হেমন্তের বিকেল
সত্যিই কি হেমন্তের বিকেল মানে বিষণ্ণতা, মন কেমন করা উদাসীনতা! হয়তোবা। আমারও মন কেমন করে উত্তরের হাওয়ায় দুলতে থাকা সবুজ ধানের খেতে যখন পড়ন্ত সূর্যের নরম আলো এসে পড়ে। বুকের ভেতর এক অজানা নিঃসঙ্গতা এসে ভর করে। মনে হয় কেউ নেই, কিছু নেই। চারদিকে শূন্যতার বসবাস।
তেমনি আবার ভালো লাগাও কাজ করে। যখন হিম হিম শীতল পরশ এসে আলতো করে ছুঁয়ে যায়। ভালো লাগাটা আরও নান্দনিক হয় যখন প্রিয়জন পাশে থাকে। কল্পনা করুন, দুজনে কুয়াশাচ্ছন্ন স্নিগ্ধ বিকেলে উত্তরের বারান্দায় মুখোমুখি বসে গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে জীবনের কতশত গল্প বুনছেন। অথবা হেমন্তের কোনো এক পড়ন্ত বিকেলে গায়ে চাদর জড়িয়ে হাতে হাত রেখে গ্রামের মেঠো পথে হাঁটা। আহ, জীবন সুন্দর, ভয়াবহ রকমের সুন্দর। প্রকৃতি তার নানান রঙে আমাদের রাঙিয়ে দিচ্ছে অকৃপণভাবে। এ দায় শুধিতে পারিব কি হায়!
আমাদের মা–চাচিরা গল্প করেন, তাঁদের ছেলেবেলায় তাঁরা যখন নানি বা দাদির বাড়ি বেড়াতে যেতেন, তখন সব ভাইবোন আত্মীয়স্বজনে বাড়ি গমগম করত। বিকেল থেকে শুরু হতো পিঠা বানানোর ধুম। রাতে নাকি ঘুমানোর জায়গা হতো না বিছানায়। তাই হেমন্তের ফসল কাটার পর যে খড় হতো, সেটা দিয়ে রাতের বেলা লম্বা করে বিছানা করে সবাই মিলে সেখানে ঘুমাতেন। সেই খড়ের বিছানায় ঘুমানোর অনুভূতি নাকি অদ্ভুত এবং ভীষণ আরামদায়ক।
সময় আর বাস্তবতা আমাদেরকে অনেক মধুর অনুভূতির স্বাদ থেকে বঞ্চিত করছে। ইট–পাথরের এই দেয়ালজুড়ে থাকা শহরের ব্যস্ততায় মোড়ানো জীবনে বুঝতেই পারি না কখন শীত আসে, কখন চলে যায়। জীবনের তাগিদে কাকডাকা ভোরে বেরিয়ে পড়তে হয় অফিসে। ঘরে ফিরতে ফিরতে রাত। জীবনের যে আলাদা রং–রস, সেটা যেন ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে।
হেমন্তের বিকেলকে আলাদা করে অনুভব করতে চাইলে যেকোনো ছুটির দিনে প্রিয়জনের সঙ্গে বেরিয়ে পড়া যায় অনায়াসে। আসলে ব্যস্ততা আর বাস্তবতার অজুহাত দেখিয়ে নিজেকে ঠকানোর কোনো মানে হয় না। কেউ এসে বলবে না, রাখী চলো তোমাকে একটা সুন্দর বিকেল উপহার দিই। বরং আমাকেই খুঁজে নিতে হবে আমার ভালো লাগাটুকু।
প্রকৃতি কিন্তু মনের ওপরও দারুণ প্রভাব ফেলে। হিম হিম শীতলতা আর ভোরের কুয়াশা জড়ানো শিশির বিন্দুতে যে ভালো লাগা আপনি অনুভব করবেন, সেটা কিন্তু তপ্ত আবহাওয়ায় মোটেই পাবেন না। প্রিয়জনের উষ্ণতা জড়ানো সান্নিধ্য পেতে শীতের চেয়ে রোমান্টিক ঋতু আর হতেই পারে না। কাজেই ব্যাগটা গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ুন সঙ্গীর হাত ধরে দূর পাহাড়ে।
ভেবে দেখুন, গ্রামের টংদোকানে শীতের বিকেলে পাড়ার মুরব্বি থেকে শুরু করে সব বয়সী মানুষ গায়ে চাদর আর মাথায় টুপি, গলায় মাফলার পেঁচিয়ে যখন চা খেতে খেতে আড্ডা দেন, কি অপূর্ব পরিবেশ সৃষ্টি হয়। সেখানে কেউ আবার ভাপা পিঠা, চিতই পিঠা বিক্রি হয়। এই ছোট জিনিসগুলো কি যে আনন্দ দেয়।
আমার মনে হয়, পৃথিবীর অন্য কোনো উন্নত দেশেও ঋতুর এত বিলাস নেই। আসলে আমরা বাংলাদেশি আর বাঙালিরা জীবনকে যত সহজভাবে উদ্যাপন করতে জানি, অন্যরা বোধ হয় তা পারে না। আমাদের চারপাশের প্রকৃতি আর খেটে খাওয়া মানুষগুলো যে বৈচিত্র্য আমাদের দিতে পারে, তা পৃথিবীর কোথাও পাওয়া সম্ভব নয়।
সেদিন আমার এক পরিচিত সিনিয়র সাংবাদিক বলছিলেন, আমেরিকা আমার ভালো লাগেনি। ও দেশ আমার জন্য নয়। এই যে প্রেসক্লাবে সহকর্মীদের সঙ্গে চা খাচ্ছি আর গল্প করছি, এই ভালো লাগা, এই সম্মান আমি কোথায় পাব? কাজেই আমার কাছে আমার দেশ আমার, আমার প্রকৃতি আর মানুষগুলোই সেরা।
প্রকৃতির কাছে আমাদের ঋণ অপরিশোধ্য। শ্রাবণের বৃষ্টিমুখর রাতে যেমন অপ্রতিম ভালো লাগা টের পাই, তেমনি বসন্তের পাতাঝরা মধ্যদুপুরে এক নির্মল প্রশান্তি অনুভূত হয়। আর এই হেমন্তের মন কেমন করা উদাসী বিকেলে ইচ্ছে করে গরম চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে লিখে ফেলি জগতের সমস্ত প্রেমিক–প্রেমিকার ভালোবাসার গল্প।
হেমন্ত ঋতু আমাকে স্পন্দিত করে, আলোড়িত করে। আমার ইচ্ছে করে মিষ্টি রোদ্দুর হই, ঘাসফুল কিংবা রঙিন প্রজাপতি, হই সবুজ কচি লেবুপাতা অথবা শালিকের মতো কমলা রঙের আদুরে পাখি, ছুঁয়ে দেখি মাছারাঙা হয়ে জলের কিনার, গা ঘেঁষে থাকি দূরের ওই ঘন সবুজ পাহাড়ের।
‘সন্ধ্যা আসে সহসা কখন, সজিনার ডালে ডালে পেঁচা কাঁদে নিম নিম কার্তিকের চাঁদে’—জীবনানন্দের কাছে হেমন্ত যেন এক অপরূপা সুন্দরী।
আমার কাছে হেমন্ত শুধু সুন্দরী ঋতু নয়, মন কেমন করা বিষণ্নতা জড়ানো পুরোনো প্রেমিকের হাতছানি!
‘আমার বুকের ’পরে সেই রাতে জমেছে যে শিশিরের জল
তুমিও কি চেয়েছিলে শুধু তাই’…
কিংবা হেমন্তের একলা বিকেলে আমার শান্ত বারান্দায় দাঁড়িয়ে পুরোনো মলাটে বাঁধানো কবিতার বই হাতে নিয়ে বলি,
‘সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে, ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন,
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল
সব পাখি ঘরে আসে, সব নদী ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন,
থাকে শুধু অন্ধকার মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন।’
*লেখক: ফিচার লেখক