একটি তিক্ত ও ভয়াবহ অভিজ্ঞতার গল্প
আমার মা কিছুদিন ধরে অসুস্থ। অসুস্থ মানে একেবারেই শয্যাশায়ী। বাসা-হাসপাতাল, হাসপাতাল-বাসা করছি। আমার ভাই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, থাকেন ইংল্যান্ডে। মায়ের অবস্থার অবনতি দেখে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দেশে আসার। মা এত দিন ছিলেন আমার বাসায়। এবার যাবেন নিজের বাসায়। যেহেতু উঠতে বা হাঁটতে পারছেন না, নিতে হবে অ্যাম্বুলেন্সে। হাসপাতালে নেওয়া ও বাসায় আনার জন্য সব সময় হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সই ব্যবহার করি এবং প্রতিবারই সন্তোষজনক সেবা পাই। এবার রোগী এক বাসা থেকে আরেক বাসায় নিয়ে যাব, তাই হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স ডাকলাম না। একটি অনলাইন অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসে যোগাযোগ করলাম। আমার মা যেহেতু বয়স্ক, প্রথম চাহিদা ছিল একটি ভালো গাড়ি, ভালো স্ট্রেচার এবং একজন ভালো ও অভিজ্ঞ চালক। কোম্পানি আমাকে নিশ্চিত করল, গাড়ি ও স্ট্রেচার প্রায় নতুন এবং তাদের চালকও অনেক অভিজ্ঞ। কোম্পানির মালিকের কথাবার্তায় তুষ্ট হয়ে কিছু বেশি রেটেই তাদের গাড়ি ঠিক করলাম।
পরদিন নির্ধারিত সময় পার হয়ে যাওয়ায় কয়েকবার ফোন করলাম। অবশেষে গাড়ি এল। স্ট্রেচার বাড়ির দরজায় এলে ‘প্রায় নতুন’ স্ট্রেচারের অবস্থা দেখে আঁতকে উঠলাম। এ যদি হয় প্রায় নতুন স্ট্রেচারের অবস্থা, পুরোনোগুলোর অবস্থা না জানি কত করুণ!
ভীতসন্ত্রস্ত, হতবিহ্বল, অসহায় আমি হন্যে হয়ে রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ খুঁজছি। আশ্চর্য ব্যাপার, পুরো রাস্তায় একজন ডিউটি পুলিশও দেখতে পেলাম না। এবার ৯৯৯–এ ফোন করলাম।
আল্লাহর নাম নিয়ে মাকে নিয়ে রওনা হলাম। গাড়িতে উঠেই আমি চালককে পরিষ্কারভাবে গন্তব্যের দিক নির্দেশনা দিয়েছি। চালকের সহকারীও তাকে বুঝিয়ে বলল কোন পথে, কীভাবে যেতে হবে। চালকের বয়স ২৫ থেকে ৩০–এর মধ্যে। চেহারায় সবজান্তা ভাব। সে গাড়ি চালানো শুরু করতেই বুঝতে পারলাম, কোম্পানির মালিক খুব মিথ্যে বলেননি। গাড়ি ও স্ট্রেচার নতুন না হলেও তাঁদের চালক একেবারেই নতুন। কিছুটা পথ যেয়ে হঠাৎই চোখের নিমেষে সে গাড়ি নিয়ে গেল ভুল রাস্তায়। হতচকিত আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম সে এ রাস্তায় গেল কেন? নির্লিপ্ত উত্তর এল, ওই দিকের রাস্তা ভাঙা! রাস্তা সম্পর্কে তার জ্ঞানের পরিধি সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা পাওয়া গেল। এবার সে উল্টো রাস্তায় তার পঙ্খিরাজ নিয়ে উড়াল দিল এবং মুহূর্তকাল বিলম্ব না করে সামনের একটি পিকআপ ভ্যানকে জোরে দিল এক ধাক্কা। পিকআপ ভ্যান গিয়ে আঘাত করল সামনে পার্ক করে রাখা একটি প্রাইভেট কারকে। আর যায় কোথায়! পিকআপ ভ্যান ও প্রাইভেট কারের চালক একসঙ্গে নেমে এসে আটকে দিল অ্যাম্বুলেন্সের পথ। কথা–কাটাকাটি, যুক্তিতর্ক, গালাগাল রূপ নিল মল্লযুদ্ধে। কেহ কারে নাহি ছাড়ে সমানে সমান! আমি ও আমার যাত্রাসঙ্গী ব্যাকুল হয়ে তাদের অনুরোধ করতে থাকি গাড়ি ছেড়ে দেওয়ার জন্য, কিন্তু কে শোনে কার কথা! আমার মায়ের অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছি। জীবনে আর কখনো এত অসহায়, এত অনিরাপদ বোধ করিনি। রাস্তায় প্রচুর লোক জমে গেছে এরই মধ্যে। ঝগড়া থামানোর চেয়ে ঝগড়া দেখাতেই তাদের আগ্রহ বেশি। কেউ কেউ অ্যাম্বুলেন্সের জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখে যাচ্ছে নীরব শুয়ে থাকা আমার মাকে। রাস্তায় পথচারী দর্শকদের কাছে গিয়েও কাকুতি–মিনতি করছি তারা যেন অ্যাম্বুলেন্সটি ছাড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে। দু–চার জন্য নিজেদের গা বাঁচিয়ে কিছুটা চেষ্টা হয়তো করল, কিন্তু তাতে কেউই কোনো কর্ণপাত করল না। পিকআপের চালক অ্যাম্বুলেন্সের সামনে সটান দাঁড়ানো, গাড়ি ছাড়লে তার ওপর দিয়েই যেতে হবে। ভীতসন্ত্রস্ত, হতবিহ্বল, অসহায় আমি হন্যে হয়ে রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশ খুঁজছি। আশ্চর্য ব্যাপার, পুরো রাস্তায় একজন ডিউটি পুলিশও দেখতে পেলাম না। এবার ৯৯৯–এ ফোন করলাম। ও পাশ থেকে কেউ একজন হ্যালো বলতেই আমি তাঁকে সব খুলে বললাম। সব শুনে উনি বললেন, আমি যে এলাকায় আছি তিনি ওই এলাকার থানায় জানিয়ে দেবেন এবং ওই এলাকার থানা থেকে কেউ একজন আমাকে ফোন দেবেন। ততক্ষণ আমি যেন একটু ধৈর্য নিয়ে অপেক্ষা করি। ধৈর্য ধরার শিক্ষা দেওয়ার জন্য আমাদের দেশের দায়িত্বপ্রাপ্তদের একটি বিশাল অংশকে অবশ্যই পুরস্কৃত করা যেতে পারে! আমার তখন আর ধৈর্য ধারণ করার মতো অবস্থা নেই। দুপুরের তপ্ত রোদে অ্যাম্বুলেন্স গরম হয়ে তাপ ছড়িয়ে পড়ছে ভেতরে। এসির বাতাসেও মায়ের শরীর ঘেমে যাচ্ছে। আমি ভয়ে ও আতঙ্কে একবার অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে গিয়ে মাকে দেখছি, আবার পর মুহূর্তে রাস্তায় নেমে উন্মত্ত তিন চালককে একটা দফারফায় আসার ব্যর্থ প্রয়াস চালাচ্ছি। তিনজনই তাদের দাবিতে অনড়। পিকআপ ও প্রাইভেট কারচালক ক্ষতিপূরণ বা অ্যাম্বুলেন্সের কাগজপত্র না নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সকে এক পা এগোতে দেবে না। অ্যাম্বুলেন্সচালক কোম্পানির মালিক না আসা পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না। ৯৯৯–এ কিছুক্ষণ পরপর ফোন করছি। সেখানেও আশাহীন একই বাণী, ‘একটু অপেক্ষা করুন, দেখি কী করতে পারি!’ এভাবে কেটে গেল প্রায় এক ঘণ্টা।
প্রাইভেট কারচালক জানান, তার ম্যাডাম গাড়িতে একা বসে আছেন। একজন নারী মালিকের নিরাপত্তা নিয়ে তার বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ নেই। গাড়ির ক্ষতিপূরণের চেয়েও মারামারির আনন্দটাই তার কাছে বেশি বলে মনে হলো। রাগে–দুঃখে ও ক্ষোভে ফেটে পড়ে ভাবছি, আমার অসুস্থ বৃদ্ধ মা আর আমরা তিনজন অবিবেচক ও অশিক্ষিত চালকের হাতে জিম্মি! এদের মধ্যে শিক্ষা, মানবিকতা, সদাচরণ, বিবেকের কত অভাব! কাদের হাতে আমরা দেব দেশরক্ষার ভার? পথচারীদের মধ্যেও একজন দায়িত্বশীল নাগরিকের দেখা মিলল না। শেষ পর্যন্ত মরিয়া আমি পিকআপচালক ও প্রাইভেট কারচালককে বললাম, অ্যাম্বুলেন্সে উঠে আসতে, আমাদের গন্তব্যে নামিয়ে তারা তাদের মীমাংসা করুক। এ প্রস্তাবে তিন চালক এবার রাজি হলো। বাড়তি দুজনের অ্যাম্বুলেন্সে জায়গা সংকুলান হয় না। পিকআপচালক সামনের সিটে বসে পড়ল আগেভাগে, প্রাইভেট কারচালক অ্যাম্বুলেন্সের দরজায় ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অ্যাম্বুলেন্স এবার ঝড়ের গতিতে ছুটে চলল। কারওয়ান বাজার থেকে বাংলামোটর যাওয়ার পর প্রাইভেট কারচালক বলল, তাকে ওখানে নামিয়ে দিতে, তার মালিক ম্যাডাম অত্যধিক রাগ করছেন এতক্ষণ গাড়িতে একা বসিয়ে রাখার জন্য। আমি শুধু নীরবে দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। নিজের কাণ্ডজ্ঞানহীন চালক নিয়ে বাইরে বের হওয়া কতটা অনিরাপদ তাই ভাবছিলাম। অ্যাম্বুলেন্স ইস্কাটনে আসার পর দেখা মিলল তাদের কোম্পানির মালিকদের। আল্লাহর অশেষ কৃপায় এবার তাদের হাত থেকে রক্ষা পেলাম।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
প্রায় দেড় ঘণ্টা রুদ্ধশ্বাস নাটকের পর মাকে নিয়ে মায়ের বাসায় এসে পৌঁছালাম। এরও দুই ঘণ্টা পর ফোন পেলাম ৯৯৯ থেকে—‘কীভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’ উত্তরে ম্লান স্বরে শুধু বললাম, আজকের মতো আপনাদের সাহায্য ছাড়াই বিপদ থেকে পরিত্রাণ পেয়েছি। দয়া করে তাঁরা যেন আরেকটু দ্রুততার সঙ্গে নাগরিক সেবা দান করেন, সেই অনুরোধ জানালাম। জানি না আমার মতো নগণ্য এক নাগরিকের অনুরোধ তাঁদের মনের কোনায় স্থান পেল কি না! আমি শুধু ভাবছি, আমরা রাস্তায় কবে নিরাপদ হব? আদৌ কি কোনো দিন নিরাপদ হতে পারব?