতিপূরণ আদায়ে জলবায়ু কূটনীতি জোরদার করতে হবে। একটি সুন্দর বাসযোগ্য পৃথিবীর জন্য সবাই একযোগে কাজ করার কোনো বিকল্প নেই।
*লেখক: মো. রিয়াদুল আহসান নিপু, ইউনিভার্সিটি অব ঢাকা এনভায়রনমেন্টাল ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা, বর্তমানে অগ্রণী ব্যাংকে কর্মরত
**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]