প্লাস্টিক, পলিথিন এবং পরিবেশ
‘ওস্তাদ আস্তে আস্তে, ডানে প্লাস্টিক!’ চালকের পেছনে বসে ফ্যালফ্যাল করে রাস্তার ডানে তাকিয়ে থাকি। আবার সে চেঁচিয়ে বলে, ‘ওস্তাদ বাঁয়ে প্লাস্টিক!’ প্রথমবার ঢাকায় আসা আমি এপাশ-ওপাশ করেও প্লাস্টিক খুঁজে পাই না। চারপাশে ব্যক্তিগত গাড়ি ছাড়া কিছু চোখে পড়ে না। অবচেতন মনে প্রশ্ন জাগে, গাড়ি চালাতে প্লাস্টিকে ভয় কেন? কিছুদিন পরে বুঝতে পেরেছি তারা ছোট ব্যক্তিগত গাড়িকে প্লাস্টিক বলে। তাদের কাছে এসব গাড়ি বিরক্তিকর জঞ্জাল।
সে যা-ই হোক, প্লাস্টিক, অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল ও পলিথিন পরিবেশের জন্য মারাত্মক জঞ্জাল। এগুলো এতটাই ভয়ংকর, যা মাটিতে থাকলে মাটি দূষিত করে, পানিতে থাকলে পানি দূষিত করে আর আগুনে পোড়ালে বায়ু দূষিত করে। এদের সৃষ্টিই হয়েছে দূষিত করার জন্য। এরা শুধু মানুষেরই নয়, সমগ্র জীবকুলের মারাত্মক ক্ষতি সাধন করে। দামে সস্তা, সহজলভ্য, টেকসই আর হালকা পাতলা হওয়ার কারণে আধুনিক জীবনব্যবস্থার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত হয়েছে পলিথিন, অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল ও প্লাস্টিক। সে জন্য বলা হয়, খাবার ছাড়া দুই দিন চলা যায়, কিন্তু প্লাস্টিক বা পলিথিন ছাড়া এক বেলা বাঁচা যায় না। এটাই বাস্তবতা!
আমরা যেসব পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহার করি, সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে অনটাইম ব্যবহৃত প্লাস্টিক ও পলিথিন। জীবন ধারণের সুবিধার জন্য অনটাইম পলিথিন, গ্লাস, চায়ের কাপ, প্লেট, পানির বোতল, হ্যান্ড গ্লাভস ইচ্ছেমতো ব্যবহার করছি। অনেকে একে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করছে। ব্যবহার শেষে যেখানে-সেখানে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। যে কারণে স্থলভাগ, জলভাগ ও বায়ুমণ্ডল মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে। মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে এবং টেকসই উন্নয়ন ব্যাহত হচ্ছে।
শহরের মানুষের প্লাস্টিকের ব্যবহার গত ১৫ বছরে তিন গুণ বেড়েছে। ২০০৫ সালে মাথাপিছু তিন কেজি প্লাস্টিক ব্যবহার করলেও ২০২০ সালে সেটা দাঁড়িয়েছে ৯ কেজিতে। শুধু ২০২০ সালে ৯ লাখ ৭৭ হাজার টন ব্যবহৃত প্লাস্টিকের মধ্যে ৩১ শতাংশ রিসাইকেল করা সম্ভব হয়েছে, বাকি ৬৯ শতাংশ রিসাইকেল করা যায়নি। কারণ, অধিকাংশই অনটাইম ব্যবহার করা প্লাস্টিক (বিশ্বব্যাংক, ২০২০)। পলিথিন ব্যাগের উত্পাদন এবং ব্যবহার একেবারে লাগামহীন। শুধু পুরান ঢাকায় ২০০-এর বেশি পলিথিন উত্পাদনের কারখানা রয়েছে। যাদের একেকটার দৈনিক উত্পাদনের ক্ষমতা ৫০০ থেকে ৭০০ টন (Financial Express, 27.02.2020)
এবার দেখা যাক এগুলো কীভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে?
আমরা বাজার থেকে আলাদাভাবে আলু, বেগুন, টমেটো, কাঁচা মরিচসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনি। অফিস থেকে ফেরার পথে ভ্যানের ওপর থেকে কিংবা ফুটপাতের ফলের দোকান থেকে কিছু একটা নিয়ে বাসায় ফিরি। বিক্রেতা আপনার কেনা অধিকাংশ পণ্যসামগ্রীই আলাদা পলিব্যাগে দেন। এমনকি কাগজের ঠোঙাও পলিথিনে ভোরে দেন। আমাদের ক্রয়কৃত সব পণ্যেই কোনো না কোনোভাবে পলিথিনে আবৃত থাকে। খাদ্যদ্রব্য ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস, যেমন চিপস, চকলেট, বিস্কুট, ডিটারজেন্ট, সাবান, লবণ, চিনির প্যাকেটসহ যাবতীয় প্যাকেট এয়ারটাইট করতে পলিথিন ও অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল বিপুলভাবে ব্যবহৃত হয়। সঙ্গে আমাদের বহুল ব্যবহৃত কোমল পানীয় ও পানির বোতল তো আছেই।
তারপর সেগুলো কী হচ্ছে?
আমরা এসব প্যাকেট, বোতল ও পলিথিন ডাস্টবিন কিংবা এখানে-সেখানে ফেলে দিই। রাস্তা-ঘাটে, বাজারে, রেলস্টেশনে শত শত পলিথিন ও প্লাস্টিক পড়ে থাকে। যেহেতু এগুলো পচনশীল নয়, ফলে এর আধিক্য বাড়তে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাসার উচ্ছিষ্ট পলিথিনে ভরে ময়লার ঝুড়িতে রেখে দিই। সিটি করপোরেশনের লোকজন ময়লা হিসেবে এগুলো প্রতিদিন সংগ্রহ করেন। পথশিশুরা এসবের মধ্যে থেকে প্লাস্টিক এবং বড় সাইজের পলিব্যাগ আলাদা করে। বাকি সব ময়লায় একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ডাম্পিং করে।
স্বাভাবিকভাবেই পচনশীল এসব উচ্ছিষ্ট একটা নির্দিষ্ট সময় পর বায়োমাসে রূপান্তর হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার কথা। কিন্তু নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে, সর্বসহা ভূপৃষ্ঠের উপরিভাগ পলিব্যাগে রক্ষিত ডোমেস্টিক উচ্ছিষ্ট স্পর্শ করতে পারে না। পলিব্যাগের ভেতরে থাকা ময়লাগুলো পচে-গলে খানিকটা গ্যাসীয় পদার্থ তৈরি হয়, যার উৎকট গন্ধে পুরো এলাকাকে দূষিত করে ফলে। সলিড অংশ পলিথিনের মধ্যে জমাট বেঁধে ছোট ছোট পোঁটলার আকার ধারণ করে। এসব অগণিত বোতল ও পোঁটলার কারণে ডাম্পিং এরিয়া দ্রুততম গতিতে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বাড়তে থাকে।
ড্রেনেজ সিস্টেমে বেশি পরিমাণে পলিথিন যাওয়ার কারণে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা বিঘ্নিত হচ্ছে, ড্রেন ব্লক হয়ে যাচ্ছে। ফলে অল্প একটু বৃষ্টিতেই শহরের রাস্তাঘাট ডুবে যাচ্ছে। তা ছাড়া ড্রেনে জমে থাকা পানি হচ্ছে মশাদের উপযুক্ত প্রজনন ক্ষেত্র; যে কারণে দ্রুত হারে মশার বংশবৃদ্ধি হচ্ছে। আর তাই মশাবাহিত রোগ যেমন ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত বছর শুধু ঢাকা শহরে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে অনেক মানুষ মারা গেছেন।
ছোট ছোট প্লাস্টিকের বোতল ও হাজারো পলিথিন ড্রেনেজ সিস্টেমের ভেতর দিয়ে নদীতে পতিত হচ্ছে। ফলে একদিকে যেমন নদীর তলদেশে জমা হয়ে তার নব্যতা হারাচ্ছে, অন্যদিকে পুরো জলজ পরিবেশের বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস করে দিচ্ছে। বহু প্লাস্টিকের বোতল ভাসতে ভাসতে নদী থেকে সাগরে যাচ্ছে। সাগরে গিয়ে একদিকে যেমন মেরিন বাস্তুতন্ত্র নষ্ট করে দিচ্ছে অন্যদিকে সাগরে লবণাক্ত পানির সংস্পর্শে প্লাস্টিক ক্ষয়ে গিয়ে মাইক্রোপ্লাস্টিকে রূপান্তর হচ্ছে। সাগর থেকে সংগ্রহ করা লবণে মিশে যাচ্ছে মাইক্রোপ্লাস্টিক। বাংলাদেশে মহেশখালী থেকে আহরিত লবণে অতিরিক্ত মাত্রায় এসব মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যাচ্ছে (30 Nov 2021, Nature)। লবণ ও বিভিন্ন খাবারের মাধ্যমে মাইক্রোপ্লাস্টিক মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে। ফলে মানব শরীরে ক্যানসারের মতো রোগ হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হচ্ছে (বিবিসি বাংলা, ৫ জুন, ২০১৮)।
প্লাস্টিক কিংবা পলিথিনের ব্যবহার ইচ্ছা করলেই যথেষ্ট পরিমাণে কমিয়ে আনা সম্ভবত। একদিকে সাধারণ মানুষের সচেতনতা, অন্যদিকে উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সদিচ্ছা থাকলে ২০৩০ সালের মধ্যে পলিথিন বা প্লাস্টিকের ব্যবহার বর্তমান ব্যবহারের ৫০ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব।
কীভাবে আমরা সেটা করতে পারি?
প্রথমে বহুল ব্যবহৃত পলিথিনের বিকল্প হিসেবে আমরা বাজার করার জন্য কাপড়ের তৈরি ব্যাগ ব্যবহার করতে পারি। বিশেষ করে পুরোনো জিনস দিয়ে তৈরি ছোট, বড় কিংবা মাঝারি আকারের ব্যাগ। এটা যেমন শক্ত, টেকসই তেমনই পরিবেশবান্ধব। আমরা যদি বাজারের যাওয়ার সময় হাতে করে ব্যাগ নিয়ে যাই এবং মাছ-মাংস ছাড়া অন্য সব জিনিস সেই ব্যাগে নিয়ে বাসায় আসি, তাহলে পলিথিনের ব্যবহার ৫০ শতাংশ কমে যাবে। তারপর ব্যাগটা ধুয়ে শুকিয়ে আবার ব্যবহারের জন্য রেখে দিলে ব্যাগ কেনার খরচও কমে যাবে। অফিসে যাওয়ার সময় একটা ব্যাগ অফিস ব্যাগের মধ্যে ভাঁজ করে রাখলে সমস্যা হবে না। অফিস থেকে ফেরার সময় কিছু কিনলে, তা সেই ব্যাগে নিয়ে আসা যাবে। গাড়িতে এ ধরনের ব্যাগ একটা-দুটোই রাখা যেতে পারে। এভাবে সবার সামান্য সচেতনতা পলিথিনের দূষণ থেকে পরিবেশকে সুরক্ষিত করতে পারে। ছোট ছোট উদ্যোক্তারা, বিশেষ করে নারী উদ্যোক্তারা বাসায় বসে এসব ব্যাগ তৈরি করে বাজারজাত করতে পারে। তা ছাড়া যেসব কারখানা পলিথিনের ব্যাগ তৈরি করছে, তারা বৃহৎ পরিসরে কাপড়ের ব্যাগ উত্পাদন করে সহজলভ্য করতে পারে। ফলে যেমন পুরোনো জিনসজাতীয় কাপড়কে আবার ব্যবহার করা যাবে, তেমনই কিছু নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হবে। জাতীয় বা আন্তর্জাতিক এনজিওগুলো এভাবে পাইলট প্রকল্প চালু করে দেখতে পারে।
অনটাইম প্লাস্টিকের বোতল রিসাইকেল করা সহজ। বিশেষ করে পানি বা কোমল পানীয়ের বোতলের কথা বলা যেতে পারে। উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠান বলতে পারে, বোতল ফেরত দিলে দাম কম রাখা হবে। যেমন, ২৫০ এমএলের বোতল ফেরত দিলে দুই টাকা ছাড়। ৫০০ এমএল, ১ লিটার এবং ২ লিটার বোতল ফেরত দিলে যথাক্রমে ৫, ৭ ও ১০ টাকা ছাড়। কিংবা এক ডজন ছোট বোতল দিলে একটা পূর্ণ বোতল ফ্রি পাবে। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এসব বোতল সহজে রিসাইকেল করে আবার ব্যবহার করে উৎপাদন খরচ কমাতে পারে। চিপস, ব্রেড, বিস্কুটজাতীয় খাদ্যদ্রব্য জিপার ব্যাগে বাজারজাত করতে পারে। তারপর জিপার ব্যাগ মোমজাতীয় পদার্থ দিয়ে সিল করলেই সুরক্ষিত থাকবে। উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠান বলতে পারে, ১০টা জিপার ব্যাগ অক্ষত ফেরত দিলে একটা চিপস ফ্রি অথবা সমান মূল্যের টাকা ফেরত। প্রতিষ্ঠানগুলো এসব ব্যাগ সহজেই রিসাইকেল করতে পারে। এভাবে ওষুধ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান তাদের ওষুধের স্ট্রিপ, কাচ বা প্লাস্টিকের বোতল এভাবে ফেরত নিয়ে আবার ব্যবহার করতে পারে। এতে করে উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানের জন্য একটা মার্কেটিং চ্যানেল তৈরি হবে। যেমন যে ব্র্যান্ডের পণ্য একবার কিনবে, বোতল বা ব্যাগ ফেরত দেওয়ার জন্য হলেও পরের বার একই ব্র্যান্ডের পণ্য কিনবে।
সরকার পরিবেশবান্ধব এসব প্রতিষ্ঠানকে প্রণোদনা হিসেবে কর রিবেট দিতে পারে অথবা অন্য কোনো সুবিধা দিতে পারে। দাতা সংস্থাগুলো উত্পাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করে পাইলট প্রকল্প চালু করতে পারে। তাহলে ভোক্তা, উত্পাদক, সরকার ও পরিবেশ উভয়ই বিশেষভাবে উপকৃত হবে। এটা হবে একটা উইন উইন সিস্টেমস।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, প্রেস ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে পারে। দাতা সংস্থাগুলোর অর্থসহায়তায় নতুন নতুন আইডিয়ার জন্য স্কুল-কলেজে বিজ্ঞানবিষয়ক রিয়ালিটি শো-এর আয়োজন করতে পারে। তরুণদের মধ্যে হাজারো নতুন ক্রিয়েটিভ আইডিয়া আছে। এগুলোর মধ্যে থেকে সময় উপযোগী ও সমাধানমূলক ধারণা পেলে অনেক কিছু সহজ হয়ে যাবে।
টেকসই পরিবেশ কেবল একজন বা একটা প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সম্ভব নয়। আইনের সঠিক প্রয়োগ, ব্যক্তিগত সচেতনতা ও সবার সক্রিয় অংশগ্রহণ থাকলে পরিবেশের উন্নয়ন হবেই হবে। আমাদের এটা করতে হবে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। আমাদের ছেলেমেয়েদের জন্য। আমরা যে পৃথিবী পেয়েছি, তার চেয়ে ভালো পৃথিবী উপহার দিতে না পারলেও খারাপ করে রেখে যাওয়ার অধিকার আমাদের নেই।
*নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]