হারিয়ে যাওয়া নব্বইয়ের শৈশব ও ডিসেম্বরের দিনগুলো
নব্বইয়ের দশকই হয়তো শৈশবের শেষ প্রজন্ম, যারা ছিল তথ্যপ্রযুক্তির বাইরে; সঙ্গে পেয়েছিল হারিয়ে যাওয়া সেই ডিসেম্বরের দিনগুলো।
শৈশবের ফেলে আসা দিনগুলো আমাদের জীবনের সবচেয়ে মধুর সময়। শৈশবকালে মাথায় চেপে বসে থাকে না কোনো চিন্তাভাবনা; শুধু খুশি, আনন্দ আর হুল্লোড়ের মধ্য দিয়ে সমগ্র ছোটবেলা কখন অতিবাহিত হয়ে কৈশোর পেরিয়ে আমরা যৌবনে প্রবেশ করি, তা বুঝতে পারি না। বুঝতে যখন পারি, তখন সেই সারল্যমাখা দিনগুলো হারিয়ে গেছে মহাকালের গভীরে।
শৈশবের একেকটা দিন আমাদের জীবনে একেকটা জাদুঘর হয়ে থাকে; যে জাদুঘরে জমে থাকে হাজারো স্মৃতি।
সন্ধ্যা হতেই ঘরে ফিরে পড়তে বসা, হারিকেনের আলোতে অথবা কুপি জ্বালিয়ে রাতে একসঙ্গে মেঝে বসে খাবার খাওয়া। শৈশবের সেই নানুবাড়ির দিনগুলো; সেই ২৫ পয়সা, ৫০ পয়সা, এক টাকা ও দুই টাকার গল্প; সেই শীতের কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে খেজুরের রস খাওয়া; সেই লুকোচুরি খেলা।
দরজার পেছনে লুকিয়ে থাকতাম কেউ এলে চমকে দেব বলে। সে আসতে দেরি করছে বলে অধৈর্য হয়ে বেরিয়ে আসতাম; পূর্ণিমার রাতে চাঁদের সঙ্গে হাঁটতাম আর বলতাম, চাঁদও আমাদের সঙ্গে হাঁটছে। স্কুলে যাওয়ার সময় সবাই একসঙ্গে দৌড়ে যেতাম। ক্লাসে কলম–কলম খেলা, খাতায় ক্রিকেট খেলা, চোর-ডাকাত-বাবু-পুলিশ খেলা। এক টাকার রঙিন বা নারকেলি আইসক্রিম, বুনবুনি, চার পিস চকলেট, হাওয়াই মিঠাই খেতে না পারলে মন খারাপ হয়ে যেত। হঠাৎ আকাশপথে হেলিকপ্টার গেলে সবাই ঘর থেকে বের হয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। শুক্রবার সন্ধ্যার পর আলিফ লায়লা, সিন্দবাদ, রবিনহুড ও ম্যাকগাইভার দেখার জন্য পুরো সপ্তাহ অপেক্ষা করা। ফলের বিচি খেয়ে ফেললে দুশ্চিন্তা করতাম, পেটের ভেতর গাছ হবে কি না; মাথায় মাথায় ধাক্কা লাগলে শিং গজানোর ভয়ে আবার নিজের ইচ্ছায় ধাক্কা দিতাম; আমাদের কারও দাঁত পড়লে ইঁদুরের গর্তে দাঁতটা দিয়ে আসতাম, নাহলে আমাদের দাঁত গজাবে না।
কেউ বসে থাকলে তার মাথার ওপর দিয়ে ঝাঁপ দিতাম, যাতে সে আর লম্বা হতে না পারে।
বিকেলে কুতকুত, কানামাছি ও গোল্লাছুট না খেললে বিকেলটা যেন মাটি হয়ে যেত।
মারবেল, লুডু না খেললে কি হয়!
রাতে ঘরের কোণে বাঁশবাগানে অথবা আমগাছের ডালে বসে থাকা হুতোম প্যাঁচার ডাক যেন এখনো কানে ভেসে ওঠে। আহা, ডাক শুনে ভয়ে কতই–না মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে যেতাম!
এ ছাড়া সঙ্গে ছিল আমাদের কালারফুল ডিসেম্বর; যে ডিসেম্বর পাওয়ার আশায় আমাদের অপেক্ষা করতে হতো দীর্ঘ ১১ মাস। বার্ষিক পরীক্ষার মধ্য দিয়ে শুরু হতো আমাদের ডিসেম্বর। বার্ষিক পরীক্ষার শেষ দিন আমরা ছিলাম পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ; ছিল না কোনো জীবনের চাওয়া, না পাওয়ার হিসাব; ছিল না কোনো পিছুটান। দুরন্তপনায় ছুটতাম ডিসেম্বরের শেষের দিনগুলো; হিসাব ছিল শুধু একটাই, বার্ষিক পরীক্ষার রেজাল্ট আর জানুয়ারির ১ তারিখে নতুন বইয়ের ছোঁয়া পাওয়ার।
পরীক্ষা দিয়ে বাড়ি ফিরতেই দৌড় দিতাম খেলার মাঠে; কোদাল, পিঁড়ি, কাঠি নিয়ে উইকেট বানাতাম। সবার কাছ থেকে টাকা তুলে বল আর স্কচটেপ কিনতাম। সকাল গড়িয়ে দুপুর, দুপুর পেরিয়ে সন্ধ্যা, খেলার মধ্যেই ডুবে থাকতাম। কখনো ভাত খেতে দুপুরে বাড়িতে যাওয়া হতো, কখনো যাওয়া হতো না।
সন্ধ্যার পর আবার আমরা বেরিয়ে পড়তাম। তীব্র শীতে রাত জেগে আগুনের পাশে বসে মা-চাচিদের ধান সেদ্ধ করা দেখা এক অন্যরকম অনুভূতি। চারদিকে খড়ের স্তূপ আর তার মধ্যে লুকোচুরি খেলা ছিল অন্যতম। কখনো কখনো কম্বলের নিচে লুকিয়ে গল্পের বই পড়া হতো। আবার কখনো খড় জ্বালিয়ে আগুন পোহাতাম। সন্ধ্যা পর্যন্ত ব্যাডমিন্টন, গোল্লাছুট, বউচি খেলে ঘরে ফিরতে হতো। একটু দেরি হলে বকা শুনতাম।
আমাদের সেই ডিসেম্বরের দিনগুলো এখন হারিয়ে গেছে। এখন ডিসেম্বরেও ক্লাস থাকে, পরীক্ষা থাকে, থাকে অ্যাসাইনমেন্ট ও প্রেজেন্টেশনের ডেডলাইন, থাকে অফিস। জীবনের প্রয়োজনে ব্যস্ত হয়েছে সবাই। এখন আমাদের ডিসেম্বরের সকালগুলো কাটে ঘুমে, ক্লাসে অথবা অফিসে। এখন আর ঘুম থেকে উঠে আমরা আম্মুর হাতের শীতকালীন পিঠা খেতে পারি না; এমনকি এখন সকালে উঠে আম্মুকে দেখি না। বিকেলগুলোতে আমরা আগের মতো মাঠে যেতে পারি না, যেতে হয় প্রাইভেটে। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত আমরা চার দেয়ালে কাটিয়ে দিই। সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা, ছুটছি তো ছুটছি।
সময়ের পরিক্রমায় পার হয়ে গেছে আমাদের শৈশব। ব্যস্ততা বেড়েছে; গ্রাম এখন নগরায়ণ হয়েছে, তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে; হারিয়ে গেছে সেই আলোবিহীন শৈশব, হারিয়ে গেছে সেই ডিসেম্বরের দিনগুলো! এখনকার প্রজন্মের কাছে নব্বইয়ের শৈশব হয়তো রূপকথার গল্প মনে হবে।
হয়তো কেউ কোনো একদিন কাজের ব্যস্ততার ফাঁকে ডিসেম্বরের কোনো এক বিকেলে অফিসের বারান্দায় বসে কফির চুমুতে লেখাটি পড়তে পড়তে হারিয়ে যাবে তার সেই ছেলেবেলায়, সেই হারিয়ে যাওয়া শৈশবে, সেই নব্বইয়ের দিনগুলোতে।
সে মুহূর্তে নস্টালজিক হয়ে হয়তো একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের দুটি লাইন আক্ষেপে বলে উঠবে—‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না;
সেই-যে আমার নানা রঙের দিনগুলি।’
*লেখক: মো. তোফায়েল আহমেদ, শিক্ষার্থী, ব্যবস্থাপনা বিভাগ, ঢাকা কলেজ, ঢাকা