উন্নয়নকে টেকসই করতে শতভাগ সাক্ষরতা জরুরি
আজ ৮ সেপ্টেম্বর। বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালিত হতে যাচ্ছে। ইউনেস্কো ঘোষিত দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য ‘প্রমোটিং লিটারেসি ফর এ ওয়ার্ল্ড ইন ট্রান্সসিশন: বিল্ডিং দ্য ফাউন্ডেশন ফর সাসটেইনেবল অ্যান্ড পিসফুল সোসাইটিস’। এ স্লোগানের বাংলায় মূলভাব করলে ‘পরিবর্তনশীল ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গঠনে সাক্ষরতার প্রসার।’
সারা বিশ্বে ইউনেসকোর নেতৃত্বে ১৯৬৬ সাল থেকে দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। স্বাধীন হওয়ার পরপরই ১৯৭২ সাল থেকে বাংলাদেশেও পালিত হয় দিবসটি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সাক্ষরতা মানেই স্বাক্ষর (নিজের নাম পূর্ণভাবে লিখতে পারা) করতে পারা বোঝাত। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাক্ষরতা সংজ্ঞা পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৯৩ সালে ইউনেসকো একে পুনঃসংজ্ঞায়িত করে।
শুধু অক্ষরজ্ঞানসম্পন্নতাকেই সাক্ষরতা বলা হয় না। এর সঙ্গে জীবনধারণ, যোগাযোগ দক্ষতা ও ক্ষমতায়নের দক্ষতা যুক্ত হয়েছে। বর্তমানের সংজ্ঞায় সাক্ষরতার সঙ্গে যোগাযোগ দক্ষতা, ক্ষমতায়নের দক্ষতা, জীবন নির্বাহী দক্ষতা, প্রতিরক্ষা দক্ষতা এবং সাংগঠনিক দক্ষতা সংযোজিত হয়েছে। বৃহত্তর পরিসরে বলা যায়, স্বাভাবিকভাবে জীবনধারণের জন্য ধর্মে, রাজনীতিতে, অর্থনীতিতে, সামাজিক যোগাযোগে আচরণে এবং কর্মের নির্দেশক হলো সাক্ষরতা। বলা যেতে পারে, লিখতে, পড়তে এবং বলতে পারলেই সাক্ষরতা সম্পন্ন মানুষ এখন আর বোঝায় না।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘রিপোর্ট অন বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্টাটিস্টিক ২০২২’ সর্বশেষ সাত বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সের বর্তমান সাক্ষরতার হার ৭৬ দশমিক ৮। গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে এ হার ছিল ৭৪ দশমিক ৬৬। সেই হিসাবে এক বছরে দেশে সাক্ষরতার হার বেড়েছে ১ দশমিক ৪২। তবে এখনো প্রায় ২৩ দশমিক ২ জনগোষ্ঠী নিরক্ষর। এভাবে প্রতিবছর যদি ১ দশমিক ৪২ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পায়, তাহলে সম্পূর্ণ নিরক্ষরমুক্ত বাংলাদেশ গঠন করতে সময় লাগবে প্রায় ১৭ বছর!
সাক্ষরতা বিষয়টি একটি জীবনব্যাপী প্রক্রিয়া। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সাক্ষরতা দক্ষতাগুলো কাজে লাগানো শেখাতে হবে। প্রতিনিয়ত চলার পথে আমাদের কী করা উচিত, কী করা অনুচিত, তা জানতে পারাই সাক্ষরতা। জলে স্থলে কিংবা আকাশপথে যেখানেই চলাচল করি না কেন, সেই জায়গার নিয়মগুলো অনুসরণ করাই সাক্ষরতা।
সেই ছোটবেলায় নদীতে নৌকায় উঠে সাঁতার জানতে না পারা বিদ্বান ব্যক্তির যে জীবন ষোল আনাই মিছে তা মাঝিই বলেছিলেন। রাস্তায় চলাচল করলে রাস্তার সাইনগুলো (নিরাপদ চলাচলের জন্য সড়কে প্রদর্শিত) না বুঝলে যেকোনো দুর্ঘটনা মুহূর্তেই ঘটে যেতে পারে।
সাক্ষরতা না থাকা মানুষ অন্ধের মতো যা পায়, তাই গ্রহণ করে ফেলে। উন্নয়নের পদ্মা সেতু করা হলো কিন্ত তার নাট-বল্ট তুলে ফেলল, মেট্রোরেল করলেন কিন্ত মেট্রোরেলের সঠিক ব্যবহার নাগরিকেরা না জানলে এটি রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাবে, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হলো সেই এক্সপ্রেসওয়েতে কোথায় নামতে হবে, কোথায় উঠতে হবে, তা না জানলে, চালক যানজটে আটকে থাকবে বা এক্সপ্রেসওয়েতে উঠবেই না। আবার জীবন ধারণ করার জন্য যতটুকু প্রয়োজন, তার চেয়ে বেশি সংরক্ষণ করে রাখি বলে অনেক সময়ই নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যায়। যখন শোনা যায়, কোনো একটা নির্দিষ্ট পণ্যের দাম বাড়বে। এতেই বাজারে দৌড়াদৌড়ি শুরু হয়ে যায়। ফলে চাহিদা বেড়ে যায়। আর চাহিদা বেড়ে গেলে বাজারে পণ্যের দাম কয়েকগুণ বৃদ্ধি পায়।
ইন্টারনেটের এ যুগে আরেকটা ভয়াবহ বিষয় হলো গুজব-অপপ্রচার। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-সংগঠন নিজ নিজ স্বার্থ হাসিলের জন্য নানা ধরনের গুজব-অপপ্রচার করে থাকে। জনসাধারণ অনেক সময় সেই গুজবে নিজেকে মিশিয়ে দিয়ে সমাজ-দেশের ক্ষতি করতেও দ্বিধাবোধ করে না।
উন্নয়নকে টেকসই করতে শতভাগ স্বাক্ষর জাতির প্রয়োজন। উন্নয়ন ও সাক্ষরতা একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটি চিন্তা করা যায় না। এটি বাস্তবসম্মত উপলব্ধি। স্বাধীনতার ৫২ বছরেও মোট জনগোষ্ঠীর চার ভাগের এক ভাগ এখনো নিরক্ষর রয়েছে। এ নিরক্ষরতার কারণগুলো খুঁজে বের করতে হবে। দেশে পাঁচ কোটি শিক্ষার্থী বর্তমানে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়নরত। এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে হবে। একজন শিক্ষার্থী একজন নিরক্ষর মানুষকে স্বাক্ষর করে তুলবে। এভাবে যদি সঠিক পরিকল্পনা করে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে কাজে লাগানো যায়, তাহলে মাত্র ১ বছরেই একটি নিরক্ষর মুক্ত দেশ গঠন করা সম্ভব।
লেখক: সাইফুল ইসলাম তালুকদার (রনি), জনসংযোগ কর্মকর্তা, ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন, বাংলাদেশ (আইইবি), সাবেক শিক্ষার্থী, শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইআর), ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়