লাল-হলুদ ও সবুজ-মেরুনের মহাসমুদ্রে এক সন্ধ্যা

কিক অফের অপেক্ষা
ছবি: লেখক

একজন ক্রীড়ানুরাগী ও মাঠের দর্শক হিসেবে ভরা গ্যালারিতে বসে ঢাকা ডার্বি অর্থাৎ আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথ দেখতে না পারার আক্ষেপটা আমার চিরদিনের। যখন থেকে মাঠে উপস্থিত হয়ে আমি নিয়মিত খেলা দেখতে শুরু করি, ততদিনে ঢাকা ডার্বির আবেদন প্রায় শূন্যের কোঠায়। এ সময়টায় বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে বেশ কয়েকটা আবাহনী-মোহামেডান লড়াই দেখা হলেও দর্শকের অভাবে সেগুলোর সব কটিতেই গ্যালারি ছিল প্রায় ফাঁকা।

আমার গেল দেড় যুগেরও বেশি সময় ধরে খেলা দেখার জীবনে একবারই শুধু ঢাকা ডার্বিকে কেন্দ্র করে মানুষের উল্লেখযোগ্য উন্মাদনা দেখতে পেয়েছিলাম। সত্তর-আশি ও নব্বইয়ের দশকের স্বর্ণালি সময় হারানোর পর সেবারই প্রথম ঢাকা ডার্বির উত্তেজনা পুনরায় অনুভব করেছিল দেশের ফুটবলপ্রেমী জনতা।

ছোট পিকআপে করে স্লোগান দিতে দিতে স্টেডিয়াম অভিমুখে একদল ইস্টবেঙ্গল সমর্থক
ছবি: লেখক

সে ২০০৯ সালের কথা। ‘কোটি টাকার সুপার কাপ’ হিসেবে পরিচিত বাংলাদেশ সুপার কাপের প্রথম আসরের ফাইনালে সেবার মুখোমুখি হয়েছিল দুই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আবাহনী ও মোহামেডান। ফাইনালের দিন বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের গ্যালারিতে তিল ধারণেরও জায়গা ছিল না। ম্যাচ দেখতে ৩৬ হাজার ধারণক্ষমতার এ স্টেডিয়ামে উপস্থিত ছিল ৪৪ হাজার দর্শক। দুর্ভাগ্যবশত বয়সে অপরিণত হওয়ায় এবং ঢাকায় না থাকায় গ্যালারিতে বসে ম্যাচটা দেখার সুযোগ হয়নি আমার।

যদিও ঢাকা ডার্বির পুরোনো আমেজকে ছাপিয়ে যাওয়ার জন্য ২০০৯-এর ডার্বিটাও যথেষ্ট ছিল না। সেটা আসলে সম্ভবও হতো না। কেননা ততদিনে শুধু ঢাকা ডার্বিই নয়, দেশের গোটা ফুটবলটাই যে আকর্ষণ হারিয়ে বসেছিল!

১৯২০ সালের ১ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সুরেশচন্দ্র চৌধুরীসহ প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যরা পূর্ববঙ্গের হওয়ায় এবং ক্লাবটি পূর্ববঙ্গ থেকে আসা মানুষদের প্রতিনিধি হিসেবে গড়ে ওঠায় একে বলা হয় বাঙালদের ক্লাব। ১৮৮৯ সালের ১৫ আগস্ট জন্ম নেওয়া মোহনবাগান ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ভূপেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের এবং ঐতিহ্যগতভাবে পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় মানুষদের প্রতিনিধিত্ব করে আসায় মোহনবাগানকে ঘটিদের ক্লাব বলা হয়।

আসলে ঢাকা ডার্বির সেই পুরোনো আমেজের কথা চিন্তা করলে তা কেবল রূপকথার গল্পের মতোই মনে হয়। তখন গোটা দেশ আবাহনী ও মোহামেডানে বিভক্ত ছিল, যেটা এখন বিশ্বকাপ এলে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনায় বিভক্ত হতে দেখা যায়। বিশ্বকাপের সময় ব্রাজিল, আর্জেন্টিনার পতাকার মতোই ডার্বির বেলায়ও ঢাকা শহরসহ দেশের আনাচকানাচ ছেয়ে যেত আবাহনী ও মোহামেডানের পতাকায়।

ব্যক্তিগত গাড়িতে বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে স্টেডিয়ামের পথে একজন মোহনবাগান–ভক্ত
ছবি: লেখক

ডার্বি ম্যাচের টিকেট ছিল যেন সোনার হরিণ! টিকেট ছাড়ার আগের দিন থেকেই লাইনে দাঁড়িয়ে পড়তেন সমর্থকরা। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের টিকেট কাউন্টার থেকে সে লাইন বঙ্গবন্ধু এভিনিউ ছাড়িয়ে চলে যেত বহুদূর৷ তা ছাড়া ব্ল্যাকে টিকেট পাওয়াও বেশ কঠিন ছিল। মানুষ গায়ের মূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দাম দিয়ে কেনায় সেখানেও টিকেটের ঘাটতি তৈরি হতো। টিকেটের এমন হাহাকারে অগত্যা গ্যালারিতে পৌঁছোতে কাটাতারসমৃদ্ধ পাঁচিল টপকানোর জন্য পর্যন্ত মানুষের ঢল নামত।

ম্যাচের দিন বিকেলে খেলা মাঠে গড়ালেও সমর্থকদের সমাগমে সকাল সকালই স্টেডিয়ামচত্বর ভরে যেত। এমনকি খেলার সময় দুই দলের গ্যালারির দর্শকদের মধ্যে মারামারি ও দাঙ্গা বেধে বসত। সেইসঙ্গে ম্যাচের শেষে স্টেডিয়ামের বাইরে দুইপক্ষের সমর্থকদের মধ্যে হাতাহাতি ছিল নিত্যকার ঘটনা। এই ২০২৪ সালে এসে এগুলোকে রূপকথার গল্প ছাড়া আর কীই–বা মনে হবে বলুন!

ইস্টবেঙ্গল গ্যালারি
ছবি: লেখক

কালের পরিক্রমায় বর্তমানে ঢাকা ডার্বি রং হারিয়ে ফিকে হয়ে গেলেও আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতায় এখনও জেল্লা ধরে রেখেছে কলকাতা ডার্বি। এশিয়া মহাদেশের অন্যতম পুরোনো এ ডার্বিতে অংশ নেয় মহাদেশটির সপ্তম সর্বোচ্চ পুরোনো ফুটবল ক্লাব ইস্টবেঙ্গল ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পুরোনো ফুটবল ক্লাব মোহনবাগান। ১০৩ বছরের পুরোনো এ ডার্বিটা স্থানীয় লোকজনের মধ্যে ‘বড় ম্যাচ’ বলেও পরিচিত।

কলকাতায় ইস্টবেঙ্গলকে বলা হয় বাঙালদের ক্লাব আর মোহবাগানকে বলা হয় ঘটিদের ক্লাব। এখানে ‘বাঙাল’ ও ‘ঘটি’ হলো দুটি গোষ্ঠী। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর যাঁরা পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন, তাঁদের বলা হয় ‘বাঙাল’। পক্ষান্তরে যাঁদের পূর্বপুরুষ পশ্চিমবঙ্গের স্থায়ী বাসিন্দা, তাঁদেরকে বলা হয় ‘ঘটি’।

মূলত ১৯২০ সালের ১ আগস্ট প্রতিষ্ঠিত ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সুরেশচন্দ্র চৌধুরীসহ প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্যরা পূর্ববঙ্গের হওয়ায় এবং ক্লাবটি পূর্ববঙ্গ থেকে আসা মানুষদের প্রতিনিধি হিসেবে গড়ে ওঠায় একে বলা হয় বাঙালদের ক্লাব। অপরপক্ষে ১৮৮৯ সালের ১৫ই আগস্ট জন্ম নেওয়া মোহনবাগান ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ভূপেন্দ্রনাথ বসু ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের এবং ঐতিহ্যগতভাবে পশ্চিমবঙ্গের স্থানীয় মানুষদের প্রতিনিধিত্ব করে আসায় মোহনবাগানকে ঘটিদের ক্লাব বলা হয়।

তা ছাড়া ইস্টবেঙ্গল ক্লাবকে ‘লাল-হলুদ ব্রিগেড’ এবং মোহনবাগান ক্লাবকে ‘সবুজ-মেরুন ব্রিগেড’ ও ‘মেরিনার্স’ বলেও সম্বোধন করা হয় কলকাতায়। ইস্টবেঙ্গলকে ‘লাল-হলুদ বিগ্রেড’ ও মোহনবাগানকে ‘সবুজ-মেরুন ব্রিগেড’ বলা হয় তাদের ঐতিহ্যবাহী লোগো ও জার্সির রঙগুলোর সঙ্গে মিল রেখে। লাল-হলুদ রঙ দুটি ইস্টবেঙ্গলের শক্তি, উজ্জ্বলতা ও একাত্মতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এখানে লাল রং শক্তি ও সাহসের প্রতীক হিসেবে এবং হলুদ রং উজ্জ্বলতা ও আনন্দের প্রতীক হিসেবে গণ্য। অন্যদিকে সবুজ রং সাধারণত নতুনত্ব, আশা ও শক্তির প্রতীক হিসেবে ধরা হয়, যা মোহনবাগানের তারুণ্য ও উদ্দীপনাকে প্রকাশ করে। আর মেরুন রং গৌরব, মর্যাদা ও ঐতিহ্যের প্রতীক, যা মোহনবাগানের দীর্ঘ এবং গৌরবময় ইতিহাসকে প্রতিফলিত করে।

ম্যাচের আগে স্টেডিয়াম গেইটের সামনে স্লোগানে মুখরিত ইস্টবেঙ্গল আল্ট্রাস
ছবি: লেখক

একইসঙ্গে মোহনবাগানকে ‘মেরিনার্স’ নামেও ডাকা হয়, কারণ এটি ক্লাবের শক্তি ও অদম্যতাকে প্রতিফলিত করে, ঠিক যেমন একজন নাবিক সমুদ্রের প্রতিকূলতার মধ্যে দাঁড়িয়েও নিজের জায়গায় অবিচল থাকেন। তা ছাড়া মোহনবাগানের লোগোতেও একটি পালতোলা নৌকা রয়েছে, যা তাঁদের ‘মেরিনার্স’ নামে পরিচিত হওয়ার একটি প্রতীকী কারণ।

এই দুই ক্লাবের সমর্থকদের আবার বিদ্রুপাত্মক দুটো নাম রয়েছে। বিদ্রুপ করে মোহনবাগান সমর্থকদের ইস্টবেঙ্গল সমর্থকেরা ‘মাচা’ এবং ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের মোহনবাগান সমর্থকেরা ‘লোটা’ বলে থাকেন। ধারণা করা হয়, বাঙালদের খাদ্য ‘লোটে’ বা ‘লইট্টা’ থেকে ‘লোটা’ এবং মোহনবাগানের লোগো পালতোলা নৌকার অংশবিশেষ থেকে ‘মাচা’ শব্দটি এসেছে।

সেইসাথে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান দ্বৈরথ ইলিশ-চিংড়ির দ্বৈরথ হিসেবেও পরিচিত। এর নেপথ্যের কারণটা সহজেই অনুমেয়। বাঙালদের প্রিয় ইলিশ এবং ঘটিদের যে প্রিয় চিংড়ি! ডার্বির দিন তাই বাজারে ইলিশ-চিংড়ি বেচাকেনারও ধুম পড়ে যায়।

কলকাতা ডার্বি ও ডার্বিতে অংশগ্রহণকারী দুই ক্লাবের পরিচয় ও ইতিহাস নিয়ে তো যথেষ্ট কপচানো হলো! এখন পুনরায় প্রসঙ্গে ফেরা যাক। গেল ১৯ অক্টোবর ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান দ্বৈরথের উন্মাদনা দেখতে আমি হাজির হই ‘সিটি অব জয়’ অর্থাৎ আনন্দনগরীখ্যাত কলকাতায়। উন্মত্ত সমর্থকে ভর্তি গ্যালারিতে কোনো দিন ঢাকা ডার্বি উপভোগ করতে না পারার আক্ষেপটা কিছুটা হলেও ঘোচানোর উদ্দেশ্যেই আমার সে যাত্রা। ওই যে দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো বলে একটা কথা আছে না, সে-রকমই আরকি!
আমার কাছে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান লড়াই মাঠে বসে দেখাটা আজীবন মনে রাখার মতো একটা অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে। আমাদের আবাহনী-মোহামেডানের সোনালি অতীতের যে ঘটনাগুলোকে এখন রূপকথার গল্প বলে মনে হয়, সেগুলোর অস্তিত্বও আমি খুঁজে পেয়েছি কলকাতা ডার্বির মধ্যে।

ডার্বির দিন স্টেডিয়াম পাড়ায় পুরো আলাদা একটা পরিবেশ তৈরি হয়। ম্যাচ সন্ধ্যায় মাঠে গড়ালেও দুপুর থেকেই স্টেডিয়ামের আশেপাশে সমর্থকদের আনাগোনা শুরু হয়ে যায়। আর বিকেল থেকে দল বেধে পুরোদমে তাঁরা হাজির হতে থাকেন সল্ট লেকের বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে। বেশিরভাগ সমর্থকেরই গায়ে থাকে নিজ নিজ ক্লাবের জার্সি। তাই যেদিকেই তাকানো যায়, শুধু লাল-হলুদ ও সবুজ-মেরুন রঙ চোখে পড়ে।

এর মধ্যে কিছু কিছু দৃশ্য একদম মন কেড়ে নেয়। তেমনই একটা দৃশ্য হলো একজন বাবার বাইকে করে স্ত্রী ও প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেকে নিয়ে স্টেডিয়ামে যাওয়াটা। মজার ব্যাপার হলো, বাবা ও ছেলের গায়ে মোহনবাগানের জার্সি জড়ানো থাকলেও মায়ের গায়ের জার্সিটা ইস্টবেঙ্গলের। দৃশ্যটা দেখার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা ডার্বির পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে একদিন আমাদের আবাহনীর চুন্নু ভাইয়ের বলা এ কথাগুলো মনে পড়ে যায় আমার, ‘এখন তো ফুটবল নিয়ে আলোচনাই হয় না ঘরের মধ্যে। অথচ একটা সময় আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথ এতটাই গুরুতর ছিল যে পরের দিন মা-মেয়ে ও ছেলে-বাবার মধ্যে মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ হয়ে যেত।’

মোহনবাগান গ্যালারি
ছবি: লেখক

কলকাতা ডার্বির দিন বাইক নিয়ে সমর্থকদের দলবদ্ধ অবস্থায় সল্ট লেকের রাস্তায় দেখা যায়। দেখে মনে হয় যেন বাইকের শোভাযাত্রা, বাংলাদেশে যা কোনো রাজনৈতিক দলের শোভাযাত্রা ও সভা-সমাবেশের দিন চোখে পড়ে। সেইসাথে একের পর এক পিকআপ ভর্তি করেও স্টেডিয়ামে আসতে দেখা যায় ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান সমর্থকদের। তাঁদের পিকআপে থাকে স্পিকারের বন্দোবস্ত, যেটার মাধ্যমে আসার পথে নিজ নিজ ক্লাবের থিম সং টানা বাজাতে থাকেন তাঁরা। আর যদি দুই দলের সমর্থকভর্তি দুইটা পিকআপ একবার পাশাপাশি হয়ে যায়, তাহলেই শুরু হয় মুখের লড়াই৷ একদল আরেক দলকে বিরতিহীনভাবে স্লেজ করতে থাকে। ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের গলায় শোনা যায়, ‘জাতে বাঙাল সবার সেরা, ইস্টবেঙ্গল মাঠের রাজা, তাই তো বলি আসছে দিন, মাচাবাগানকে পুঁতে দিন।’ ওই দিকে মোহনবাগান সমর্থকেরা এর জবাব দেন এই বলে, ‘যতবার ডার্বি, লোটা তোরা হারবি।’

এমনকি এ স্লেজিং অব্যাহত থাকে রাস্তা কিংবা ফুটপাত ধরে পায়ে হেঁটে খেলা দেখতে আসা সমর্থকদের মধ্যেও। কেউ কাউকে চেনেন না অথচ বিপক্ষ দলের জার্সিতে কাউকে দেখামাত্রই বিদ্রুপ করে কিছু একটা বলে বসছেন! যদিও ঘণ্টা দেড়েকের মতো স্টেডিয়ামের চারপাশ ঘুরে এসব পর্যবেক্ষণ করার সময়টায় একবারও মুখের ভাষায় কোনো ব্যক্তি বা সমর্থকগোষ্ঠীকে সীমা লঙ্ঘন করতে দেখিনি আমি। কথার মাধ্যমে একদলের খোঁচার বিপরীতে আরেকদল কেবল পাল্টা খোঁচাই দেন এবং তাঁদের খোঁচাখুঁচি এভাবেই চলতে থাকে। তবে হিট অব দ্য মোমেন্টের বশীভূত হয়ে কেউ মেজাজ হারান না। সে জন্য কোনো হাতাহাতি বা মারামারিও বেধে যায় না দুই সমর্থকগোষ্ঠীর মধ্যে। বলতেই হয়, তাঁদের এই মুখের লড়াইটা ছিল খুবই সুস্থ একটা লড়াই।

একসময় আবাহনী-মোহামেডান ম্যাচের দিনেও এমন গণজমায়েত হতো তৎকালীন ঢাকা স্টেডিয়ামে, যা বর্তমানে বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়াম নামে পরিচিত। ধানমন্ডি থেকে ট্রাকভর্তি করে আবাহনী সমর্থকরা খেলা দেখতে আসতেন মতিঝিলে। অন্যদিকে মোহামেডান সমর্থকরা মতিঝিলের নিজেদের ক্লাবপাড়া থেকে লম্বা র‍্যালি নিয়ে স্টেডিয়ামে ঢুকতেন। তখন সমর্থকদের সে কী উন্মাদনা! একবার তো স্টেডিয়ামের একপাশের দেয়ালই ভেঙে পড়ে তাঁদের ভারে!

বিবেকানন্দ যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন, যা সল্ট লেক স্টেডিয়াম নামেও পরিচিত
ছবি: লেখক

আবাহনী-মোহামেডান দ্বৈরথের সেই স্বর্ণালি সময় থেকেই এখন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের দুইটা পৃথক গ্যালারি এই দুই দলের সমর্থকদের দখলে। প্রেসবক্সের ডান দিকেরটা আবাহনী গ্যালারি এবং বাম দিকেরটা মোহামেডান গ্যালারি। ঠিক তেমনি যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনেও উত্তর-পূর্ব গ্যালারি ইস্টবেঙ্গল এবং দক্ষিণ-পশ্চিম গ্যালারি মোহনবাগান সমর্থকদের জন্য বরাদ্ধ। কলকাতা ডার্বির দিন সমর্থকদের জার্সির লাল-হলুদ ও সবুজ-মেরুন রঙে ছেয়ে যায় এই গ্যালারিগুলো। সেইসঙ্গে দুই দলের গ্যালারিতেই মেলে ধরা হয় সুন্দর সুন্দর টিফো।

গেল ১৯ অক্টোবরের কলকাতা ডার্বিতে আমার জায়গা হয় লাল-হলুদের মহাসমুদ্রে অর্থাৎ ইস্টবেঙ্গল গ্যালারিতে। সেদিন ৮৫ হাজার ধারণক্ষমতার যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গনে ৬০ হাজারেরও বেশি মানুষ গ্যালারিতে বসে ম্যাচটা উপভোগ করেছিল। এখানে ‘উপভোগ’ শব্দটা যথোপযুক্ত হলো কি না, ভাবছি। আর যা-ই হোক, অন্তত ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের জন্য ম্যাচটা মোটেও উপভোগ্য হবার কথা নয়। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীদের বিপক্ষে ০-২ গোলে হারা ম্যাচটা উপভোগ করার সুযোগ কী আর হয়!

এমনিতে ছন্দে ও শক্তিমত্তায় মোহনবাগানের চেয়ে বেশ পিছিয়ে ছিল ইস্টবেঙ্গল। মাঠের খেলায়ও সে ছাপ ছিল একদম স্পষ্ট। রক্ষণভাগ ছিল বেশ নড়বড়ে, মাঝমাঠে ছিল না নিয়ন্ত্রণ এবং আক্রমণভাগ ছিল সম্পূর্ণ নির্বিষ। শুধু গোলরক্ষক প্রভসুখন সিং গিল যা একটু নজর কেড়েছেন লাল-হলুদ ব্রিগেডের হয়ে। প্রকৃতপক্ষে তাঁর কারণেই ইস্টবেঙ্গলের পরাজয়ের ব্যবধানটা মোটামুটি সহনীয় পর্যায়ে ছিল। নয়তো প্রথমার্ধেই ম্যাচের ফলাফলের চেয়ে বেশি ব্যবধানে এগিয়ে যেত মোহনবাগান। সেক্ষেত্রে ম্যাচশেষে ফলাফলটা কী দাঁড়াত, বুঝতে পারছেন নিশ্চয়!

ইস্টবেঙ্গল গ্যালারির মিনি গেটের সামনে লেখক
ছবি: লেখকের সৌজন্য

আদতে কলকাতা ডার্বির উন্মত্ততা কতটুকু, তা লিখে শেষ করা যাবে না। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সে উন্মত্ততাকে আরও সমৃদ্ধ করেছে ক্লাব দুটির আল্ট্রাস সমর্থকগোষ্ঠী। ম্যাচের আগে তাঁরা নিজ নিজ গেইটের বাইরে একত্রিত হয়ে ড্রাম পিটিয়ে মাইক হাতে স্লোগান দিয়ে থাকেন। সেইসঙ্গে ইস্টবেঙ্গল আল্ট্রাস লাল-হলুদ এবং মোহনবাগান আল্ট্রাস সবুজ-মেরুন ফ্লেয়ারও ওড়িয়ে থাকে। তা ছাড়া মাঠে দলের বিপক্ষে রেফারির কোনো সিদ্ধান্ত মনঃপুত না হলে তাঁরা গ্যালারি থেকে রেফারিকে নানা প্রকার হুমকি দিয়ে থাকেন, যেমনটা সোনালি সময়ের ঢাকা ডার্বিতে নিয়মিত দেখা যেত।

ওই দিকে ম্যাচ শেষে স্টেডিয়ামের বাইরে ঠিক ম্যাচ শুরুর আগের চিত্রটারই দেখা মেলে। পিকআপে, বাইকে কিংবা পায়ে হেঁটে বাড়ি যাবার পথেও ক্লাবের থিম সং বাজানো ও স্লেজিং অব্যাহত থাকে সমর্থকদের। কিন্তু পার্থক্য একটাই, ক্লাবের থিম সং না বাজানোর পাশাপাশি পাল্টা স্লেজ না করে বরং চুপচাপ সবকিছু সয়ে পথ মাড়াতে দেখা যায় পরাজিত সমর্থকদের। তা ছাড়া যাবার পথে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন দোকানে জয়ী ক্লাবের থিম সং বাজতেও শোনা যায়।

সব মিলিয়ে এই হলো আমার কলকাতা ডার্বি দেখার অভিজ্ঞতা। উন্মত্ত ঢাকা ডার্বি গ্যালারিতে বসে দেখতে না পারার আক্ষেপে প্রলেপ দেওয়ার উদ্দেশ্যে কলকাতা ডার্বি দেখতে গিয়ে বরং সেই আক্ষেপটাকে আরও গাঢ় করেই দেশে ফিরি আমি। ইশ! আমাদের ঢাকা ডার্বির জৌলুসটাও যদি এ রকম টিকে থাকত কিংবা যদি কোনো একদিন এমন একটা আবহে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ডার্বি ম্যাচে আকাশি-নীল জার্সিটা পরে আবাহনী গ্যালারিতে গলা ফাটানো উন্মাদনায় শামিল হতে পারতাম!

*পাঠকেরা লেখা, ছবি ও ভিডিও পাঠাতে পারবেন [email protected]