তরুণ উদ্যোক্তা তৈরিতে ‘পৃষ্ঠপোষকতা’ কেন প্রয়োজন

প্রতীকী ছবি

প্রতিবছর কয়েক লাখ শিক্ষিত তরুণ-তরুণী চাকরির বাজারে প্রবেশ করছেন। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পর তাঁদের প্রথম পছন্দ থাকে একটি সরকারি চাকরি প্রাপ্তি। চাকরির নিরাপত্তা, সামাজিক মর্যাদা ও বেশি সুযোগ–সুবিধা পাওয়াকে মোটাদাগে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। অনেকে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করতে না পেরে বিভিন্ন বেসরকারি চাকরি করেন। নিতান্তই নিজের পছন্দে প্রথমেই বেসরকারি চাকরিতে প্রবেশের সংখ্যা নগণ্য। আবার সরকারি–বেসরকারি চাকরির একটি নির্দিষ্টসংখ্যক পদ থাকে, ফলে এখানে সবার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয় না। অন্যদিকে, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে না পারায় বেকারত্বের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

২০২৩ সালের শ্রমশক্তি জরিপের তথ্য বলছে, দেশে ২৫ লাখ ৯০ হাজার বেকার রয়েছেন। বেকারদের মধ্যে অধিকাংশই তরুণ। সম্প্রতি একশনএইড বাংলাদেশ ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশে যুবগোষ্ঠীর বড় অংশ আর্থসামাজিক ঝুঁকির মধ্যে আছে। বৈষম্য আর গুণগত শিক্ষার অভাবে ৭৮ শতাংশ তরুণ মনে করেন, পড়াশোনা করে তাঁরা চাকরি পাবেন না, গরিব শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এ হার ৯০ শতাংশ। চাকরি, পড়াশোনা বা প্রশিক্ষণে নেই ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ তরুণের। (প্রথম আলো, ১২ আগস্ট ২০২২)

আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা চাকরি বা আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারছে না। ফলে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ বেকারত্ব তরুণদের মধ্যে একধরনের হতাশা সৃষ্টি করছে। হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে কেওবা খুন, ধর্ষণ, নেশাগ্রস্ত বা পর্ণগ্রাফিতে আসক্ত হচ্ছেন, যার মাধ্যমে সামাজিক অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে সামাজিক অপরাধ হ্রাস ও কর্মসংস্থান তৈরি করতে তরুণ উদ্যোক্তার সংখ্যা বৃদ্ধির সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে, যা মানুষের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের সঙ্গে দেশের জিডিপিতে অবদান রাখতে পারবে। তবে এই পথে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। উদাহরণস্বরুপ বলা যায়, অর্থসংস্থান, পারিবারিক ও সামাজিক মর্যাদা, প্রশিক্ষণ, বাজারজাতকরণ, ন্যায্য মূল্য প্রাপ্তি, নিরাপত্তা ইত্যাদি। প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সামগ্রিকভাবে পৃষ্ঠপোষকতার বিষয়টিতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। কারণ, একজন তরুণ উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে গ্রামে কৃষি বা গরুর ফার্ম করবেন, এমনটা পারিবারিক বা সামাজিকভাবে কেও মেনে নিতে পারে না।

তাদের মনোজগতে বাসা বেঁধে থাকে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের পরই সরকারি চাকরিতে প্রবেশ করা। আবার অন্যদিকে, একজন তরুণের হাতে কৃষি বা গরুর ফার্ম করার মতো অর্থও থাকে না। ফলে ঋণপ্রাপ্তি বেশির ভাগ সময়ই প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। কোনোভাবে পরিবার বা ঋণের টাকায় কেও কৃষি চাষাবাদ শুরু করলেন কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা অন্য কারণে আর্থিকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হলে উত্তরণের উপায় কি হবে? এসব নানা কারণে অনেকে উদ্যোক্তা হচ্ছেন না। ফলে এসব বিষয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করলে তরুণদের আগ্রহী করা যাবে উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে।

প্রথমত, পারিবারিক ও সামাজিকভাবে উদ্যোক্তাকে ইতিবাচকভাবে গ্রহণের মনোভাব তৈরি করতে হবে। এতে উদ্যোক্তা হতে অনেকে উৎসাহ পাবেন। এরপর অর্থের ব্যবস্থা করতে হবে। এই দুই বিষয় সুষ্ঠুভাবে ব্যবস্থাপনা করতে পারলে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। যার মাধ্যমে তাঁরা ঝুঁকি নেওয়ার মনোভাব; ইতিবাচক ধারণা; নতুনত্বের প্রতি আগ্রহ তৈরি; পণ্য বিক্রয়ে দেশ–বিদেশের বাজার সম্পর্কে জ্ঞানলাভ; নতুন নতুন বাজার সৃষ্টি করা; পারস্পরিক সম্পর্ক ও যোগাযোগ বৃদ্ধি করে ব্যবসার প্রসার; দূরদৃষ্টিসম্পন্ন হয়ে বাজারে চাহিদা সম্পর্কে আগে থেকে ধারণা লাভ; অমায়িক ব্যবহার; গ্রাহকদের চাহিদা পূরণ ও সেবার মান বৃদ্ধি; ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনা; দুর্যোগ মোকাবিলা; সামাজিক যোগাযোগ ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান লাভ এবং নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টিসহ বিভিন্ন বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করবেন। পরবর্তী সময় তাঁদের এই দক্ষতা নিজের পছন্দের সেক্টরে প্রয়োগ করতে পারবেন। গ্রামের তরুণেরা পশুপালন, মৎস্য চাষ ও কৃষি খামার তৈরিতে অবদান রাখতে পারেন। এ ছাড়া ছোট–বড় ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, হস্ত ও কুটিরশিল্প, কম্পিউটার প্রযুক্তিতে নিজের অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগাতে পারেন। ফলে সবকিছুতে পৃষ্ঠপোষকতা দেওয়াটাই মূল হাতিয়ার হিসেবে কাজ করবে এখানে। এ ক্ষেত্রে সরকারকে সরাসরি ভূমিকা রাখতে হবে। উপজেলা পর্যায়ে বেকার তরুণদের প্রশিক্ষণ ও অর্থের ব্যবস্থার মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়তা করতে সমাজবিজ্ঞানী এবং কৃষি, মৎস্য, প্রযুক্তিবিদসহ বিভিন্ন বিষয়ের দক্ষদের কাজে লাগাতে হবে। যাঁরা নিয়মিত তদারক করে উৎপাদিত পণ্য ও ব্যবসার প্রসার, সমস্যার সমাধান ও দিকনির্দেশনা দিবেন। উৎপাদিত পণ্য বিক্রি ও ব্যবসা–বাণিজ্য সম্প্রসারণে ওয়েবসাইট খুলে দিতে হবে। এর মাধ্যমে নিজেদের উৎপাদিত পণ্য সম্পর্কে তথ্য আদান–প্রদান করতে পারবেন। মাধ্যমিক থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে বিভিন্ন বিষয় সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। ছাত্র অবস্থায় উদ্যোক্তা হতে আগ্রহী করতে নিয়মিত সেমিনার ও সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করা যায়। ধারণা করা যায়, সামনের দিনগুলোয় বিজ্ঞানের শাখা–প্রশাখা আরও প্রসারিত হবে। ফলে আইসিটি ও কম্পিউটার প্রযুক্তিতে তরুণদের বেশি এগিয়ে থাকতে হবে। এতে উদ্যোক্তা হওয়ার পাশাপাশি ঘরে বসেই দেশ–বিদেশে চাকরি করতে পারবেন। অনাগত দিনে স্মার্ট বাংলাদেশের তরুণেরা নিজেদের আগে থেকেই সব ক্ষেত্রে স্মার্ট সিটিজেন হিসেবে গড়ে তুলবেন। এ ছাড়া বাজারজাতকরণ, ন্যায্য দাম ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করতে হবে। এভাবে সরকারের সঙ্গে বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা যুক্ত করে তরুণদের বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের পথ তৈরি করতে হবে। সঠিক পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া বেকারত্ব ও সামাজিক অপরাধ দূর করা সম্ভব হবে না।

ফলে বলা যায়, সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে তরুণ উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে বিপ্লব ঘটানো যায়।

লেখক: সামিয়া চাঁদ, শিক্ষক, সরকারি সোহরাওয়ার্দী কলেজ, ঢাকা