সলঙ্গা দিবস: বাংলার জালিয়ানওয়ালাবাগ
সলঙ্গা এক ঐতিহাসিক ঘটনার সাক্ষী। আজ থেকে ১০৩ বছর আগে ১৯২২ সালের ২৭ জানুয়ারি তৎকালীন পাবনা (বর্তমান সিরাজগঞ্জ) জেলার রায়গঞ্জ উপজেলার সলঙ্গা (বর্তমানে এটি থানা) নামক স্থানে এক মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়। এদিনে ঔপনিবেশিক ব্রিটিশ বাহিনীর নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষের যে দুর্বার গণবিদ্রোহ ঘটে, তার নজির উপমহাদেশে বিরল। ইতিহাসে দিনটি ঐতিহাসিক ‘সলঙ্গা দিবস’ বা ‘সলঙ্গা গণহত্যা দিবস’ নামে পরিচিত।
এ কথা সবারই জানা যে ব্রিটিশ শাসনামলে সাম্রাজ্যবাদী অসহযোগ আন্দোলন ও খেলাফত আন্দোলনে জনতা উদ্বেলিত হয়ে বিলেতি পণ্য বর্জন ও স্বদেশি পণ্য ব্যবহার শুরু করে। দীর্ঘ ১৯০ বছর ধরে দখলদার ব্রিটিশ সরকারের শাসন ও শোষণ থেকে মুক্তিলাভের আকাঙ্ক্ষায় বিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে তৎকালীন ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে দুর্বার গণ–আন্দোলন গড়ে ওঠে। পুরো ভারতবর্ষে মহাত্মা গান্ধীর ডাকে তখন অসহযোগ আন্দোলন চলছিল। ‘বিলেতি পণ্য বর্জন কর’—ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের এই কর্মসূচি নিয়ে সাধারণ মানুষ শরিক হয়েছিল এই সংগ্রামে। বিলেতি কাপড় ও বিলেতি লবণ ব্যবহারের পরিবর্তে চরকায় কাটা মোটা সুতায় তৈরি কাপড় এবং দেশি লবণ না পেলে কলাগাছের ছাই চোয়ানো পানি এবং বিলেতি সাবান ও সোডার পরিবর্তে কলাগাছের ছাই অথবা কাঁঠালের মুচি পোড়ানো ছাই ব্যবহার, সুযোগমতো ইংরেজ ও তাদের দোসরদের শাস্তি দান প্রভৃতির মধ্য দিয়ে বিদেশি শাসন উৎখাত করে দেশীয় শাসন কায়েমই ছিল এ আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য। যার ঢেউ এসে আছড়ে পড়ে সিরাজগঞ্জের সলঙ্গায়ও। সে সময়ে সলঙ্গা একটি ব্যবসা-বাণিজ্যে সমৃদ্ধ জনপদ ছিল। সেখানে সপ্তাহে দুই দিন (সোম ও বৃহস্পতিবার) হাট বসত। ১৯২২ সালের ২৭ জানুয়ারি সলঙ্গা হাটে কংগ্রেসের তৎকালীন যুবনেতা মাওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশের নেতৃত্বে অসহযোগ আন্দোলনের শত শত কর্মী ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী বিলেতি পণ্য বর্জনের জন্য সাধারণ মানুষকে উৎসাহিত করেছিল। সেদিন এ আন্দোলনের অংশ হিসেবে মাওলানা তর্কবাগীশের নেতৃত্বে অসহযোগ ও খেলাফত আন্দোলনের কর্মীরা হাটে নেমেছিলেন। উদ্দেশ্য, ব্রিটিশ পণ্য ক্রয়-বিক্রয় বন্ধ করা। ‘সলঙ্গা হাটে বিলেতি পণ্য বেচাকেনা চলবে না, সলঙ্গার হাট হবে কেবল স্বদেশি পণ্যের হাট’—এই ছিল স্লোগান। গোয়েন্দা বিভাগের গোপনসূত্রের ভিত্তিতে এ আন্দোলন রুখতে ছুটে আসেন তৎকালীন পাবনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আর এন দাস, জেলা পুলিশ সুপার ও সিরাজগঞ্জের মহুকুমা প্রশাসক এস কে সিংহসহ ৪০ জন সশস্ত্র লাল পাগড়ি পরা পুলিশ। উল্লেখ্য, এর দুই দিন আগে শনিবার রায়গঞ্জের চান্দাইকোনা হাটে স্বেচ্ছাসেবকেরা ব্রিটিশ পণ্য বর্জনে ব্যবসায়ী ও জনতাকে উদ্বুদ্ধ করছিলেন। পুলিশ তাতে বাধা দেয়। এ কারণে জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে পুলিশের রাইফেল কেড়ে নিয়ে ফুলজোড় নদে ফেলে দেয়। সেদিন কমসংখ্যক পুলিশ থাকায় তারা পিছু হটে। এ ঘটনায় পুলিশ ও প্রশাসন আগে থেকেই ক্ষিপ্ত ছিল। ওই ঘটনার জেরে তারা সেদিন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে সলঙ্গার হাটে আসে। তাদের সদম্ভ ও মারমুখী উপস্থিতি স্বেচ্ছাসেবক ও জনতার মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি করে।
সে সময় সলঙ্গা গোহাটায় ছিল বিপ্লবী স্বদেশি কর্মীদের অফিস। পুলিশ এসে প্রথমে কংগ্রেস অফিস ঘেরাও করে মাওলানা তর্কবাগীশকে গ্রেপ্তার করে। এরপর তাঁকে হাটের দক্ষিণ দিকে নিয়ে যায়। পুলিশ সুপার নিজে তাঁর ওপর দৈহিক নির্যাতন চালান। নির্যাতনে তর্কবাগীশের নাক, কান ও শরীরের বিভিন্ন অংশ ক্ষতবিক্ষত হয়ে রক্ত ঝরতে থাকে। একপর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এ অবস্থায় তাঁকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার সময় একজন গরু ব্যবসায়ী তাঁর হাতের লাঠি দিয়ে পুলিশ সুপারের মাথায় আঘাত করেন। ফলে পুলিশ সুপারের মাথা ফেটে রক্ত ঝরে এবং একপর্যায়ে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন।
কিছুক্ষণের মধ্যে মাওলানা তর্কবাগীশকে ব্রিটিশ সেনা ও পুলিশ পিটিয়ে মেরে ফেলেছে—এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে হাজারো হাটুরে, গঞ্জের ব্যাপারী লাঠিসোঁটা আর গবাদিপশু তাড়ানোর লাঠি নিয়ে একত্র হন। অবস্থা আঁচ করতে পেরে আহত মাওলানা তর্কবাগীশ উঠে দাঁড়িয়ে ‘তিনি মারা যাননি’ এ কথা বলে আন্দোলরত জনতাকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতেও উত্তেজিত জনতার ক্ষোভ প্রশমিত হয়নি। সঙ্গে সঙ্গে তারা বিক্ষোভ মিছিল বের করে। জনতার ঢল ও আক্রোশের মুখে ব্রিটিশ বেনিয়া বাহিনীকে মারমুখী জনতার কবল থেকে রক্ষা করার জন্য অসহযোগের পক্ষে আন্দোলনরত কর্মীদের ওপর পুলিশ গুলিবর্ষণ ও লাঠিচার্জ করে। ৪০ জন পুলিশের মধ্যে মাত্র একজনের রাইফেল থেকে কোনো গুলি বের হয়নি। জানা যায়, তিনি ছিলেন একজন ব্রাহ্মণ। এ ঘটনায় হতাহতের সরকারি সংখ্যা ৪ হাজার ৫০০ দেখানো হলেও বেসরকারি হিসাবে সেদিন ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ হতাহত হয়েছিলেন। অন্য এক তথ্যমতে, ওই দিন প্রায় ১ হাজার ২০০ প্রতিবাদী মানুষ ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনীর হাতে প্রাণ হারান। নিহত ব্যক্তিদের লাশের সঙ্গে আহত সংজ্ঞাহীন ব্যক্তিদেরও গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে ব্রিটিশ পুলিশ সিরাজগঞ্জের রহমতগঞ্জে গণকবর দেয়। সলঙ্গা এলাকাটি মুসলিম–অধ্যুষিত হওয়ায় সেদিনের ঘটনায় যাঁরা নিহত ও আহত হন, তাঁদের প্রায় ৯৮ শতাংশই ছিলেন মুসলিম। এ হত্যাকাণ্ডের পর তৎকালীন খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলনের প্রথম সারির নেতারাও ছুটে আসেন সলঙ্গায়। পাশাপাশি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাগুলো মেডিকেল টিম নিয়ে ছুটে আসে। তৎকালীন বিভিন্ন স্থানীয় ও জাতীয় পত্রপত্রিকায় এ ঘটনার বিশদ বিবরণও গুরুত্বসহকারে ছাপা হয়। সলঙ্গা হত্যাকাণ্ডের খবর শুনে মহাত্মা গান্ধী মাওলানা তর্কবাগীশকে পাঠানো এক জরুরি বার্তায় ঘটনার তীব্র নিন্দা জানান এবং একে বাংলার জালিয়ানওয়ালাবাগ বলে আখ্যায়িত করেন।
প্রসঙ্গত, ১৯১৯ সালের মার্চ মাসে পূর্ব পাঞ্জাবে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম ছিল তুঙ্গে। সেখানকার দুজন জাতীয়তাবাদী নেতাকে ব্রিটিশ শাসকেরা ওই বছরের ১০ এপ্রিল বহিষ্কার আদেশ প্রদান করেন। এরই প্রেক্ষাপটে কিছু নিরস্ত্র জনতা সেখানকার ডেপুটি কমিশনারের বাংলোতে নীরব প্রতিবাদ জানাতে গেলে ব্রিটিশ সৈন্যদের গুলিতে ১১ জনের মৃত্যু হয়। এ খবর ছড়িয়ে পড়ায় জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে শহরে ভাংচুর ও লুটপাট চালায় এবং দুটি ব্যাংকের ব্রিটিশ ম্যানেজার ও কর্মচারীদের হত্যা করে। কয়েকটি সরকারি অফিস ও কোতোয়ালি থানা জ্বালিয়ে দেওয়ার মতো উদ্যোগও নেয়। এমতাবস্থায় বিক্ষুব্ধ জনতাকে আয়ত্তে আনার জন্য রাজনৈতিক নেতারা ১৪ এপ্রিল জালিয়ানওয়ালাবাগে এক সাধারণ সভা আহ্বান করেন। কিন্তু ১৩ এপ্রিল রাতে সব শহরে সান্ধ্য আইন জারির প্রেক্ষাপটে ১৪ তারিখের সভা অনুষ্ঠিত হবে কি না, তা নিয়ে রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে তর্কাতর্কি চলাকালীন কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছার আগেই খবর আসে হাজার হাজার জনতা জালিয়ানাওয়ালাবাগ উদ্যানে সমবেত হতে শুরু করেছে। এমতাবস্থায় সভার কাজ চালু রাখা হয়। সভা চলাকালীন কোনো সতর্কবাণী ছাড়াই ব্রিটিশ জেনারেল ডায়ারের নেতৃত্বে ব্রিটিশ বাহিনী সভাস্থলে এলোপাতাড়ি গুলিবর্ষণ ও কারফিউ জারি করে। এ কারণে অনেক আহত ব্যক্তিও চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে মৃত্যুরও কোলে ঢলে পড়েন। এ ঘটনায় সরকারি হিসাবমতে, ৩৭৯ জন নিহত ও ১ হাজার ২০০ জন আহত হন। কিন্তু বেসরকারি হিসাবমতে, এ হত্যাযজ্ঞে প্রায় ১০০০ মানুষ নিহত ও ১ হাজার ৫০০ মানুষ আহত হন। তদন্ত কমিশন হত্যাকাণ্ডের জন্য জেনারেল ডায়ারকে দোষী সাব্যস্ত করলে সরকার তাঁকে সেনাধ্যক্ষের পদ থেকে অপসারণ করে। জালিয়ানওয়ালাবাগের এ অমানবিক হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ব্রিটিশ সরকার প্রদত্ত ‘নাইট উপাধি’ বর্জন করেন। মূলত জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের ঘটনা থেকে সূত্রপাত হয় ভারতবর্ষে ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের। জালিয়ানওয়ালাবাগের মতো সলঙ্গাতেও নিরস্ত্র মানুষের ওপর ব্রিটিশ বাহিনীর পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড সলঙ্গাকে বাংলার জালিয়ানওয়ালাবাগ হিসেবে আখ্যায়িত করার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। জালিয়ানওয়ালাবাগের মতোই সলঙ্গা হত্যাকাণ্ডও পূর্ব বাংলায় ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনকে বেগবান করে তোলে।
জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড ভারতের ইতিহাসের বিশাল জায়গাজুড়ে আছে। জাতীয়ভাবে দিবসটি পালিত হয়। অত্যন্ত মর্যাদা ও গুরুত্বের সঙ্গে স্মরণ করা হয় আত্মাহুতি দেওয়া ব্যক্তিদের। এমনকি এক শতাব্দী পর যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ভারতে এসে সেই ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে গেছেন। ২০১৩ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি তিনি হত্যাকাণ্ডের স্মৃতিস্তম্ভে গিয়ে নীরবতা পালন করে শোক জানিয়েছেন। তিনি বলে গেছেন, ‘এ ঘটনা যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে লজ্জাজনক ঘটনা।’
রক্তাক্ত ইতিহাস বুকে নিয়ে সলঙ্গাও সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে। সলঙ্গার রক্তাক্ত হত্যাকাণ্ডকে জালিয়ানওয়ালাবাগ গণহত্যার চেয়েও বেশি ভয়াবহ ও হৃদয়বিদারক বলেছেন কোনো কোনো ইতিহাসবিদ। কিন্তু দুর্ভাগ্য, অবহেলিত ও উপেক্ষিত রয়ে গেছে সেই ইতিহাস। আসলে স্বাধীন ভারতবর্ষের ইতিহাসে সলঙ্গা দিবস অত্যন্ত গুরুত্ববহ। স্থানীয় মানুষ আজও এ হত্যাকাণ্ডের কথা মনে হলে শিউরে হয়ে ওঠে। রক্তাক্ত এ ঘটনাকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ও শহীদদের স্মরণে সলঙ্গার গোহাটায় একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়। মাত্র ১৯ বছর আগে সলঙ্গা বিদ্রোহস্থলে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। প্রতিবছর ২৭ জানুয়ারি এ স্থানে সলঙ্গা দিবস উপলক্ষে স্থানীয়ভাবে শোক র্যালি, মিলাদ মাহফিল ও স্মরণসভার আয়োজন করা হয়।
*লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর