আমজনতার আম বলে কথা
‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিমানের বিবেচনায় আম বিশ্বব্যাপী একটি আদর্শ ফল হিসেবে পরিচিত। আম খেতে ভালোবাসে না, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া দায়। পৃথিবীর সব দেশে আম নেই, কিন্তু একবার যে এই আমের স্বাদ পেয়েছে, তার পক্ষে একে ভোলা অসম্ভব। আম এখন গ্রাম, নগরের হাটবাজারজুড়ে, বিশেষ করে আমবাগানগুলো ম–ম করছে আমের গন্ধে। আম ছাড়া গ্রীষ্মকাল যেন কল্পনাই করা যায় না।
আম ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রাচীন ফল। প্রাচীন ভারতের বহুবিধ ধর্মীয়, সামাজিক ও সংস্কৃতি সাহিত্যের প্রমাণ অনুসারে এর আদি জন্মভূমি ভারতীয় উপমহাদেশে। রামায়ণের অনেক শ্লোকে আমের উল্লেখ রয়েছে। এই ফল ভারতের বৈদিক ধর্মের সঙ্গেও অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কিত। অনেকে দাবি করেন, আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে ভারতে প্রথম আম উৎপাদিত হয়। তবে তিন হাজার বছর আগের বৃহদারণ্যক উপনিষদে প্রথম আমের উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রায়ই শোনা যায়, মিয়ানমারসংলগ্ন ভারতের উত্তর-পূর্বের পার্বত্য অঞ্চল আমের প্রধান উৎসস্থল। বৌদ্ধরা আম অত্যন্ত পছন্দ করে। তারা এই ফল পবিত্র মনে করে। কারণ, তাদের ধারণা, গৌতম বুদ্ধ প্রায়ই আমবাগানে বিশ্রাম নিতেন। এ ছাড়া বৌদ্ধদের ধর্মীয় অনুষ্ঠানে আম্রপল্লবের ব্যবহার হয়ে আসছে দুই হাজার বছর ধরে। খ্রিষ্টপূর্ব ৩২৭ সালে মহাবীর আলেকজান্ডার সিন্ধু উপত্যকায় এসে আমবাগান ও আমের সঙ্গে পরিচিত হন। শোনা যায়, মিষ্টি সুস্বাদু এই ফল আলেকজান্ডারের অত্যন্ত পছন্দ হয়। তাই গ্রিসে ফেরার সময় তিনি বেশ কিছু আম সঙ্গে নিয়ে যান।
আম শব্দটি সংস্কৃত ভাষা থেকে এসেছে। সংস্কৃত ভাষায় আমকে আম্র, বাংলায় আম, তামিলে মাঙ্গা এবং ইংরেজিতে ম্যাঙ্গো বলা হয়। অনেকের মতে, ইংরেজি ম্যাঙ্গো নামের উৎপত্তি নাকি তামিলের মাঙ্গাই থেকে। শুরুতে তামিল ভাষায় আমকে ‘আম-কায়’ নামে অভিহিত করা হতো। পরে তা ‘মাম-কায়’ নামে পরিচিত হয়। তারপর তার নাম হয় মাঙ্গা। ইংরেজ ভাষা ব্যবহারকারীদের মতোই পর্তুগিজরা শেষমেশ ম্যাঙ্গো নামকরণ করে, যা পরবর্তী সময়ে বিখ্যাত হয়। ‘আ হিস্টোরিক্যাল ডিকশনারি অব ইন্ডিয়ান ফুড’ অনুসারে পর্তুগিজরা ভারতে প্রথম আমের চাষ শুরু করে। অন্য তথ্যমতে, যখন ব্রিটিশরা পনেরো ও ষোলো শতকের দিকে দক্ষিণ ভারতের সঙ্গে ব্যবসা শুরু করে, তখন ম্যাঙ্গো শব্দটির জন্ম। তারা ফেরত যাওয়ার সময় আমের বীজ সংগ্রহ করে নিয়ে যায় এবং বিভিন্ন দেশে তা ছড়িয়ে দেয়। এভাবেই দেশ-বিদেশে আমের ফলন শুরু হয়।
আমকে বিভিন্নজন বিভিন্ন নামে অভিহিত করেন। যেমন শ্রীকৃষ্ণকীর্তনে এই আমকে আমতু, ভারতচন্দ্রের রচনায় আম, ঈশ্বর গুপ্তের লেখায় আঁব এবং মাইকেল মধুসূদনের লেখায় রসাল বলে অভিহিত করা হয়েছে। জানা যায়, মোগলদের সুবাদে ভারতীয় উপমহাদেশে আম খ্যাতি পেয়েছে। মোগল সাম্রাজ্যে আম শুধু রাজপরিবারের বাগানেই চাষ করার অনুমতি ছিল। আমজনতার সেই আম চেখে দেখার সুযোগ হতো না বললেই চলে। তবে সম্রাট শাহজাহানের শাসনামল থেকে আমজনতাও আমের স্বাদ উপভোগ করার অধিকার পায়। তাঁর ঘোষণায় সাধারণের বাগানেও শুরু হয় আমের ফলন। এ ছাড়া জানা গেছে, সম্রাট জাহাঙ্গীর আমের অত্যন্ত ভক্ত ছিলেন। ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলায় আমের ফলন ভালো হয়। সেখানকার আমের চাহিদাও বাজারে অনেক বেশি। জানা যায়, আকবরের শাসনামলে মুর্শিদাবাদের বিভিন্ন আমবাগানে দুষ্প্রাপ্য ২০০ প্রজাতির আমের ফলন হতো। সম্রাট আকবরই প্রথম আমের গুণে সরকারি সিলমোহর দেন। তিনিই দ্বারভাঙার কাছে ‘লাখবাগ’ বাগানে নানা প্রজাতির এক লাখ আমের চারা লাগান। তাঁরই উদ্যোগে ১৫৯০ খ্রিষ্টাব্দে ‘আইন-ই-আকবরি’তে আমের প্রজাতি-বিচিত্র লিপিবদ্ধ করা হয়। পরবর্তী সময়ে নবাব সিরাজউদ্দৌল্লা ও মুর্শিদ কুলি খাঁ দুজনেই ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে দুষ্প্রাপ্য প্রজাতির চারা এনে গড়ে তোলেন বিশাল সব আমবাগান। সে সময়ে ভারতে আমকে সমৃদ্ধির প্রতীক হিসেবে মনে করা হতো। ফলে রাজা–বাদশাহরা রাস্তার ধারে আমগাছ লাগাতেন বলে চীনা পরিব্রাজক ইউয়েন সাংয়ের লেখা থেকে জানা যায়। পারস্যের কবি আমির খসরুও আমকে ভারতের সেরা ফলের আখ্যা দিয়েছেন।
ভারত, পাকিস্তান, হাইতি ও ফিলিপাইনের জাতীয় ফল আম। বাংলাদেশের জাতীয় ফল কাঁঠাল হলেও ফলের রাজা আম। আর দেশের জাতীয় বৃক্ষ আমগাছ। উৎপাদন ও বাণিজ্যের বিচারে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় ফল আম। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, বাংলাদেশের মাথাপিছু আম উৎপাদনের পরিমাণ দেড় কেজির মতো। ভারতে মাথাপিছু ১১ কেজি, পাকিস্তানে ৬, ইন্দোনেশিয়ায় ৯, ফিলিপাইনে ৬, তানজানিয়ায় ৭, সুদানে ৭ দশমিক ৫, জায়ারে ৫ ও হাইতিতে ৫৫ কেজি।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, প্রতিবছর সারা বিশ্বে প্রায় ৪৬ মিলিয়ন টন আম উৎপন্ন হয়। এর মধ্যে ভারতে বছরে ১৮ মিলিয়ন টন আম উৎপন্ন হয়, যা বিশ্বের মোট আম উৎপাদনের ৪০ শতাংশ। জানা যায়, ১৯৪৫ সালের আগপর্যন্ত পৃথিবীর মোট আম উৎপাদনের বেশির ভাগ এ দেশে উৎপাদিত হতো। ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশ আম উৎপাদনে চতুর্থ স্থানে ছিল। ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও ব্রাজিলের পরই ছিল এ দেশের স্থান। বর্তমানে বাংলাদেশের স্থান ১৫ থেকে ১৬টি দেশের নিচে। দেশে বাণিজ্যিক পণ্য আমের বছরে উৎপাদন প্রায় ২৫ লাখ টন। আমের উৎপাদন ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আগামী কয়েক বছরের মধ্যে বাড়তি লাখ লাখ টন যোগ হবে বলে আশা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, রাজশাহী, দিনাজপুর, মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, সাতক্ষীরা ও যশোর আম চাষের শীর্ষে অবস্থান করছে। ইতিমধ্যে দেশের ৪০টি জেলায় বাণিজ্যিকভাবে আমের বাগান গড়ে উঠেছে। রংপুরের হাঁড়িভাঙ্গা, দিনাজপুরের ফজলি ও সাতক্ষীরার আম এ দেশের বাজার দখল করে আছে। অর্থনীতিতে সার্বিকভাবে বাড়ছে আমের অবদান। বর্তমানে আরব আমিরাত, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, ওমান, ইতালি, জার্মানি ও যুক্তরাজ্যের বাজারে বাংলাদেশ থেকে ফজলি, হিমসাগর ও ল্যাংড়া আম রপ্তানি হলেও আরও অনেক দেশে রপ্তানির বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।
বাঙালির খাদ্যসংস্কৃতিতে আম শুধু একটি ফল নয়, বরং একটি সংস্কৃতির অনুষঙ্গ। আম-সংস্কৃতি বাঙালি জীবনের নানা কর্মকাণ্ডের মধ্যে মিশে একাকার হয়ে আছে। আমরা লক্ষ করি, আম উৎপাদনকারী দেশ বা নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চলের মানুষের নিজ নিজ এলাকায় উৎপাদিত উৎকৃষ্ট জাতের আম নিয়ে গর্বের শেষ নেই। এরূপ ভাবনা এসেছে আঞ্চলিকতা, জাতীয়তাবোধ ও সর্বোপরি দেশাত্মবোধ থেকে। বাংলাদেশে এমন মানুষের সংখ্যা খুব কম নয়, যাঁরা বিশ্বাস করেন, দেশের ফজলি, ল্যাংড়া, ক্ষীরশাপাত—এগুলোই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আম।
আম বাঙালির প্রিয় খাবার। পরিপক্ব আমই শুধু বাঙালি খায় না; মুকুল থেকে খাওয়া শুরু হয়। তারপর কাঁচা ও পাকা আম দিয়ে তৈরি হয় বিভিন্ন ধরনের খাবার। কাঁচা আমে তৈরি আচার বা চাটনি হচ্ছে বাঙালি জীবনের আরেক অধ্যায়ের নাম। পরিপক্ব কাঁচা আম সরু ফালি করে কেটে রোদে শুকিয়ে সংরক্ষণ করে আমচুর তৈরি করা হয়। শুধু বিভিন্ন খাবার নয়, আম দিয়ে পানীয়ও তৈরি হয়। শহরের বিভিন্ন জুস বারে গ্রিন ম্যাঙ্গো জুস, আমের লাচ্ছি পান করার অভিজ্ঞতা রয়েছে বাঙালির। আমদুধ এখনো খাওয়া হয় কোনো কোনো পরিবারে। এই বল-বীর্যবর্ধক আমদুধের কারণেই আমের আরেক নাম ‘সোমধারা’। এ ছাড়া আমডাল, পান্তাভাতে আম খাওয়া বাঙালি সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য। আর পাকা আম তো আম-মুড়ি, জেলি, কেক, আইসক্রিম, পায়েস, পুডিং ও মিষ্টির মতো নানা রকমের খাবার বানানো হয়।
বাঙালি সমাজে গ্রীষ্মকালে গ্রামাঞ্চলে আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে আম পাঠানো হয়। জামাইবাড়িতে আম–দুধ পাঠানো একটা অলিখিত রীতি। অনেক সময় মেয়ে ও জামাইকে বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে আনা হয়। আবার জামাইষষ্ঠী বাংলার লোকসংস্কৃতির অংশ। জ্যৈষ্ঠ মাসে শুক্লপক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে হিন্দু বাঙালি রমণীরা বিশেষ করে শাশুড়িরা ষষ্ঠীব্রত পালন করেন। এই ষষ্ঠীব্রত উপলক্ষে জামাইকে দেওয়া সংবর্ধনাই মূলত জামাইষষ্ঠী। প্রথাটি দেশের গ্রামে ও শহরের ঘরে ঘরে খুব ঘটা করে পালিত হয়। এ পার্বণে যেমন বিভিন্ন গাছের ডাল প্রয়োজন হয়, তেমনি সনাতন পরিবারে মৌসুমি ফল দরকার হয়। জামাইষষ্ঠীতে জামাই খালি হাতে শ্বশুরবাড়ি আসেন না। জামাকাপড়, আম, জাম, কাঁঠাল, লিচু, পেয়ারা, বাঙ্গি, তরমুজ ইত্যাদি থাকে জামাইয়ের বাজারের তালিকায়। অনেকে এই মৌসুমে আত্মীয়স্বজন বা বন্ধুবান্ধবের বাড়ি বেড়াতে গেলে মিষ্টির পরিবর্তে আম দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া অফিস–আদালতের নাশতার টেবিলে অন্যান্য খাবারের সঙ্গে আম থাকে। আবার কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফলোৎসবের আয়োজন করা হয়, যার প্রধান উপাদান থাকে আম। এ ছাড়া কোনো কাজ বা তদবিরে আমের ব্যবহার চোখে পড়ে। আমজনতার আম নিয়ে এমন হাজারো প্রবন্ধ লিখলেও শেষ হবে না আমকাহিনি।
* লেখক: সহযোগী অধ্যাপক ও প্রধান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর