অবহেলা নয়, লোকপ্রশাসনে শিক্ষা ক্যাডার চাই

চাকরি
প্রতীকী ছবি

দেশের প্রথম সারির ১৬টি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের অন্যতম বিষয় লোকপ্রশাসন। লোকপ্রশাসন মাল্টিস্ট্রাকচারাল বিষয়। যেটি সরকারের নীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়নে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। প্রশাসকেরা হলেন মাল্টিডিসিপ্লিনারি মানুষ। বিসিএসে আরবি, সংস্কৃতির মতো বিষয়ে শিক্ষা ক্যাডার আছে।

দুর্ভাগ্যজনকভাবে বলতে হয়, লোকপ্রশাসনের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শিক্ষা ক্যাডার নেই। নেই বিশেষ ক্যাডার, সুবিধা নেই প্রশাসন ক্যাডারেও। অথচ একজন শিক্ষার্থীকে বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়ে ভর্তির সুযোগ পেতে হলে ভালো সিরিয়ালে থাকতে হয়। লোকপ্রশাসনের নামে বাংলাদেশের ‘জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়’ আছে। সেখান থেকে পিএসসিতে চাহিদা আসে, কোনো ক্যাডারের জন্য কতগুলো সিট খালি।

২০১৯ সালের দেশের সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় একযোগে দাবি জানিয়েছিল লোকপ্রশাসনকে শিক্ষা ক্যাডারে যুক্ত করার। এ সময় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বিভিন্ন মিটিং হয়েছিল, ফলে আশার আলো কিছুটা জেগেছিল। হঠাৎ করোনার কারণে সব আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়।

ফোকাস এরিয়া

সরকারি প্রশাসনের রক্ষণাবেক্ষণ, ম্যানেজমেন্ট, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, আইন, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ, পাবলিক পলিসি, আন্তর্জাতিক সম্পর্কসহ কীভাবে দক্ষ প্রশাসক হতে হয় ইত্যাদি পড়ানো হয় লোকপ্রশাসনের শিক্ষার্থীদের। বর্তমানে ২৬টি ক্যাডার সার্ভিস রয়েছে। যেখানে ক্যাডারদের ফাউন্ডেশন ট্রেনিং কোর্সে লোকপ্রশাসনের ওপর ১৫০০ নম্বরের পরীক্ষা হয়। অন্যদিকে একজন লোকপ্রশাসনের শিক্ষার্থী এই ফিল্ডে চার-পাঁচ বছর অধ্যায়ন করেন।

প্রশাসনে ব্যবস্থাপনার আঁচর লেগেছে পৃথিবীর সূচনালগ্নে। লোকপ্রশাসন সরকারের যাবতীয় কর্মপরিধি জনগণের চাহিদা পূরণের জন্য নানাবিধ জনকল্যাণমূলক পরিকল্পনা ও প্রকল্প গ্রহণ করে। প্রশাসন সরকারের কেন্দ্রে অবস্থান করে। লোকপ্রশাসন শুধু প্রশাসনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। বিভিন্ন সেমিস্টারে সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, অর্থনীতিসহ অনেক কোর্স পড়ানো হয় এখানে।

টেকনিক্যাল ক্যাডারে মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের যে বিষয় আছে, সেখানে অন্যান্য বিষয়ের শিক্ষার্থীরা পরীক্ষা দিতে পারেন না। ফলে টেকনিক্যাল ক্যাডার থেকে বঞ্চিত লোকপ্রশাসন। বাংলাদেশে ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয় থেকে পাস করা অনেক শিক্ষার্থী এখন পেশা হিসেবে নিচ্ছেন পুলিশ, প্রশাসন, পররাষ্ট্র, করসহ বিসিএসের বিভিন্ন পদ। এসব ক্যাডারে যদি ডাক্তার এবং ইঞ্জিনিয়ারদের যেতে হয়, তাহলে প্রশ্ন, কেন তাঁরা মেডিকেল ও প্রকৌশল বা প্রযুক্তি নিয়ে পড়েছেন?

স্বাভাবিকভাবেই যেকোনো পরীক্ষায় তাঁরা ভালো করবেন, যেহেতু তাঁরা সবচেয়ে মেধাবী। কিন্তু সমস্যা সেখানে নয়, সমস্যা আমরা এখন উপলব্ধি করতে পারছি না। বাংলাদেশে গুটিকয়েক প্রতিষ্ঠানে ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডাক্তারি পড়ানো হয় । সরকার প্রতিজনের পেছনে ৩০- ৪০ লাখ টাকা খরচ করে। ৫ বছর ধরে ইঞ্জিনিয়ারিং ও ডাক্তারি পড়ে যদি বিসিএসে জয়েন করেন, তাহলে কি এটি রাষ্ট্রের অর্থের অপচয় নয়? কারণ, তাঁদের শিক্ষালব্ধ জ্ঞান জাতির কোনো কাজে আসছে না। যাঁরা আবার এই পেশায় থাকেন, বেশির ভাগই পাড়ি জমান উন্নত বিশ্বে।

গত ৪১তম বিসিএসে লোকপ্রশাসনের শিক্ষার্থীরা অনেক দুঃখ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। অনেকের শিক্ষা ক্যাডার পছন্দের তালিকা থাকলেও নিয়মের শিকল থেকে বাইরে যেতে পারেননি।

বিসিএসের ফলাফল বিশ্লেষণ

পিএসসির তথ্য মতে ৩৬ বিসিএসে ৪.৩০ শতাংশ, ৩৭ বিসিএসে ৬.০ শতাংশ, ৩৮ বিসিএসে ৭.৭১ শতাংশ পদে ডাক্তার, প্রকৌশল ও কৃষি ডিগ্রিধারীরা প্রশাসন, পররাষ্ট্র, পুলিশের মতো সাধারণ ক্যাডারে ঢুকেছেন। শুধু ৪১ বিসিএসে প্রশাসনে ৩২৩ জন, পুলিশে ১০০ জন, পররাষ্ট্রে ২৫ জনসহ সাধারণ ক্যাডারে প্রায় ৮০০ জনকে সুপারিশ করে পিএসসি। সাধারণ ক্যাডারে সিংহভাগ ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারদের জয়জয়কার। ২৫ জনের মধ্যে ১৫ জন বিভিন্ন ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ের।

এবার এবটু প্রশাসন ক্যাডারের দিকে নজর দেওয়া যাক, এখানে ইঞ্জিনিয়ারদের আধিক্য বুয়েটের ৪৫, চুয়েটের ২০, বুটেক্স ও কুয়েটের ২০, শাবিপ্রবিতে ৮, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানের ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ গুলোয় ৩০, হাবিপ্রবিতে ৩ জন ইঞ্জিনিয়ার। শুধু ৪১ বিসিএসে নয়, বিগত ৪-৫ টি বিসিএসে একই চিত্র। পররাষ্ট্র ক্যাডারের সুপারিশপ্রাপ্ত প্রথম থেকে সপ্তম পর্যন্ত মেধা তালিকা বুয়েটের দখলে। প্রকৌশলী ও চিকিৎসকেরা যদি পররাষ্ট্র, কর, প্রশাসন ক্যাডার হতে পারে, তাহলে লোকপ্রশাসন বিষয়ে পড়া শিক্ষার্থীরা কেন শিক্ষা ক্যাডারের সুযোগ পাবেন না।
সময়ের দাবি

এই বিষয়ে শিক্ষা ক্যাডার যুক্ত করলে, মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষকতা পেশায় আসার সুযোগ সৃষ্টি হবে। লোকপ্রশাসনের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা, কূটনীতি, প্রশাসনের কাজ প্রত্যক্ষভাবে দর্শন করেন। বিভিন্ন সেমিস্টারে শিক্ষকেরা অ্যাসাইনমেন্টে এসব কাজ দিয়ে থাকেন। শিক্ষা ক্যাডার না থাকায় বিসিএসের অধিকাংশ আসন থেকে লোকপ্রশাসনের শিক্ষার্থীরা বঞ্চিত। বিসিএসের মতো একটা গুরুত্বপূর্ণ মূল্যবান সরকারি চাকরিতে লোকপ্রশাসন অত্যন্ত উপেক্ষিত ও অবহেলিত। পিএসসি ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে সবিনয়ে বলতে চাই, লোকপ্রশাসন বিভাগকে শিক্ষা ক্যাডারের অন্তর্ভুক্ত করা এখন সময়ের দাবি।

  • লেখক: মো. সিদ্দিকুর রহমান সিদ্দিক, শিক্ষার্থী, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

  • নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]