বর্তমান বিশ্ব একটি ক্রান্তিকাল অতিবাহিত করছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বজুড়েও আলোচিত হচ্ছে অর্থনৈতিক মন্দার বিষয়টি। বলা হচ্ছে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন বিশ্ব। উন্নত দেশগুলো থেকে শুরু করে স্বল্পোন্নত, অনুন্নত দেশগুলো এ মন্দায় শামিল হচ্ছে। এ অর্থনৈতিক মন্দার সূত্রপাত ঘটে ২০২০ সালে, যা মহামারির বছর নামে পরিচিত। করোনাভাইরাস মহামারির উদ্ভূত ওই বছরে বিশ্বের প্রতিটি দেশ অদৃশ্য এই ভাইরাসের বিপক্ষে যুদ্ধ করে।

ব্যবসা–বাণিজ্য, অর্থনৈতিক–সামাজিক খাতে বিশদ সমস্যা সৃষ্টি হয় প্রতিটি দেশে। তবে বাংলাদেশসহ বাকি বিশ্বের দেশগুলো মহামারির সময়কে পেছনে ফেলে সামনে যখন এগিয়ে যাচ্ছে। পূরণ করছে অর্থনীতিতে সৃষ্ট শূন্যস্থানগুলো। ঠিক তখনই মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে এসেছে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ। এই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই এই যুদ্ধের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়েছে বিশ্বের প্রতিটি দেশে। বৈশ্বিক মানচিত্রে এই যুদ্ধের প্রভাবে হিমশিম খাচ্ছে দেশগুলো।

দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতিতে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হিসেবে স্বীকৃত। যার দরুন এ যুদ্ধের রেশ থেকে বাদ যায়নি বাংলাদেশও। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের জেরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার পরস্পরের নিষেধাজ্ঞা পাল্টা নিষেধাজ্ঞাসহ নানা পদক্ষেপের কারণে ইতিমধ্যেই অর্থনীতিতে নানা প্রভাব পড়েছে এবং দ্রব্যমূল্য বেড়েছে অনেকখানি। অস্থিতিশীল অর্থনীতির কাঠামো, জ্বালানি তেল ও গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি এবং বিশ্ববাজারে ক্রমাগত নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্যবৃদ্ধিতে আমাদের দেশে জীবনমান আগের তুলনায় কঠিনতর হয়ে গেছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক খাদ্যমূল্যের সূচক বেড়েছে ১৪৯ দশমিক ৭ শতাংশ পর্যন্ত, যা ২০২১ সালে ছিল ১২৫ দশমিক ৭ শতাংশ। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, তুরস্কসহ উন্নত দেশগুলোর মূল্যস্ফীতি আকাশ ছুঁয়েছে। বিশ্বব্যাংকের দেওয়া তথ্য বলছে, সরবরাহব্যবস্থার সংকট এবং শ্রমবাজারের ওপর থাকা চাপ যদি প্রশমিত না হয়, তাহলে ২০২৩ সালে জ্বালানি খাত বাদে বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির হার দাঁড়াবে ৫ শতাংশে। এ অঙ্কটা করোনা মহামারির আগের পাঁচ বছরের গড় মূল্যস্ফীতির প্রায় দ্বিগুণ।

গ্রাফিক্স: প্রথম আলো

পাশাপাশি বৈশ্বিকভাবে ডলারের অস্বাভাবিক মান বৃদ্ধির কারণে মুদ্রাস্ফীতি হচ্ছে। এতে মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়ে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে আমাদের দেশে। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমাদের দেশে মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ কারণে সরকার আশঙ্কা করছে ২০২৩ সালে চরম অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি হয়ে দুর্ভিক্ষ হওয়ার। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সরকারও এই অর্থনৈতিক মন্দার আগাম প্রতিরোধে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে এবং সবাইকে প্রস্তুতি নিতে বলেছে।

আসন্ন এই অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাবে সাধারণ মানুষের জীবনযাপন আরও নাভিশ্বাস হয়ে উঠবে। বেঁচে থাকার জন্য জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন হ্রাস পাবে। স্বাভাবিকভাবে আমাদের বেঁচে থাকার জন্য যেসব মানবাধিকার চাহিদা অনুযায়ী উপকরণ রয়েছে। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও চিত্তবিনোদন এসব উপকরণ ব্যবহার করা একজন নাগরিকের মৌলিক কর্তব্য। কিন্তু অর্থনৈতিক মন্দার কারণে একজন সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার অর্জন করা দুরূহ হয়ে যাবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাবে। বাজারব্যবস্থা অনিয়ন্ত্রিত হয়ে যাবে। আমদানি করা খাদ্যপণ্যের দাম বাড়বে। প্রবাসী আয় কমে যাবে। রপ্তানি আয় কমে যেতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের পরিমাণ সর্বশেষ ৩৯ দশমিক ৭২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে নেমে এসেছে; কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বাংলাদেশ ব্যাংকের এ পরিসংখ্যানের সঙ্গে একমত নয়। তারা বলছে, বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের প্রকৃত স্থিতি হচ্ছে ৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অর্থাৎ এ মন্দার কারণে আমাদের দেশের রিজার্ভে ঘাটতি সৃষ্টি হবে এবং এর পরিমাণ আরও কমে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ৯ মাসে গড়িয়েছে। এ যুদ্ধের ফলাফল কী হবে, তা বলা মুশকিল। এমনকি এ যুদ্ধ কবে সমাপ্ত হবে, তা–ও বলা যাচ্ছে না। যার ফলে বিশ্বব্যাপী বিস্তৃত আকারে ছড়িয়ে পড়ছে এ যুদ্ধের প্রভাব। ভঙ্গুর অর্থনীতির দিকে প্রভাবিত হচ্ছে বিশ্ব। সে জন্য বাংলাদেশকে আসন্ন এ অর্থনৈতিক মন্দার প্রস্তুতি সামাল দিতে প্রয়োজনীয় কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। প্রথমত, আমাদের দেশের আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে ফেলতে হবে। প্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদনে বিশেষ নজর দিতে হবে। পরিকল্পিতভাবে বিনিয়োগ করতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি খাতে অপ্রয়োজনীয় খরচ কমিয়ে ফেলতে হবে। যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিক সংস্কার করতে হবে। তা ছাড়া আমাদের দেশে অর্থনীতির প্রধান দুটি সূচক হচ্ছে পোশাক খাত ও প্রবাসী আয়। এ দুই খাত থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক সাফল্য বজায় রাখতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ে নিয়মনীতি কিছুটা শিথিল করতে হবে। নির্দিষ্ট খাতে বিনিয়োগ করে দেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল রাখতে হবে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের বিস্তার করে গ্রামাঞ্চলে বেকারত্ব হ্রাস করতে হবে। ঘাটতি বাজেট কমিয়ে ভারসাম্যপূর্ণ অর্থনীতির কাঠামো তৈরি করতে হবে, যে কাঠামোয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সেবার মান উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হবে। আয়ের তুলনায় খরচের হার কমিয়ে সঞ্চয়ী হতে হবে। নিম্নবর্গের মানুষের জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি কার্যকর ও উন্নত শিক্ষাব্যবস্থা গঠনে জোরালো ভূমিকা রাখতে হবে। ফলে আসন্ন অর্থনৈতিক মন্দায় দেশের শতভাগ নিবেদনে আবহমান রূপায়ণে সৃষ্টি হবে ভবিষ্যৎ সোনার বাংলাদেশ।

*লেখক: শাহ মুনতাসির হোসেন মিহান, শিক্ষার্থী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়