ভালোবাসার পূর্ণতা

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

১.

মেয়েটির নাম প্রাচী রহমান। প্রচুর গল্পের বই পড়ে আর কবিতা শুনতে পছন্দ করে। নিহাদ আর প্রাচীর প্রথম পরিচয় হয় কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে, নিহাদ তখন ক্যাম্পাসের একটা প্রোগ্রামে কবিতা আবৃত্তি করছিল। পরিচয় হওয়ার পর থেকেই নিহাদের প্রতি একধরনের ভালো লাগার জন্ম নেয় প্রাচীর মনে। বন্ধুত্ব হওয়ার পর প্রাচী অনেক চেষ্টা করেও নিহাদকে তার মনের কথা বলতে পারে না। অপর দিকে নিহাদের মনে প্রাচীর জন্য ওরকম কোনো ফিলিংস নেই, সে শুধু প্রাচীকে বন্ধু মনে করে, একজন ভালো বন্ধু। বিকেলে ক্লাসের পর একদিন,

প্রাচী: নিহাদ চলো, ফুচকা খাব।

নিহাদ: কোথায়?

-আমাদের বাসায়, মা বানিয়েছেন। আর মাকে বলেছি আমার একটা বোরিং বন্ধু আছে, মা তোমাকে দেখতে চেয়েছেন।

-আমি বোরিং?

-তা নয়তো কি, কাছের মানুষের ফিলিংস বোঝো না।

-কাছের মানুষ বলতে কী বোঝাতে চাইছ? তুমি কি কণার কথা বলছ?

-এই কণাটা আবার কে?

-চিনি না, খালি মেসেজ পাঠায় Love u, আমাকে ছাড়া বাঁচবে না। এই টাইপের।

-শোনো, এই জোহাকে আজকেই ব্লক করবা।

-কেন?

-আমি বলছি তাই।

প্রাচীর কণ্ঠে রাগের উপস্থিতি, আর শেষবিকেলের প্রাচীতে লাল প্রাচীর সঙ্গে রাগে লাল মুখখানা মিলে গিয়ে একটা অন্যরকম সৌন্দর্য খেলা করছে ওর মুখে।

-রাগ করলে তোমাকে অন্যরকম সুন্দর লাগে, আগে কখনো খেয়াল করিনি, সোজা হয়ে দাঁড়াও তো একটা ছবি তুলে রাখি।

-নিহাদ, সব সময় ফাজলামি ভালো লাগে না। এক মিনিট তুমি কি আমার প্রসংশা করেছ?

-কই না তো?

-হ্যাঁ, করেছ। এই মাত্র না বললে রাগ করলে আমাকে অন্যরকম সুন্দর লাগে।

-হুম, লাগেই তো।

-এটাকেই প্রসংশা বলে, গাধা!

-ও আমাকে গাধা ডাকলে এটাও কি প্রশংসা?

নিহাদের কথা শুনে প্রাচী হেসে ওঠে। নিহাদ প্রাচীর দিকে তাকিয়ে ভাবছে, হাসলে তো প্রাচীকে আরও বেশি সুন্দর লাগে। আগে কেন চোখে পড়েনি? নাকি আজকে খুব সুন্দর লাগছে।

২.

প্রাচীর বাড়িতে যাওয়ার পর নিহাদ একটা জিনিস বুঝল, সেটি হলো বাড়িতে সবাই ওর ভক্ত, অ্যান্টি বলছিল, জানো বাবা, প্রাচী দিনরাত শুধু তোমার কথা বলে—নিহাদ ছেলেটা এমন, নিহাদ ভালো লিখে, ভালো আবৃত্তি করে, ভালো করে কথা বলতে পারে। ওর মুখে তোমার গল্প শুনতে শুনতে আমরাও তোমার ভক্ত হয়ে গেছি, আমি তো প্রাচীকে প্রায় বলি এক কাজ কর, এতই যখন নিহাদ নিহাদ করিস, তখন ওর সঙ্গেই তোর বিয়ে দিয়ে দেব। কথা শুনে নিহাদ ঘামতে শুরু করেছে। পরদিন ক্যাম্পাসে, নিহাদ আর প্রাচী বাগানে বসে আছে।

প্রাচী: কী ব্যাপার! মুখে এত বিরক্তি ভাব কেন?

নিহাদ: প্রাচী, তুমি কি জানো ক্যাম্পাসে আমাদের নামে কী সব কথা ছড়াচ্ছে।

-না তো কী কথা?

-সবাই ভাবছে, We Are In A Relationship। আচ্ছা, আমরা তো শুধু ভালো বন্ধু তাই না?

-আসলে আমি ছাড়া তুমি আর কোনো মেয়ের সঙ্গে কথা বল না তাই হয়তো। আচ্ছা নিহাদ, আমরা কি শুধুই বন্ধু?

-শুধু বন্ধু হব কেন? আমরা হলাম...

-কী কী? (উৎফুল্ল হয়ে)

-আমরা হলাম ভালো বন্ধু।

-ও

(প্রাচীর খুশিমাখা মুখটা কালো হয়ে যায়)

-কী ব্যাপার, এখন তোমার মুখে অমাবস্যা নেমে এসেছে কেন?

-কিছু না

-আরে বলো।

-তুমি বুঝবে না নিহাদ।

-বললেই তো বুঝব, বলো।

-দেখো, যে সব সময় তোমার পাশে থাকে, তোমাকে এত ভালোবাসে, তাকে তুমি কখনো বুঝলে না।

-কে সে? একি প্রাচী! তুমি কি কান্না করছ?

প্রাচী দৌড়ে বাগান থেকে বের হয়ে যায়। পুরো ব্যাপারটায় নিহাদ অবাক হয়ে যায়, হাঁ করে ওর গমনপথের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, আচ্ছা, মেয়েটা হঠাৎ এমন করল কেন?

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

৩.

কিছুদিন ধরে প্রাচীকে ক্যাম্পাসে দেখা যাচ্ছে না, নাম্বার-ফেসবুক সব বন্ধ। প্রাচীর এই অনুপস্থিতি নিহাদকে বিষণ্ন করে তোলে। ক্লাস, বাগান, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা—এগুলো এখন সব অর্থহীন মনে হয়। নিহাদ যেন ওর লাইফ থেকে ইম্পরট্যান্ট কিছু একটা হারিয়ে ফেলেছে। অবশেষে প্রাচীর নম্বর খোলা পাওয়া যায়। নিহাদ প্রাচীকে খোঁচা দিয়ে অনেক কথা বলে, আর আরশির সঙ্গে দেখা করার কথা বলে। ফোনটা রাখার পর, প্রাচী রাগে আর কষ্টে ছটফট করতে লাগল। জোহাকে দেখামাত্রই দুইটা থাপ্পড় দেবে, আর নিহাদকে তো ছাড়বে না, মিস্টার পারফেক্ট সেজে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ায়, ওর সব চুল যদি টেনে না ছিঁড়ি, তাহলে আমার নাম প্রাচী নয়। রাগে গজগজ করতে করতে সিদ্ধান্ত নেয় প্রাচী। পরদিন ক্যাম্পাসে গিয়ে নিহাদকে কোথাও না পেয়ে প্রাচী ফোন দেয়, নিহাদ আসবে না বলে জানিয়ে দেয়। প্রাচী ফোনটা কেটে ঘুরে বাসার উদ্দেশে হাঁটা দেয়, তখন গাছের আড়াল থেকে বের হয়ে গান ধরে নিহাদ,

- যেও না যেও না এভাবে চলে, একটু দাঁড়াও কিছু কথা আছে বলার ফিরে তাকাও।

প্রাচী ফিরে দেখে নিহাদ হাসিমুখে ওর দিকে আসছে। ঝাড়ি দেওয়ার জন্য মুখ খোলার আগেই নিহাদ বলে ওঠে, ‘একটা সময় ছিল, যখন জ্যোৎস্নাভরা পূর্ণিমা, বৃষ্টিভেজা বিকেল, আকাশের অজস্র তারা—এই মুহূর্তগুলো কোনো বিশেষ মানুষকে উপহার দেওয়ার ইচ্ছে করত, সেই বিশেষ মানুষটিকে অন্য কোনো দিগন্তে খুঁজতে খুঁজতে আমি এটা ভুলে গিয়েছিলাম, যে মানুষটিকে আমি খুঁজছি, সেই মানুষটি এত দিন আমার পাশেই ছিল। এরপরও আমি কিছুই বুঝতে পারিনি। ‘ভালোবাসার কোন রং নেই, ভালোবাসার কোনো গন্ধ নেই, শুধু অনুভূতি আছে। ভালোবাসা শুধুই ভালোবাসা। প্রিয় মানুষটির সঙ্গে মিশে গিয়ে সেই ভালোবাসা পূর্ণতা পায়, ভালোবাসার আকাশ রঙিন হয় প্রিয় মানুষটির ভালোবাসার রঙে।

‘আকাশে চাঁদ একটাই থাকে, পৃথিবীকে পূর্ণিমার প্রাচীতে রাঙানোর জন্য একটা চাঁদই যথেষ্ট। যা হাজার হাজার তারা মিলেও করতে পারে না। থাকুক না চাঁদে কলঙ্ক, তবু সে চাঁদ, সমস্ত আকাশের বুকজুড়ে ভালোবাসার প্রতীক একটিমাত্র চাঁদ আর সেই চাঁদ হলো তুমি। শুধুই আমার প্রাচী, তোমাকে অনেক অনেক ভালোবাসি প্রাচী।’

‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

প্রাচী যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছিল না, তার মনে হচ্ছিল সে স্বপ্ন দেখছে। কিছুতেই ঘোর কাটছে না তার। নিহাদ প্রাচীর চোখে চোখ রেখে এক পা এগিয়ে আসে, প্রাচী এক পা পিছাতে গিয়ে পড়ে যাওয়ার উপক্রম হলো, নিহাদ প্রাচীকে ধরে ফেলে।

নিহাদ: তুমি কাঁপছ কেন? খুব শীত করছে বুঝি?

(প্রাচী নিরুত্তর। প্রাচীকে আস্তে করে ঝাঁকি দিয়ে নিহাদ বলে, এই প্রাচী?)

প্রাচী: হ্যাঁ...

-আমার কথা কিছু শুনতে পাওনি?

-নিহাদ, তুমি ফান করছ না তো?

-এসব ব্যাপারে আমি ফান করি না, আমি সিরিয়াস।

-তাহলে আরশি?

-আরে, আরশি নামের কারও অস্তিত্ব নেই, আমার তৈরি করা কাল্পনিক চরিত্র।

-সত্যি?

-হ্যাঁ সত্যি।

-আমাকে ছুঁয়ে বলো।

-মেম, আমি আপনাকে ছুঁয়েই আছি।

লজ্জা পেয়ে প্রাচী দূরে সরে যায়। নিহাদ বাগান থেকে কয়েকটা ফুল তুলে প্রাচীর সামনে হাঁটু গেড়ে বসে।

-প্রাচী, Will You Be My Partner Forever?

-No

-What! No! But Why?

-এগুলো দিয়ে কেউ প্রপোজ করে, স্টুপিড? প্রপোজ গোলাপ ফুল দিয়ে করতে হয় জানো না?

-এখনো বাগানে গোলাপ ফোটেনি, আচ্ছা, গোলাপ ফুলের গাছ দিয়ে করলে হবে? দাঁড়াও গাছ তুলে আনছি।

-থাক, লাগবে না, গাধা—এতেই হবে।

-কী হবে?

-Yes, I’ll Be your Partner Forever

নিহাদ আর প্রাচী একসঙ্গে হেসে ওঠে, হাতে হাত রেখে ভালোবাসার নতুন পথচলা শুরু হয় ওদের।

লেখক: নাহিদ হোসাইন, ভৈরব, কিশোরগঞ্জ