তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ নিয়ে রাষ্ট্রের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা জরুরি
আমরা শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে প্রতিনিয়ত পত্রিকায় লেখালেখি করছি, টক শোতে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করছি। কিন্তু আদৌ কি মূল সমস্যা বের করে ঝোপ বুঝে কোপ দিতে পেরেছি? আমরা ক্যারিয়ার গড়তে চাই আমাদের আলোকিত ও স্বপ্নীল ভবিষ্যতের জন্য কিন্তু ক্যারিয়ারই যখন আমাদের আশার প্রদীপ নিভিয়ে দেয় তখন বিষয়টা সরষের ভেতরেই ভূত থাকার গল্প হয়ে যায়। টাইটানিক ডুবে যাওয়ার পর মহাসমুদ্র সাঁতরে যাত্রীদের বেঁচে ফেরার চেষ্টার চেয়ে সদ্য স্নাতক শেষ করা একজন শিক্ষার্থীর একটি চাকরি পেয়ে হাঁপ ছেড়ে বাঁচার লড়াই কোনো অংশে কম নয়। বাংলাদেশের প্রায় সমবয়সী এবং আয়তনে বাংলাদেশের চেয়েও ছোট দেশ সিঙ্গাপুর। দেশটি একসময় জেলেপল্লি নামে পরিচিত থাকলেও বর্তমানে অর্থনীতি, গবেষণা ও আবিষ্কারে বিশ্বকে চোখরাঙানি দিচ্ছে। আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত তো চন্দ্র জয় করে এখন সূর্যের কথা ভাবছে। সিঙ্গাপুর, ভারত বা পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশের ঈর্ষণীয় সাফল্যের পেছনে রয়েছে তাদের সৃজনশীল তরুণ প্রজন্মের সৃজনশীলতার শক্তি। কিন্তু কোন পথে হাঁটছে বাংলাদেশ? তরুণ প্রজন্মের ভবিষ্যৎ কোথায়?
এক
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের এ সময়ে উন্নত দেশে তরুণ-তরুণীরা তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর ক্যারিয়ার এবং উদ্যোক্তা হওয়ার দিকে ঝুঁকছেন। ঠিক বিপরীত চিত্র দেখা যায় বাংলাদেশে। এখানে তরুণ প্রজন্ম হাতে গোনা কয়েকটি সরকারি চাকরির পেছনে আদাজল খেয়ে ছুটছেন। প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হচ্ছে, তরুণ প্রজন্ম কি এমনি এমনি সরকারি চাকরির পেছনে ছুটছেন? অসংখ্য বিসিএস ক্যাডার রয়েছেন, যাঁরা ক্যাডার হতে চাননি। তাঁদের স্বপ্ন ছিল গবেষক হওয়া, চাঁদ কিংবা মঙ্গল গ্রহের রহস্য উন্মোচন করা। মরণব্যাধি ক্যানসারের চিকিৎসা আবিষ্কার করা। কিন্তু যখন তাঁরা বুঝতে পেরেছেন, তাঁদের সেই স্বপ্ন আসলে দুঃস্বপ্ন, তখনই তাঁরা বাধ্য হয়ে বাংলা, ইংরেজি এবং সাধারণ জ্ঞান মুখস্থ করে রাতের পর রাত বিসিএসের জন্য পড়াশোনা করেছেন। মাঝেমধ্যে চিন্তা করি, বাংলাদেশে বিসিএসের ছাঁকনির মাধ্যমে যেভাবে ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, পদার্থ, রসায়নে পড়ুয়া তুখোড়ে মেধাবীদের ক্যাডার বানানো হচ্ছে, ঠিক সে রকম একটা ছাঁকনির মাধ্যমে যদি বিজ্ঞানমনস্ক শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞানী বানানো হতো এবং সব ধরনের সুবিধা দেওয়া হতো, তাহলে আমরা হয়তো ভারতের আগেই চন্দ্র জয় করে মঙ্গল অভিমুখে রওনা হতে পারতাম। আমরা হয়তো এখানে বিসিএসের মতো প্রতিবছর আড়াই হাজার ক্যাডার পেতাম না, কিন্তু ৫০ জন বিজ্ঞানী তো অনায়াসেই পেতাম, তাই না? আমাদের ক্যাডাররা অন্য দেশে যান আইটি প্রশিক্ষণ নিতে। তখন অন্য দেশের বিজ্ঞানীরা আমাদের দেশে আসতেন বিজ্ঞানের জ্ঞান আহরণের জন্য। এটা কল্পনা নয়, বাস্তব। সে জন্য চাই রাষ্ট্রের আন্তরিকতা। এ অবস্থায় অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী যাঁরা গবেষণায় আগ্রহী তাঁরা স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন, যাকে মেধা পাচার বা ব্রেন ড্রেন বলে। মেধা পাচারকে আমি জাতির ভবিষ্যৎ পাচার বলি। কারণ, একটি দেশের সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নির্ভর করে ওই দেশের তরুণ প্রজন্মের প্রতিভা, সৃজনশীলতা ও মেধার ওপর। আর আমাদের সেই প্রতিভা চলে যাচ্ছে বিদেশে! চীন ও ভারত থেকেও অনেক শিক্ষার্থী অন্য দেশে পড়াশোনা করতে যান। কিন্তু পড়াশোনা শেষ হলে তাঁদের আকর্ষণীয় সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। এতে তাঁদের ব্রেন ড্রেনের বদলে ব্রেন গেইন হচ্ছে। অথচ আমরা সেটা করতে ব্যর্থ। আমাদের এ বিষয় গভীর ভাবতে হবে।
দুই
দেশে চাকরির অভাব নাকি দক্ষতার অভাব? এ বিষয়ে চাকরিদাতা এবং চাকরিপ্রার্থীদের মধ্যে তর্কবিতর্ক সব সময়ই দেখা যায়। আমি ধরে নিলাম চাকরিপ্রার্থীদের দক্ষতার অভাব। এখন আমার কৌতূহলী মন জানতে চাইছে, এ দক্ষতার অভাবের দায় কি শুধু শিক্ষার্থীদের? যে দেশে ব্যবহারিক পরীক্ষায় সরাসরি ব্যাঙ কেটে এক্সপেরিমেন্ট করার বদলে খাতায় ব্যাঙের ছবি আঁকলেই পূর্ণ মার্ক পাওয়া যায়, সে দেশে শিক্ষার্থীদের দক্ষতার অভাব হবে, এটা কি স্বাভাবিক নয়? আমরা স্মার্ট বাংলাদেশের দিকে ধাবিত হচ্ছি। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা কতটা স্মার্ট হচ্ছে? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা এখনো আন্তর্জাতিক মানের না হলেও মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানি এবং করপোরেট খাতে চাকরি করতে আমাদের ঠিকই আন্তর্জাতিক মানের হতে হয়। চাকরির বাজারে রিসার্চ পেপার, কম্পিউটার স্কিল, কমিউনিকেশন হ্যাকস, টিমওয়ার্ক, লিডারশিপ, ইউনিক আইডিয়া জেনারেট, প্রবলেম সলভিং অ্যান্ড ইনস্ট্যান্ট ডিসিশন মেকিং এবং ফিল্ড ওয়ার্কের স্কিল চাকরিদাতারা আমাদের মধ্যে খুঁজে পান না। ফলে শ্রীলঙ্কা, সিঙ্গাপুর, চীন ও পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে কর্মী এসে মোটা অঙ্কের বেতন নিয়ে যান। অথচ দেশের টাকা আমাদের পকেটে ঢোকার কথা। এর একটি বড় কারণ, আমরা বাস্তবধর্মী প্রায়োগিক শিক্ষার দিকে নজর না দিয়ে বরং শিক্ষার্থীদের মস্তিষ্কে চাপিয়ে দিচ্ছি অহেতুক এবং অপ্রয়োজনীয় গৎবাঁধা মুখস্থবিদ্যা। এর ফলাফল এই যে আন্তর্জাতিক জরিপে নেপাল, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তানের মতো দেশের বিশ্ববিদ্যালয় র্যাঙ্কিংয়ে থাকে অথচ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের ঠাঁই মেলে না। আমাদের নীতিনির্ধারকেরা কি এ বিষয়গুলো আসলেই ভাবেন?
তিন
চাকরির কথা বাদ দিয়ে এবার উদ্যোক্তা হওয়ার কথা বলি। কখনো কি ভেবেছেন চীনের একজন ২৫ বছরের তরুণ এবং বাংলাদেশের একজন ২৫ বছরের তরুণের মধ্যে পার্থক্য কত বছর? আপাতদৃষ্টে বয়সের কোনো পার্থক্য নেই। তবে চীনের একজন তরুণ ২৫ বছর বয়সে যা অর্জন করেন, বাংলাদেশের একজন সেগুলো ৫০ বছর বয়সে অর্জন করেন। এর পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ হচ্ছে চীনের তরুণ প্রজন্ম চাকরি করার চেয়ে উদ্যোক্তা হয়ে অন্যদের চাকরি দেওয়ার মতো কর্মক্ষেত্র তৈরিতে বেশি মনোযোগী। বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম যে একেবারেই উদ্যোক্তা হতে চান না, সে কথা সত্য নয়। কিন্তু বাংলাদেশে উদ্যোক্তা হিসেবে শক্তপোক্ত অবস্থানে যেতে খুব বেগ পেতে হয়। বিশেষ করে অর্থনৈতিক সমস্যা। এ অবস্থায় একজন শিক্ষিত তরুণ পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্র কিংবা বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে আশানুরূপ সহায়তাও পাচ্ছেন না। ফলে তিনি কূলকিনারা না পেয়ে দুই বেলা দুমুঠো ভাত খাওয়ার পয়সা পেতে চাকরিতে ঢোকেন। আর এ জন্যই হয়তো আমাদের দেশে বিল গেটস, জ্যাক মা কিংবা ইলন মাস্কের মতো ব্যক্তির জন্ম হয় না। তা ছাড়া আমাদের দেশে উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণের সুব্যবস্থা নেই। ফলে ভিটেমাটি বিক্রি করে অনেকে উদ্যোক্তা হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সফলতার মুখ দেখতে পান না। তখন তো এ ছেলেটার পথে বসা ছাড়া আর কোনো পথ থাকল না! আমরা সভা–সেমিনারে চিৎকার করে বলি উদ্যোক্তা হও কিন্তু বাস্তবে উদ্যোক্তা হওয়ার কণ্টকাকীর্ণ পথ মসৃণ করতে সত্যি কি চেষ্টা করছি? বর্তমানে সরকার শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের দুর্দশা দূর করে দেশের অগ্রগতিতে তাঁদের অবদান নিশ্চিত করতে বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করছে, যা প্রশংসনীয়। তবে এ ক্ষেত্রে সরকারকে আরও বিচক্ষণতার সঙ্গে সময়োপযোগী পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে, যে তরুণ প্রজন্ম ১৯৭১ সালে পরাধীন দেশে শত্রুর বুলেটের সামনে দাঁড়িয়ে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করেছে সে তরুণ প্রজন্ম স্বাধীন দেশে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পেলে ঈর্ষণীয় সাফল্যের মাইলফলক তৈরি করবেন।
* লেখক: মুহম্মদ সজীব প্রধান, শিক্ষার্থী, আইন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, গোপালগঞ্জ।