নারী আটকায় মায়ায়
বিবাহ একটি সামাজিক বন্ধন বা বৈধ চুক্তি। বিবাহ এমন একটি চুক্তি বা প্রতিষ্ঠান, যার মাধ্যমে দুজন মানুষের মধ্যে ঘনিষ্ঠ ও যৌন সম্পর্ক সামাজিকভাবে স্বীকৃতি পায়। ইসলামি আইন অনুসারেও বিবাহ বা নিকাহকে চুক্তিই বলা হয়েছে, যা বিবাহযোগ্য নারী ও পুরুষের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপনের শরীয়ত সম্মত প্রথা বা স্বীকারোক্তি।
বিভিন্ন মনীষী বিবাহ নিয়ে বিভিন্নভাবে সংজ্ঞা দিয়েছেন। এডওয়ার্ড ওয়েস্টারমার্ক বলেছেন, বিবাহ হচ্ছে নারী ও পুরুষের মোটামুটি স্থায়ী এমন একটি সম্পর্ক, যা কেবল সন্তান জন্মদান পর্যন্ত স্থায়ী হয় না বরং এরপরও কিছুদিন অন্তত স্থায়ী থাকে।
সমাজবিজ্ঞানী ই আর গ্রোভস–এর মতে, বিবাহ হচ্ছে এমন একটি দুঃসাহসিক বন্ধন, যার আইনগত ভিত্তি ও সামাজিক গোষ্ঠীর সমর্থন রয়েছে।
উইল ডুরান্ট বলেছেন, বিবাহ শুধু যৌন সম্ভোগের ছাড়পত্র নয়, বিবাহ হলো মাতা–পিতা ও সন্তানের সম্পর্ক, যা পরিবার গঠন করে সমাজ গঠনের প্রাথমিক এককের ভূমিকা পালন করে।
দেখুন ওপরের আলোচনা থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়—বিবাহ একটি চুক্তি, বিবাহ একটি প্রতিষ্ঠান। মুসলিম বিবাহে দেনমোহর বলে একটা বিষয় থাকে, কখনো কোনো কারণে যদি সেই চুক্তি বাতিল হয়ে যায়, তাহলে স্বামী দেনমোহরের টাকা তাঁর সাবেক স্ত্রীকে পরিশোধ করে দিবেন।
একটা চুক্তি বিভিন্ন কারণে ভাঙতে পারে। বিচ্ছেদ আমাদের সমাজে নতুন কিছু নয়। কিন্তু সম্প্রতি কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর ঘর ভাঙা বা বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে যেভাবে আলোচনা–সমালোচনা শুরু হয়েছে, তাতে মনে হচ্ছে গণমাধ্যম এবং দেশের সাধারণ মানুষ ইতিপূর্বে কখনো বিবাহবিচ্ছেদ নামক জিনিসটার সঙ্গে পরিচিত ছিল না।
তারা এতটাই মর্মাহত যে দিন নেই রাত নেই, এক সবক নিয়ে পড়ে আছে। শুধু তাই নয়, বিষয়টাকে পুঁজি করে এক শ্রেণির মানুষ ভালো বিজনেসও করছে। চোখ মেলে যেদিকে তাকাই, একই কথা, নারী কিসে আটকায়?
সেই প্রবাদের মতো, ‘যার বিয়ে তার খবর নাই, পাড়া–পড়শির ঘুম নাই।’ বিষয়টা ঠিক তেমন। বিচ্ছেদের পরও ট্রুডো ও সোফি কী দারুণ সময় কাটাচ্ছেন তাঁদের ছেলেমেয়ে নিয়ে আর আমরা চোখের জলে বুক ভাসিয়ে দিচ্ছি। আর ট্রেন্ড চালু করেছি, নারী কিসে আটকায়, পুরুষ কিসে আটকায়?
লোকে বলাবলি করছে, কারও টাকা, কারও ক্ষমতা, কারও সৌন্দর্য, কারও ব্যক্তিত্ব, কারও ভালোবাসা—কোনো কিছু দিয়েই নাকি নারীকে আটকানো যায় না। আচ্ছা বলুন তো, এতগুলো বিশেষণ যদি একজন মানুষের মধ্যে থাকত, তাহলেও কি নারীকে আটকানো খুব কঠিন হতো? তখন নিশ্চয়ই আটকানো যেত। সত্যি বলতে কী, এতগুলো গুণ একজনের মধ্যে কখনোই থাকে না বা থাকতে পারে না।
একেকজন মানুষ একেক রকম ক্ষমতা নিয়ে পৃথিবীতে আসে। তা ছাড়া সব কটি গুণাবলি একজন মানুষের মধ্যে থাকতে হবে, এটাইবা আশা করি কী করে?
যাঁরা জেনে বুঝে প্রেম করে বিয়ে করেন, তাঁদের একজনের কাছে অন্যজনের প্রত্যাশাটাও বেশি থাকে, কিন্তু যাঁরা মা–বাবার পছন্দে বা অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ করেন, তাঁদের একজনের আরেকজনকে জানতে–বুঝতে সময় লাগে। দুটির দুই রকম সুবিধা।
চেনাজানা মানুষটার সঙ্গে খুব সহজেই অ্যাডজাস্ট করা যায় আর অজানা মানুষটাকে জানতে ও বুঝতে বেশ সময় লাগে। তবে নতুন মানুষকে একটু একটু করে জানতে পারার মধ্যেও একটা আনন্দ আছে।
ভালোবেসে বিয়ে করার পর চেনা মানুষটা যখন একটু একটু করে বদলে যেতে থাকে, তখন ঝামেলাটা সেখানেই বেধে যায়। দুজনের ভেতর মান–অভিমান জমতে থাকে, ইগো সামনে এসে দাঁড়ায়। এসব থেকেই শুরু হয় দূরত্ব। একটা সময় অভিমান এতটাই পাহাড়সম হয়ে যায় যে একসঙ্গে আর ঘরটাই করা হয় না।
কিন্তু যাঁরা অ্যারেঞ্জ ম্যারেজ করেন, নতুন করে একে অপরকে জানেন, তাঁদের মধ্যে ভালো লাগাটাও নতুনই থাকে। তাঁরা ইগোকে খুব বেশি পাত্তা না দিয়ে সমঝোতা করে চলেন। দুই পরিবারের কথা ভাবেন তাঁরা। যে কারণে তাঁদের সংসার মজবুত হয়। সামান্য ঝড়ে তাঁদের ঘর নড়বড় করে না।
অধিকাংশ মায়ের একটা কমন কথা আছে, আর সেটা হলো—‘আমি বলেই তোমার বাপের সঙ্গে সংসারটা করলাম, অন্য কোনো মহিলা হলে জীবনেও এই লোকের সঙ্গে থাকত না।’ অথচ এই মায়েরা কিন্তু যুগের পর যুগ অত্যন্ত ধৈর্যসহকারে সংসার করে যাচ্ছেন। মুখে তাঁরা যতই বলুন, এই লোকের সঙ্গে থাকা যায় না, ভেতরে ভেতরে এ অসহ্য নামক বাবা মানুষটার জন্য মায়েদের ব্যাকুলতা ও অস্থিরতার শেষ নেই। বাবার চশমা, বাবার পাঞ্জাবি, বাবার জন্য স্বযত্নে তুলে রাখা ভালো খাবারটা এসব একজন বাঙালি মায়ের চিরায়ত অভ্যাস। কাজেই ধের্য-অভ্যাস-মায়া—এসব ফেলে সব নারী পালাতে পারেন না।
সংসারটা তো নিজের। সেখানে আমি এত কাজ করলাম, আমি একাই বাচ্চা সামলালাম, আমিই তো বাচ্চাকে স্কুলে দেই, তুমি কি করো, কেন সব দায়িত্ব একা নিব—এসব ভাবনা ভাবা বোকামি। তবে হ্যাঁ, একা হাতে সবটাই করা যায়, যখন অন্যজনও আমার জন্য ভাববে, আমাকে সময় দিবে, আমাকেও যত্নআত্তি করবে। ধৈর্য তার জন্যই ধরা যায়, দিন শেষে যে মানুষটা আমাকে নিয়েও ভাবে, দুঃশ্চিন্তা করে। অযথা মায়ার অপচয় কেউ করতে চায় বলুন?
সময় অনেক বদলে গেছে। এখনকার নারীরা স্বাবলম্বী হতে শিখে গেছে। অর্থনৈতিকভাবে তাঁরা মুক্ত। কাজেই চাইলেই একজন নারী তাঁর মতো সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
নারীরা তুলনা ও সমতার দাবি নিয়ে কথা বলতে পারেন, যা একসময় নারীরা কল্পনাও করতে পারতেন না। এখন নারীরা অনেক বেশি সাহসী ও স্পষ্টবাদী। একটা সময় ছিল যখন নারীরা অনেক বেশি শৃঙ্খলাবদ্ধ ছিল, মানে, থাকতে বাধ্য করা হতো। কারণ, তখনকার নারীরা ছিলেন নিরূপায়। নীরবে মুখ বুজে তাঁদের অনেক কিছু সহ্য করতে হতো। তাঁদের না ছিল শিক্ষা, না ছিল অর্থনৈতিক স্বাধীনতা। তাই স্বামী হাজারটা অন্যায় করলেও তাঁরা মেনে নিতেন। সব ফেলে বাবার বাড়ি যাওয়ার মতো দুঃসাহস তাঁদের ছিল না। বিচ্ছেদ তো অনেক পরের কথা।
কিন্তু এখন সময় অনেক বদলে গেছে। এখন মেয়েরাও অনেক এগিয়ে। একটা ছেলে যা পারেন, একটা মেয়েও তা করতে পারেন। এটা নারীর অহংকার যেমন, তেমনি আত্মমর্যাদাও। এখন আর নারীদেরকে পড়ে পড়ে খেতে হয় না। মাতাল ও চরিত্রহীন স্বামীর জুলুম সহ্য করতে হয় না। এর একমাত্র কারণ শিক্ষা। আসলে পায়ের তলার মাটি যখন শক্ত হয়ে যায়, তখন যেকোনো মানুষ সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন।
তবে কোনো কোনো নারী শিক্ষা থাকা সত্ত্বেও টাকা ও ক্ষমতার কাছে আটকায়। আমাদের দেশে এমন অনেক শিল্পপতি ও রাজনৈতিক ব্যক্তি আছেন, যাঁরা বিভিন্ন অনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত। সেটা হোক নারী কেলেঙ্কারি কিংবা অর্থ কেলেঙ্কারি। স্বামীর এত এত অনৈতিক কর্মকাণ্ড জেনেও কিন্তু তাঁদের স্ত্রীরা ছেড়ে চলে যান না।
এটাকে কী বলবেন, স্বামীর প্রতি দয়া-করুনা? আসলে এসব নারীরাও জানেন, ভোগ বিলাসের জীবন নিয়ে বেঁচে থাকতে হলে সব সয়ে নিয়েই থাকতে হবে। তা ছাড়া ছেড়ে যাওয়াই তো কোনো সমাধান নয়। সেই নারীও তো তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন তাঁর স্বপ্নের সংসার। তাঁরা মুখ বুজে সন্তান আর নিজের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে এসব অসভ্য লোকের সঙ্গে থেকে যেতে বাধ্য হন। নারী কখনো কখনো আটকায় অসহায়ত্বের কাছে।
আমাদের সমাজে মেয়েরা জন্মলগ্ন থেকেই একটা নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে বড় হয়। ছেলেবেলায় ভাই বা বাবা, বড় বেলায় প্রেমিক অথবা স্বামী—কাউকে না কাউকে নির্ভর করেই তাঁদের চলতে শেখানো হয়। একটা মেয়ে লেখাপড়া শেষ করে যত বড় চাকরিই করুক না কেন, পরিবার থেকে, সমাজ থেকে তাঁকে অনবরত চাপ দেওয়া হয়, কবে সেই মেয়েটা সেটল করবে? সেটল মানেই বিয়ে। মেয়েটা যদি মেজর বা এসপিও হয়, তা–ও বলবে আগে নিজেকে স্থিত করো। দেখুন, একজন পুরুষ মানুষকে যতক্ষণ না আপনি জীবনসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করছেন, ততক্ষণ আপনি যত বড় যোগ্যই হোন না কেন, আপনি পরিবার ও সমাজে অনিরাপদ। আমাদের চিন্তাভাবনাই পুরুষকেন্দ্রিক।
আমি এমন দুজন নারীকে দেখেছি, যাঁরা নিজেরা অক্লান্ত পরিশ্রম করে ছেলেমেয়ের লেখাপড়া থেকে শুরু করে যাবতীয় খরচ বহন করেছেন, কিন্তু কখনো স্বামীর নামে কোনো বাজে কথা বা নিন্দে মন্দ করেননি। অনেক সহকর্মী তাঁদের অনেক রকম উসকানিমূলক কথা বলেছেন কিন্তু সেসবে তাঁরা কান দেননি। সব সময় স্বামীর প্রশংসা করেছেন। একলা একলা যুদ্ধ করেছেন তবু স্বামীকে ছেড়ে যাওয়ার কথা ভাবেননি। অর্থনৈতিকভাবে পাশে দাঁড়াতে না পারলেও অনেক সময় মানসিকভাবেও পাশে থাকা যায় আর এ জন্যই হয়তো তাঁরা লড়াই করার সাহস ও শক্তি পেয়েছেন।
আমি আমার কয়েকজন বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলাম, তাঁরা যে এ দীর্ঘ বছর সংসার করছেন, কিসের টানে রয়ে গেছেন তাঁরা?
তাঁদের সবারই প্রায় একই উত্তর, তাঁরা নাকি সংসার আর সন্তানের মায়ায় আটকে গেছেন, তাই মন না চাইলেও অনেকটা বাধ্য হয়েই তাঁদের থাকতে হচ্ছে।
এক সিনিয়র আপাকে জিজ্ঞাসা করলাম, আপনি কিসের জন্য বুড়ি হলেন এ সংসারে থেকে? একটু জানতে পারি কি?
তিনি খুব ধীর ও শান্তভাবে বললেন, ‘বিয়েটা না একটা ঝুঁকি। খুব কম মেয়েরই বলতে গেলে ভালো বিয়ে হয়, মানে, মনের মতো মানুষ পান। এই যেমন দেখো, আমরা তেমন কিছু বুঝে উঠার আগেই মা–বাবার কথা মতো বিয়ে করে ফেলেছি, ঝড়ঝঞ্ঝা সয়েই কেটে গেল এতগুলো বছর। চুলে পাক ধরেছে, শরীরে নানা ব্যাধি বাসা বেঁধেছে, ওপারে চলে যাওয়ার সময় হয়ে এল, তবু মনে হয় আমি চলে গেলে এ লোকটার কী হবে। জানো তো, সংসার এমনি এক আজব জায়গা। তোমার চাওয়ার মতো কিছুই হবে না এখানে, তবু থেকে যেতে হয়।’
এই দেখে আমার দুই বোন তো ভালোবেসে প্রেম করে বিয়ে করেছে, অথচ সব সময় ঝামেলা লেগেই আছে। ভালো লাগে না এসব। তার চেয়ে মনে হয় সমঝোতা করে থেকে যাওয়াই ভালো।
আপনাকে আরেকটা প্রশ্ন করি?
হুম করো।
অনেক মেয়েই তো বলে অন্য মেয়ের সঙ্গে তাঁর স্বামীর অবৈধ সম্পর্ক। এটা জেনেও তাঁরা সংসার করছেন। তাহলে এ ক্ষেত্রে কী বলবেন?
পুরুষ মানুষের চরিত্র ভালো হয় না, এটা জানো না। আমি কিছু পুরুষের কথা বলছি। হ্যাঁ, হয়তো তাঁরা সংসার করছেন, তবে মেনে নেওয়া আর মনে নেওয়া—এক জিনিস নয়।
বর্তমান যুগে শিক্ষার হার বেড়েছে। নারীরা পুরুষের চেয়ে কোনো অংশে কম নন। এখন চাইলেই আর নারীদের ওপর অন্যায়–অত্যাচার–জুলুম করা যায় না। অর্থনৈতিকভাবে তাঁরা স্বাবলম্বী বলেই বিচ্ছেদের সংখ্যাও বেড়ে গেছে। সংসারের রোজকার অভ্যাস, সন্তানের ভবিষ্যৎ, স্বামীর প্রতি মায়া–ভালোবাসা—এসব কোনো কিছুই আর ম্যাটার করে না, যেটা ম্যাটার করে, সেটা হলো—আত্মসম্মান। ভালোবাসার পাশাপাশি সম্মানটাও থাকা জরুরি। যেখানে সম্মান নেই, সেখানে থাকা যায় না। অনেকেই হয়তো বলবেন, এত বেশি ইগো আর আত্মসম্মান দেখালে তো কারোর সংসারই টিকবে না।
আসলে যে ঘরে ভালোবাসা লোক দেখানো, সম্মান যেখানে শূন্যের কোঠায়—সেই ঘর ভাঙলেই কি আর থাকলেই কি!
সম্প্রতি আমরা যে গল্পের জাল বিছিয়েছি, নারী কিসে আটকায়—মূলত নারী ও পুরুষ উভয়েই মায়াতেই আটকায়, ভালোবাসায় আটকায়, দায়িত্ববোধে আটকায়। কার কত টাকা, কার কত ক্ষমতা—এসব বোধ হয় প্রকৃত অর্থে সংসার করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়। যে মানুষটা বাইরে অনেকের কাছে ভালো ও স্বচ্ছ, সেই মানুষটাই ঘরে একদম অন্য রকম অচেনা।
আজকাল ঘর ভাঙার আরও একটা কারণ হলো কমিউনিকেশন, মানে, যোগাযোগব্যবস্থা। সেটা হতে পারে ফোন কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। মানুষের হাতের মুঠোয় স্মার্টফোন, তাতে ঘরে বসেই পুরো পৃথিবী উপভোগ করা যায়। চাইলেই আমরা যেকোনো নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে যেতে পারছি।
একজন অপরিচিত মানুষও খুব সহজে আপন হয়ে যায়। কাউকে না চিনে, না জেনে আমরা ভালোবেসে ফেলি, হৃদয়ের আদান-প্রদান করে ফেলি। ছোট–বড়, ভালো–মন্দ কোনো ভেদাভেদ বুঝতে চাই না। সম্পর্ক যেন এখন ডালভাত।
কেউ কাউকে না চিনে, না জেনে টেক্সট পাঠিয়ে দিচ্ছেন, ভালোবাসি বলে ফেলছেন। ইনবক্স খুললে দেখবেন হাজারটা টেক্সট সেখানে জমা। কয়েক দিন আপনি উত্তর দিবেন না বা কতজনকে ইগনোর করবেন? একদিন না একদিন, কাউকে না কাউকে ঠিক আপনার ভালো লাগবে, রেসপন্স করবেন। এভাবে আস্তে আস্তে গভীর সম্পর্কে জড়িয়ে পড়বেন। তারপর একদিন বুঝতে পারবেন, একি সর্বনাশ হয়ে গেছে আপনার! তখন আর আলাদা হওয়া ছাড়া কোনো উপায় খুঁজে পাবেন না।
জীবনকে আমরা এত হালকাভাবে নিতে শিখে গেছি যে এই জীবন যে একটাই ও তা অর্থপূর্ণ এবং আনন্দে কাটানো উচিত, তা আমরা নিজেদের তৈরি নানা জটিলতার কারণে ভুলে যাই।
অনেক সময় মানুষ সংসারের নানা জটিলতা থেকে বাঁচতে গিয়ে অন্য একটা নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন শুধু একটু শান্তির খোঁজে। কিন্তু পরবর্তী জীবনটা আদৌ শান্তির হবে কি না, তার নিশ্চয়তাটুকু আমরা ভেবে দেখি না। ঘরভাঙা এখন ছেলেবেলার পুতুলখেলার মতো সহজ হয়ে গেছে। পান থেকে চুন খসলেই মানুষ আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত নেন। সহজ শর্তে বেছে নেন— বিচ্ছেদের মতো কঠিন পথ। আসলে বিচ্ছেদ বা দূরত্ব কোনো সমাধান নয়। সমঝোতা করে মানিয়ে নিয়ে চলার নামই জীবন।
যদিও শুরুতেই আমি বিভিন্ন সংজ্ঞার মাধ্যমে বলেছি, বিবাহ একটা চুক্তি বা প্রতিষ্ঠান। আজীবন এ চুক্তিতে বহাল না–ও রাখতে পারেন একজন মানুষ, তবে অবশ্যই তার যুক্তিসংগত কারণ থাকতে হবে।
বাংলাদেশের মানুষের আত্মার বিনোদনের অভাব এবং তার বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক কারণ রয়েছে। তাই যেকোনো একটা বিষয় পেলেই আমরা সেখানে ঝাপিয়ে পড়ি। এই যেমন ধরুন, নারী কিসে আটকায় বা পুরুষ কিসে আটকায়। কেউ এটার ভালো ব্যাখ্যা দিচ্ছেন আবার কেউ অপব্যাখ্যা করছেন। মানুষ কিন্তু মনে পাখি হলেও শরীরে পাখি নয়, কাজেই তাঁকে আটকিয়ে বা বন্দী করে রাখা কঠিন। যদি সে নিজে থেকে আটকে না যায়। তেমনি অনেকেই বলছেন, নারীকে ধরে রাখে এমন সাধ্য কার?
নারী তো বাঁধা পড়ে মায়ায়। নারীর মতো মমতাময়ীকে আটকাতে টাকা বা ক্ষমতা লাগে না। একটুখানি যত্ন আর ভালোবাসা পেলেই তাঁরা আজন্ম বুকের ভেতর লালন করে প্রিয় মানুষটাকে।
হেলাল হাফিজ তাঁর অনির্ণীত কবিতায় বলেছেন,
নারী কি নদীর মতো
নারী কি পুতুল,
নারী কি নীড়ের নাম
টবে ভুল ফুল।
নারী কি বৃক্ষ কোনো
না কোমল শিলা,
নারী কি চৈত্রের চিতা
নিমীলিত নীলা।
লেখক: রোজিনা রাখী