মাউশির ‘মা’ মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর হলে ‘উশি’ কেন কলেজ শিক্ষা অধিদপ্তর?
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) নতুন করে পুনর্গঠনের প্রক্রিয়া চলছে। মাউশি ভেঙে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও কলেজ শিক্ষা অধিদপ্তর নামে দুটি অধিদপ্তর সৃষ্টির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। মাউশি ভাঙনের প্রক্রিয়ায় তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারে। মূলত দুটি কারণে শিক্ষা ক্যাডারে চরম অসন্তোষ তৈরি হয়েছে—উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা অধিদপ্তর নামের পরিবর্তে কলেজ শিক্ষা অধিদপ্তর নাম চূড়ান্ত করা এবং মাউশি ভেঙে প্রস্তাবিত মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরসহ দুটি অধিদপ্তরের পদ–পদবিগুলো শিক্ষা সার্ভিসবহির্ভূত জনবল দ্বারা দখল হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা।
উচ্চশিক্ষা স্তরের প্রায় ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত সারা দেশের বিভিন্ন সরকারি–বেসরকারি কলেজগুলোয় পড়ছেন। অথচ এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দেখভালকারী প্রশাসনিক কাঠামোর নাম দেওয়া হচ্ছে ‘কলেজ শিক্ষা অধিদপ্তর’! এরই মধ্যে ঢাকা শহরের সাতটি সরকারি কলেজের শিক্ষার্থীরা উচ্চশিক্ষার সুযোগ–সুবিধা ও গবেষণার পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবিতে আলাদা বিশ্ববিদ্যালয় দাবি করেছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে সাতটি কলেজসহ সারা দেশের স্নাতক–স্নাতকোত্তর পাঠদানকারী কলেজগুলোয় উচ্চশিক্ষার পর্যাপ্ত সুযোগ–সুবিধা বৃদ্ধি করার প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠান পরিচালনাকারী প্রশাসনিক দপ্তর হিসেবে মাউশিকে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা অধিদপ্তর হিসেবে সম্প্রসারণ করা যেখানে সময়ের দাবি, সেখানে উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকে কলেজ শিক্ষা অধিদপ্তর করার মাধ্যমে কলেজকেন্দ্রিক উচ্চশিক্ষাব্যবস্থা সংকোচন করার পথে হাঁটা হচ্ছে। এ সিদ্ধান্তকে হঠকারী হিসেবে দেখছেন শিক্ষা পেশাজীবীরা।
মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) ভেঙে দুটি অধিদপ্তর করার ক্ষেত্রে মাউশির ‘মা’ অংশ নিয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর করা হলে বাকি অংশ ‘উশি’ নিয়ে উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর করাই যুক্তিযুক্ত ছিল; সঙ্গে উচ্চশিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদা ও সুযোগ–সুবিধা নিশ্চিত করার জন্য গবেষণাকে প্রাধান্য দিয়ে এ কার্যক্রম জোরদার করার প্রয়োজনে গবেষণা অংশ যোগ করে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা অধিদপ্তর করা হতো সময়োপযোগী পদক্ষেপ। সেটা না করে উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকে কলেজ শিক্ষা অধিদপ্তর নামকরণের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষার সংকোচনমুখী নীতি অনুসরণ করা হচ্ছে।
এ সিদ্ধান্তের ফলে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের প্রায় ১৭ হাজার কর্মকর্তা অস্তিত্ব ও মর্যাদার সংকটে পড়তে যাচ্ছেন। দেশের সাধারণ তথা সার্বিক শিক্ষায় নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন ও শিক্ষা প্রশাসন পরিচালনার জন্যই মূলত ১৯৮০ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের প্রশাসন, পুলিশ, খাদ্য, করসহ অন্যান্য ক্যাডারের সঙ্গে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডার গঠন করা হয়েছিল। এরই ধারাবাহিকতায় শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তারা শিক্ষকতার পাশাপাশি শিক্ষা প্রশাসনের বিভিন্ন দপ্তরেও দায়িত্ব পালন করে থাকেন। কিন্তু উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর থেকে কলেজ শিক্ষা অধিদপ্তর গঠন করার সিদ্ধান্তকে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারকে কলেজ শিক্ষা ক্যাডারে পরিণত করার পরিকল্পনার অংশ মনে করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে এ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের শ্রেণিকক্ষে সীমাবদ্ধ করে ফেলার আশঙ্কাও তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর থেকে শিক্ষা ক্যাডারের মাতৃপ্রতিষ্ঠানের নাম কলেজ শিক্ষা অধিদপ্তর করার ফলে এ ক্যাডারের কর্মকর্তারা সামাজিক মর্যাদাহানি ও মানসিক পীড়নের সম্মুখীন হবেন বলেও ধারণা করা হচ্ছে।
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই–মেইল: [email protected]
মাউশি ভেঙে একটি অংশের নাম মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও অন্যটির নাম কলেজ শিক্ষা অধিদপ্তর করার সিদ্ধান্ত অযৌক্তিকও বটে। কারণ, প্রতিষ্ঠানের নামে কখনো অধিদপ্তর হয় না, অধিদপ্তর হয় শিক্ষার স্তরের নামে। পৃথিবীর কোনো দেশে স্কুল শিক্ষা অধিদপ্তর, ইউনিভার্সিটি শিক্ষা অধিদপ্তর নামে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। এর আগে প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরও আমলাতন্ত্রের অজ্ঞতা ও অদূরদর্শিতার ফসল। মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের নাম হওয়া উচিত ছিল—ধর্মীয় শিক্ষা অধিদপ্তর। এ রকম আরেকটি ভুল ও অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের কবলে পড়তে যাচ্ছে এ দেশের শিক্ষাব্যবস্থা।
এ ভুল শুধরে নেওয়ার এখনো পর্যাপ্ত সময় আছে। প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের নামে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর, মাধ্যমিক শিক্ষা স্তরের নামে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কিংবা কারিগরি শিক্ষা স্তরের নামে কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মতোই মাউশির পরিবর্তিত নাম উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর করাই যুক্তিযুক্ত হবে। কারণ, সরকারি–বেসরকারি কলেজগুলো উচ্চমাধ্যমিকের পাশাপাশি মূলত স্নাতক–স্নাতকোত্তর পর্যায়ের উচ্চশিক্ষা স্তরের প্রতিষ্ঠান। সুতরাং উচ্চশিক্ষা স্তরের নাম অনুযায়ী মাউশির পরিবর্তিত নাম উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা অধিদপ্তর হওয়াই বাস্তবসম্মত।
মাউশি ভেঙে কলেজ শিক্ষা অধিদপ্তর নামকরণ করার সিদ্ধান্তকে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০–এর লঙ্ঘন হিসেবেও দেখছেন শিক্ষাবিদেরা। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০–এর অধ্যায় ২৭, কৌশল ৬–এ মাউশি ভেঙে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে। এ ছাড়া কলেজ এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (সিইডিপি) কর্তৃক আয়োজিত ইমপ্যাক্ট অ্যানালাইসিস অন এডুকেশন ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড গর্ভন্যান্স শীর্ষক কর্মশালার সুপারিশের ভিত্তিতে প্রণীত বিয়াম ফাউন্ডেশন গবেষণা ও পরামর্শ সেবাকেন্দ্র কর্তৃক দাখিল করা প্রতিবেদনে শিক্ষা প্রশাসনের বর্তমান প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো মাউশি ভেঙে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা অধিদপ্তর করার পরামর্শ দেওয়া হয়। আবার ২০২৪ সালের ২৮ নভেম্বর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ কর্তৃক দাখিল করা সময়াবদ্ধ সংস্কার পরিকল্পনায় মাউশি পুনর্গঠন করে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর এবং উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা অধিদপ্তর নামে দুটি অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়। মাউশি বিভক্তকরণের জন্য মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রেরিত প্রস্তাবে এসব সুপারিশকে সংলাপ–১, ২ ও ৩ হিসেবে দেখানো হয়েছে।
শিক্ষা প্রশাসন ব্যবস্থাপনার বর্তমান কাঠামো পুনর্গঠনসংক্রান্ত উপর্যুক্ত তিনটি সংলাপের দুটিতেই মাউশির পরিবর্তিত নাম উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা অধিদপ্তর এবং অন্যটিতে উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর করার সুপারিশ করা হয়েছিল। অথচ শিক্ষা মন্ত্রণালয় পূর্বোক্ত তিনটি সুপারিশকে উপেক্ষা করে শুধু ২০২৫ সালে প্রদত্ত জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের সুপারিশকে আমলে নিয়ে মাউশি ভেঙে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও কলেজ শিক্ষা অধিদপ্তর করার জন্য প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে প্রস্তাব পাঠায় এবং প্রস্তাব অনুমোদনও পায়। এখন এ দুটি অধিদপ্তরের অর্গানোগ্রাম ও কার্যতালিকা তৈরির কাজ চলছে।
কলেজ শিক্ষা অধিদপ্তর নামকরণের ফলে শিক্ষা ক্যাডারের কর্মক্ষেত্র আরও সংকীর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এতে এ ক্যাডার মেধাবীদের আকর্ষণ হারাবে এবং ভবিষ্যতে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসতে নিরুৎসাহিত হবেন। কারণ, শ্রেণি শিক্ষকতার পাশাপাশি শিক্ষার বিভিন্ন প্রশাসনিক দপ্তরে কাজ করার সুযোগ রয়েছে শিক্ষা ক্যাডারে। উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরকে কলেজ শিক্ষা অধিদপ্তর নামকরণের মাধ্যমে এ সুযোগ সংকোচন করার চেষ্টা চলবে। ফলে শিক্ষা ক্যাডার আরও অনাকর্ষণীয় হবে। এতে মেধাবীরা শিক্ষাকে বিসিএস পরীক্ষার চয়েস লিস্টে রাখতে আর আগ্রহী হবেন না।
মাউশিকে দুই ভাগ করে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর ও কলেজ শিক্ষা অধিদপ্তর করার প্রক্রিয়াকে অনেকেই শিক্ষা প্রশাসন থেকে শিক্ষা পেশাজীবীদের বিতাড়িত করে অশিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা হিসেবেও দেখছেন। কারণ, এর আগে মাউশির পূর্বতন প্রতিষ্ঠান ডিপিআই (ডিপার্টমেন্ট অব পাবলিক ইনস্ট্রাকশন) ভেঙে কারিগরি, প্রাথমিক ও মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করে সেসব প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে শিক্ষা সার্ভিসবহির্ভূত একটি ক্যাডার। সর্বশেষ মাউশি ভেঙে দুই ভাগ করার এ প্রক্রিয়াও একদিকে শিক্ষা প্রশাসনে অশিক্ষকদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা, অন্যদিকে শিক্ষা প্রশাসন থেকে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারের কর্মকর্তাদের সরিয়ে শুধু কলেজকেন্দ্রিক শ্রেণি শিক্ষকতায় তাঁদেরকে সীমাবদ্ধ করার চেষ্টা বলে মনে হচ্ছে। উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিবর্তে কলেজ শিক্ষা অধিদপ্তর নামকরণ সে চেষ্টারই প্রাথমিক ধাপ বলে ধারণা করা হচ্ছে।
দেশের টারশিয়ারি শিক্ষার স্বার্থে বিসিএস সাধারণ শিক্ষা ক্যাডারকে আকর্ষণীয় ও মেধাবীদের প্রায়োরিটি লিস্টে প্রথম দিকে রাখতে হবে। এ জন্য এই ক্যাডারকে আকর্ষণীয় করার বিকল্প নেই। এমনিতেই জুলাই সনদে শিক্ষার জন্য আলাদা পিএসসি গঠনের সুপারিশ থাকায় শিক্ষা দ্বিতীয় শ্রেণির ক্যাডারে পরিণত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তার ওপর কলেজ শিক্ষা অধিদপ্তর নামকরণের এ সিদ্ধান্ত শিক্ষা ক্যাডারের জন্য আরেকটি আঘাত। এতে মেধাবীরা আরও বেশি শিক্ষা ক্যাডারবিমুখ হতে পারেন, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়বে দেশের কলেজকেন্দ্রিক স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শিক্ষায়। এমতাবস্থায় কলেজ পর্যায়ে মানসম্মত উচ্চশিক্ষা ও গবেষণার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ–সুবিধা ও নীতি–পরিকল্পনা বাস্তবায়নের ওপর জোর দিয়ে কলেজ শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিবর্তে উচ্চশিক্ষা ও গবেষণা অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠা করা যুক্তিসংগত ও সময়োপযোগী হবে।
লেখক পরিচিতি: সাব্রী সাবেরীন, সৌরভ জাকারিয়া, মনিরুজ্জামান ও অরিয়ন তালুকদার; শিক্ষক ও সদস্য, দ্য অ্যাডভাইজরস: থিঙ্কট্যাংক অব সিভিল এডুকেশন