বিজয়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের রাজনৈতিক চাওয়া
রাজনৈতিক ভাবনার প্রথম দাবি বা চাহিদা হচ্ছে ‘স্বাধীনতা’। এরপর নিজস্ব ঐতিহ্য, স্মারক ও সংস্কৃতিকে লালন–পালন করা। উভয় ক্ষেত্রে বাঙালিকে সংগ্রাম করতে হয়েছে, ত্যাগ-তিতিক্ষা বিসর্জন দিতে হয়েছে এবং সে সংগ্রাম আজও চলমান। সাম্প্রদায়িক শক্তি সব সময়ই মাথাচাড়া দেয়। প্রতিনিয়তই বাঙালিকে নিরন্তর ঝুঝতে হয়। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত করার জন্যও অন্তহীন প্রচেষ্টা করতে হচ্ছে। কর্মসংস্থান বড় সংকট। ঐক্যবদ্ধ বাঙালি অনেক কিছুই অর্জন করেছে। এখনো অনেক কিছু অর্জন করতে হবে।
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হ্যারল্ড জে লাস্কির মতে, রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপের ভূমিকা পালনে সক্ষমতাকে ‘রাজনৈতিক স্বাধীনতা’ বলে। রাজনৈতিক স্বাধীনতার মধ্যে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার ও ভোটদানের অধিকার, মতামত প্রকাশের অধিকার, চাকরি লাভের অধিকার ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশে সংসদীয় কাঠামো চালু থাকলেও এর সুষ্ঠু কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন করেন অনেকে। বিরোধী দলগুলোর বিরোধিতার খাতিরে নেতিবাচক ভূমিকা অব্যাহত রয়েছে। বাংলাদেশের বেশির ভাগ নাগরিকই যেকোনো একটি রাজনৈতিক দলের ভক্ত–সমর্থক। দুই ভাগে বিভক্ত দেশের জনগণ। আমার যা অভিজ্ঞতা, এ অবস্থা সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গেও রয়েছে। তবে গঠনমূলক সমালোচনা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির মধ্যে বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বেশি বলে মনে হয়েছে। বাংলাদেশের বিরোধী দলগুলোরও অন্ধ ভক্ত–সমর্থকেরা প্রায় সব সময়ই নেতিবাচক আলোচনা করে থাকেন। উল্টো ক্ষমতাসীনদের ক্ষেত্রে। বাংলার উভয় অংশের বাঙালির এ মনোভাব পরিবর্তন করা দরকার। দেশ গঠন ও উন্নয়নে ইতিবাচক বা বাঙালির অস্তিত্বপূর্ণ মতামত বা সিদ্ধান্তে সবাইকে একই প্ল্যাটফর্মে আসা উচিত। এতে দেশ ও জাতির মঙ্গল হবে। রাজনৈতিক উন্নয়ন কয়েকটি ইন্ডিকেটরের ওপর নির্ভর করে। ব্যক্তিনিরপেক্ষতা, মানুষের প্রবেশাধিকার ইত্যাদি ক্ষেত্রেও একই রকম মত।
অর্থনৈতিক উন্নয়ন রাজনৈতিক উন্নয়নের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল। বাঙালির নেতিবাচক চিন্তাধারার উন্নয়ন দরকার। গণতান্ত্রিক উন্নয়নপ্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করছে। নানা প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হচ্ছে। বাঙালিরা পরীক্ষিত জাতি। ব্রিটিশ থেকে মুক্ত, পাকিস্তানি শাসন থেকে মুক্ত বা ঢাকার ভাষা আন্দোলনকেন্দ্রিক ঐক্যবদ্ধ বাঙালিকে পেয়েছি। কিছু ব্যতিক্রম বাঙালিও রয়েছে। পলাশী বা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে শত্রুপক্ষের সঙ্গে অনেকে হাতও মিলিয়ে থাকেন। বাঙালির ক্ষেত্রে বুদ্ধিভিত্তিক চিন্তার অধিকারী নাগরিকের মর্যাদা ও মূল্যায়ন খুবই কম। অনেকের ক্ষেত্রে নিরপেক্ষতার অভাব রয়েছে। ফলে সত্যিকারের বুদ্ধজীবীরা কোণঠাসা হয়ে পড়েন। এ থেকে আমাদের উত্তরণ দরকার।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা সাহিত্যের সমান্তরালে রাজনীতি, সমাজ, স্বদেশ, ইতিহাস, সংস্কৃতি, বিশ্বপরিসর: সর্বোপরি মানবচিন্তা প্রভৃতি নিয়ে চিন্তা করেছেন; লিখেছেন। ‘কালান্তর’-এর প্রবন্ধগুলোর বক্তব্য, রাজনীতি, সমাজ, অর্থনীতির নিরিখে ব্যাখ্যার প্রয়াস দেখিয়েছেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক চিন্তা সম্পর্কে ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের মূল্যায়ন এ প্রসঙ্গে উল্লেখের অবকাশ রয়েছে: ‘সমাজসেবাকে তিনি রাজনীতি থেকে আলাদা করে দেখেননি।’ তাঁর দীর্ঘ জীবন হতেও প্রত্যক্ষ করা যায়, সমাজ ও মানুষই ছিল রবীন্দ্রনাথের আগ্রহের মৌলস্থল, ভাবনা-ভূখণ্ড। রবীন্দ্রনাথের রাজনৈতিক সত্তার একটি বড় দিক হলো ভাবনার নিরন্তর ভাঙাগড়া। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড, অসহযোগ আন্দোলন, বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সরব হতে দেখেছি। ব্যক্তিগত জীবনে তৎকালীন রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত না থাকলেও কংগ্রেসের বিভিন্ন অধিবেশনে অংশগ্রহণ করতেন কবিগুরু। ব্রিটিশ-গৃহীত রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে তাঁর ভূমিকাও ছিল। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনের সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বহু কবিতা রচনা করেছিলেন, ‘বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল...’ প্রভৃতির মতো গান ও কবিতা রচনা করেছেন। বাঙালির আরেকজন প্রধান কবি কাজী নজরুল ইসলাম সরাসরি ব্রিটিশ শাসন ও বিভিন্ন অনিয়মের ওপর সরব প্রতিবাদী হতে দেখা যায়। কবিতা ও গানের পাশাপাশি সশরীরও তিনি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছেন। রুশো-ভলতেয়ার যেমন জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছেন, বাঙালি কবি-সাহিত্যিকেরা কেউ তেমন একতাবদ্ধ করতে পারেননি। স্বয়ং বটবৃক্ষ রবীন্দ্রনাথকেও বাঙালির একটা অংশ প্রশ্নবিদ্ধ করার চেষ্টা করে থাকে। নজরুলের ক্ষেত্রেও তা–ই। আর বর্তমানের সাহিত্যিকদের কথা বাদই দিতে হবে। অনেকেই রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ঢুকে পড়েন বলে এই করুণ অবস্থা। রাজনীতি করে পাবলো নেরুদা জনপ্রিয়; বাঙালির ক্ষেত্রে এটা অকল্পনীয় ব্যাপার।
দেশে রাষ্ট্রব্যবস্থায় প্রকৃত গণতন্ত্র থাকুক বা না–থাকুক, দেশে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রচলিত আছে, এ রকমটি ভাবতে এ দেশের মানুষ পছন্দ করেন। বাঙালিরা সেনাশাসন মেনে নিতে অভ্যস্ত নয়। যখনই সেনাশাসন আসে, তখনই বাঙালির মধ্যে অসহিষ্ণুতা চলে আসে। এ ব্যবস্থা অপসারণে আন্দোলন-সংগ্রাম করে থাকে। বাঙালির মধ্যে ধর্মীয় চিন্তাভাবনা ঢুকে পড়েছে; দিন দিন তার প্রয়োগও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে বাঙালির সামাজিক-সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য-সংস্কৃতিতেও বিভক্তি দেখা যাচ্ছে এবং তা চরম অবস্থায় পতিত হচ্ছে, যা বাঙালির জন্য খারাপ হচ্ছে। আকাশ সংস্কৃতিতেও আমরা পিছিয়ে পড়ছি। নিজের সংস্কৃতি বাদ দিয়ে বিদেশি সংস্কৃতির আগ্রাসন বৃদ্ধির জন্য মিডিয়ার ভূমিকাও দায়ী। মিডিয়াকে বাঙালির নিজস্ব সংস্কৃতিরীতি তুলে ধরে জনমত গড়ে তুলতে হবে।
বাঙালির রাজনৈতিক চিন্তাভাবনায় মিশ্র অভিজ্ঞতা রয়েছে। বাঙালিরা তাদের অধিকার আদায়ে বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে থাকে। আন্দোলন সংগ্রাম যেমন থাকে; তেমনই ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে আপসনীতিও থাকে। কবি-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীর মতো অগ্রসর জনগোষ্ঠীর ভূমিকা দিন দিন কমেই যাচ্ছে। এ সমাজের অন্তর্ভুক্ত নাগরিকের বড় একটি অংশ নিজেদের স্বার্থে নিরপেক্ষতা হারিয়ে সাধারণ নাগরিকের চেয়েও কম ভূমিকা পালন করছেন। রবীন্দ্রনাথ-নজরুলের রাজনৈতিক চিন্তা থেকেও সরে আসছি। আবার বাঙালির মধ্যে বিভিন্ন মতবাদকে নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করার প্রবণতাও দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে।
মহান স্বাধীনতাসংগ্রাম বিষয়েও বিভক্তি দেখা দিচ্ছে। স্বাধীনতা-চেতনাকে ব্যবসা হিসেবে চিন্তা করেন কেউ কেউ। ফলে সবচেয়ে বড় এ অর্জনকে সর্বজনীন করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে বাঙালির মধ্যে বিভক্তি দেখা যায়। শাসকশ্রেণির অসহিষ্ণু আচরণও ক্ষেত্রমতে দায়ী। দিন দিন ‘যড়যন্ত্রতত্ত্ব’ বাঙালির মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলিত হয়ে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে অসহিষ্ণু আচরণ দায়ী। নৈতিক শিক্ষার ক্ষেত্রেও পিছিয়ে পড়ছি। সঠিক ও নিরপেক্ষ ইতিহাস তুলে না ধরে পাঠ্যপুস্তকে সর্বজনীনতা আনতে ব্যর্থ হচ্ছি। যার যার অবস্থান থেকে ক্ষমতার অপব্যবহার করছি। সব নেতিবাচক বিষয় এড়াতে হলে ‘রঙিন চশমা’ বাদ দিয়ে রাজা-প্রজা-মধ্যভোগী—সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। প্রথম চাঁদে অবতণের সময় নীল আর্মস্ট্রংয়ের উক্তি- ‘...দ্যাটস ওয়ান স্মল স্টেপ ফর ম্যান, ওয়ান গেইন লেপ ফর ম্যানকাইন্ড’— অনুসরণ করে বাঙালিকে এগিয়ে যেতে হবে।
লেখক:
প্রাবন্ধিক