উদিত হোক সম্ভাবনার নতুন সূর্য

নতুন সূর্যছবি: রয়টার্স

২০২৫! বিদায়টা শোকের। অবসান হলো বর্ণাঢ্য এক রাজনৈতিক জীবনের। গৃহবধূ থেকে বাধ্য হয়ে রাজনীতির হাল ধরেছিলেন। গণতন্ত্রের আন্দোলন সংগ্রামে অসামান্য অবদানের জন্য জনগণের মুখে মুখে ছিল আপসহীন নেত্রীর খেতাব। জেল–জুলুম আর শত অত্যাচারেও গণতন্ত্রকে মুক্ত করতে অবিরাম সংগ্রাম করেছেন। নারী শিক্ষার প্রসারে যুগান্তকারী ভূমিকার সুফল আজ বাংলার ঘরে ঘরে।

জীবনে কোনো নির্বাচনে পরাজিত হননি। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী। স্বল্পভাষী আর দৃঢ়চেতা বৈশিষ্ট্যের কারণে গ্রহণযোগ্যতা ছিল ঈর্ষণীয়। হাজারো প্রতিকূলতার পরেও শক্ত হাতে মধ্যপন্থার রাজনীতিকে টিকিয়ে রেখেছিলেন। সেই মহীয়সী খালেদা জিয়ার চিরবিদায়ে বাংলার আকাশে আজ মেঘের গর্জন। চরম ডান আর উগ্রপন্থার উত্থানে সমাজজীবন যখন অস্থির, সে সময়ে নাগরিক জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে তাঁর অপূরণীয় শূন্যতা অনূভব করবে সমাজ ও রাষ্ট্র।

আশা–নিরাশার এক চরম দ্বান্দ্বিক সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশ। ব্যক্তি থেকে পরিবার, সমাজ থেকে রাষ্ট্র, সর্বত্র যেন এক সর্বনাশার খেলা। সকালের শত্রু, বিকেলে মিত্র। রাতের মিত্র, ভোরের প্রতিদ্বন্দ্বী! টালমাটাল পঁচিশে জাতি সংস্কার, বিচার আর নির্বাচনের কথা শুনেছে। নতুন বন্দোবস্তে অভিনব এক নতুন সমাজের গল্প শুনেছে। রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিভাজনকে পরিহার করে ঐক্যের হাওয়া দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। শান্তি বিজয়ীর আহ্বানে দলে দলে রাজনীতিকেরা যমুনামুখী হয়েছেন। মবোক্রেসি নামক এক ভয়াবহ তাণ্ডব জনজীবনকে তছনছ করে দিয়েছে। একাত্তরের ধারাবাহিকতার কথা বলে, একাত্তরকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। ঐতিহ্যের গৌরবগাঁথা, নগ্ন থাবায় ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। রাজনৈতিক স্লোগানে অশ্লীলতার আবিষ্কার দেখে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চিন্তায় প্রবীণ হৃদয় হয়েছে ক্ষতবিক্ষত।

কথা ছিল কোটার স্থলে মেধা হবে। ওরা বৈষম্যের বিপরীতে সাম্যের কথা বলেছিল। বিভাজনের পরিবর্তে সম্প্রীতির গান গেয়েছিল। দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করে আইনের শাসনের স্বপ্ন দেখিয়েছিল। শিক্ষাবান্ধব শিক্ষাঙ্গন তৈরির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সাদা–নীলের বিভাজনে বিপর্যস্ত শিক্ষাঙ্গনকে রাহুমুক্ত করতে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। দলবাজ প্রশাসনের পরিবর্তে, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখিয়েছিল। চব্বিশের অভ্যুত্থানের সুফলের অপেক্ষায় জাতি একটি বছর অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছিল।

না, পঁচিশ কোটার পরিবর্তে মেধাকে নিশ্চিত করতে পারেনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করে বারবার রাষ্ট্রকে অস্থির করার চেষ্টা হলেও রাষ্ট্র নির্বিকার থেকেছে। তড়িঘড়ি করে চট্টগ্রাম বন্দরের অপ্রকাশযোগ্য চুক্তি জনমনে নানা রকম সন্দেহ তৈরি করেছে। কক্সবাজার, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের দৌরাত্ম্য আর আরাকান বাহিনীর তৎপরতা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মনে নানা রকম ভীতি সঞ্চার করেছে। ২৫–এর পুরোটা সময় শিল্পায়ন, নগরায়ণ আর নতুন কর্মসৃজনে স্থবিরতা বিরাজ করেছে। অনেক কলকারখানা বন্ধ হওয়ার ফলে শ্রমিক অসন্তোষে শিল্পাঞ্চল উত্তপ্ত হয়েছে। নতুন নতুন গল্প শোনা গেলেও, কার্যকর বৈদেশিক বিনিয়োগের কোনো দিশা মেলেনি।

শিক্ষা আর মতপ্রকাশের ওপর আঘাত অপূরণীয় ক্ষতির কারণ হয়েছে। ‘ছাত্ররা আমার নিয়োগ কর্তা’—প্রধান উপদেষ্টার এই অমোঘ বাণীতে উদ্দীপ্ত হয়ে তরুণ সমাজের অনেকেই অনেক অপব্যবহার করেছে। সাম্প্রতিককালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের জিএস নিজে পদত্যাগপত্র তৈরি করে, ডিনদের স্বাক্ষর নিয়েছেন। গর্ব করে এই অপকর্মটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার করেছেন। আইন, রাষ্ট্র সরকার সবকিছু দেখেও না দেখার ভান করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোও জনগণের সামনে কোনো বিশ্বাসযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেনি।

জুলাই ঘোষণাপত্র নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরবিরোধী বক্তব্য রাজনীতির ইতিহাসে কলঙ্ক লেপন করেছে। স্বাক্ষর করা ঘোষণাপত্র আর চূড়ান্ত ঘোষণাপত্রের অমিল নিয়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত বক্তব্য থেকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক দেউলিয়াত্বের চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। বহুল প্রত্যাশিত জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হলেও, গণভোট যেন এক গণ বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, দেশে পড়তে ও লিখতে পারেন (শিশু ও আঠারো বছরের কম বয়সীসহ) এমন জনসংখ্যার হার ৬২ দশমিক ৯২ শতাংশ। আঠারো বছরের কম বয়সীদের বাদ দিলে এ সংখ্যাটি ৫০ শতাংশেরও নিচে। গণভোট নিয়ে নির্বাচন কমিশনের প্রশ্নপত্র বুঝতে হলে জুলাই সনদ পড়ার বিকল্প নেই। যে দেশের নব্বই শতাংশ মানুষের, জুলাই সনদে কি আছে তার দেখার সৌভাগ্য হয়নি আর ৫০ শতাংশ জনগোষ্ঠী পড়তে পারে না, তাদের জন্য এক পৃষ্ঠার নির্বাচনী ধারাবিবরণী, এর চেয়ে বড় নির্বাচনী কৌতুক আর কি হতে পারে? এমন কৌতুকের ফলাফল দিয়েই নাকি নির্ধারিত হবে জাতির ভবিষ্যৎ ভাগ্যলিপি তথা সংবিধান!!

নাগরিক সংবাদ–এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

যুগে যুগে গণমাধ্যমে আক্রমণের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদী আর স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটে। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর শুভাগমনের সময় নির্ভয়ে, নিঃসংকোচে মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করার কথা বলেছিলেন। জাতি, প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারের ওপর আঘাতের মধ্য দিয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার স্বরূপ দেখেছে। ছায়ানটের অগ্নিকাণ্ড সংস্কৃতি বোদ্ধাদের হৃদয়ে রক্তক্ষরণ তৈরি করেছে। দীপু দাসের দেহ শুধু দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রে অস্থিরতার মাত্রাকে বাড়িয়ে তোলেনি, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ ও শান্তির ধর্ম ইসলামের ভাবমূর্তিও চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

বছরজুড়ে নানা শঙ্কা, সংশয়ের পরও জাতি একটি গ্রহণযোগ্য, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের স্বপ্ন দেখেছে। একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে অস্থির, উত্তাল সমাজে স্বস্তির প্রত্যাশা করেছে। নানা সংশয়, সন্দেহ আর অনিশ্চয়তার পর ২৫ ডিসেম্বর তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন গণতন্ত্রকামী মানুষের মনে নতুন আশার সঞ্চার করেছে। শুধু দলীয় নেতাকর্মী নয়, সাধারণ আমজনতা হৃদয় দিয়ে তার আগমনকে স্বাগত জানিয়েছে।

গ্রামেগঞ্জের মানুষের মুখেও স্বপ্নের হাসির ঝিলিক ফুটেছে। তারেক রহমান বিশাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে, পরিশীলিত আর সুললিত বক্তব্যের মধ্য দিয়ে দলমত নির্বিশেষে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ভালোবাসা কুড়িয়েছেন। সতেরো বছরের ব্রিটিশ সমাজব্যবস্থার অভিজ্ঞতার কিছু প্রতিফলনও ইতিমধ্যে প্রতিভাত হয়েছে। সবার অন্তর্ভুক্তি ছাড়া গণতন্ত্র অর্থহীন, ব্রিটিশ গণতন্ত্রের এই শিক্ষাটিও তাঁর অজানা থাকার কথা নয়। তাঁর আগামী দিনের পরিকল্পনা কি নতুন বার্তা নিয়ে আসে—জনগণ আজ সে প্রতীক্ষায়।

ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হয়েছে। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী মনোনয়নপত্র জমা দানের সময়সীমাও শেষ। নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক মেরুকরণ নতুন কিছু নয়। আদর্শের লক্ষ্য পূরণে সমঝোতা, জোট, দলবদল রাজনীতির খুবই স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য। পৃথিবীর প্রতিটি গণতান্ত্রিক দেশেই এমন মেরুকরণ হয়। তবে আদর্শহীন ও লক্ষ্য বিচ্যুত মেরুকরণ স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এবারের নির্বাচনকে ঘিরে মেরুকরণের ঘটনা যেন উদ্‌ভ্রান্ত পাগলের মনেও প্রশ্নের উদ্রেক করেছে।

মানুষ প্রত্যাশাকে নিয়েই বেঁচে থাকে। সমাজ সেই প্রত্যাশাকে সম্ভাবনায় পরিণত করে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব সম্ভাবনাকে সমৃদ্ধ করে এগিয়ে চলা। আর রাজনীতিকেরা রাষ্ট্রের চালক হয়ে ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে। চব্বিশের অভ্যুত্থান পরবর্তী এনসিপি নতুন রাজনৈতিক দল হিসেবে প্রত্যাশা তৈরি করলেও, তাঁদের কর্মকাণ্ড প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি।

দেশপ্রেমবিবর্জিত ক্ষমতা বলয়, এ জনপদে চরম বিপদ ডেকে আনতে পারে। নীতিহীনতার উন্মাদনায় রাজনৈতিক অঙ্গনে যতই হাসির খোরাক হোক, রাজনীতিকেরাই শেষ ভরষা, রাষ্ট্রের নিয়ন্তা। ফেব্রুয়ারির নির্বাচনে সততা আর দেশপ্রেম হোক অন্যতম মাপকাঠি। একদল সৎ দেশপ্রেমিকের সমন্বয়ে গঠিত হোক আগামীর সংসদ। জনতার হয়ে জনতার সংসদে নির্ধারিত হোক আগামী দিনের বাংলাদেশ। অস্থিরতা আর অনিশ্চয়তার বিপরীতে ২০২৬ হোক প্রত্যাশা আর সম্ভাবনার, অন্ধকারের বিপরীতে আলোর ঝলকানির।

লেখক: কলামিস্ট ও সমাজতাত্ত্বিক বিশ্লেষক