আমার ফেলে আসা শীতের সকাল
স্থান–কাল–পাত্রভেদে জীবিকার সংগ্রামে ব্রত সৈনিক আমরা কখনো জীবনপ্রবাহে চলে যেতে, কখনো অস্তিত্বের স্বার্থে, আবার কখনো উন্নত থেকে আরও অধিক উন্নত জীবনকল্পে রকমারি কর্মপ্রয়াশে জীবনকে সাজাতে ব্যস্ত আমরা প্রতিনিয়ত, তাই বলে অনুভূতিহীন নই আমরা। ফেলে আসা প্রতিটি কাল আজ আমাদের কাছে অতীত, সেখান থেকে কিছু অতীত মানুষের অনুভূতিকে নাড়া দেয়, তাইতো ব্যক্তি সেগুলোকে রেখে দেয় স্মৃতিসাগরের অ্যালবামে। কখনো কখনো ওই হাঁপিয়ে ওঠা তৃষ্ণার্ত জীবিকা সংগ্রামের সৈনিকেরা ডুবে যায় স্মৃতির সাগরে কোনো এক স্মৃতির সন্ধানে, যা তাদের সুখের অনুভূতি দেয়, মানুষের জীবনে কিছু অনুভূতি থাকে সর্বদাই পরিবর্তনহীন, তেমনি এক অনুভূতি হচ্ছে আমার ফেলে আসা শীতের সকাল।
আজ আমি ইট–পাথরে ঘেরা তথাকথিত আধুনিক শহরের নাগরিক, এ জনপদেও শীত নেমে আসে শীতকে ঘিরে চলে হরেক আয়োজন, তবে সেগুলো একটি বিশুদ্ধ গ্রামে বেড়ে ওঠা মানুষগুলোর কাছে তাদের অনুভূতির সঙ্গে নিছক পরিহাস। আমার স্মৃতির আকাশে এক বিশালতার নাম শীতের সকাল, প্রতিবছর শীত এলেই তা আমার অনুভূতিগুলোকে নাড়া দেয়। শীতের সকালের সেই ফেলে আসা দিনের সুখময় স্মৃতিগুলো আমাকে বাধ্য করে তার মুগ্ধতায় মগ্ন হতে, এ যেন টেনিসনের সেই বিখ্যাত লোটাস এটার কাব্যের মতো, যেখানে লোটাস এটাররা রহস্যময় মানুষ, যারা একটি ছোট্ট দ্বীপে বসবাস করে, তারা নিয়মিত পদ্মগাছ খেয়ে থাকে, যা তাদের জীবনে চিরস্থায়ী সুখের অনুভূতি দেয় এবং কি ক্ষণিকের জন্য সমস্ত জরুরি বোধ থেকে ভুলিয়ে রাখে। অডিসিয়াসের লোকেরাও তাদের যাত্রাপথে কিছু সময়ের জন্য ওই দ্বীপে থামে এবং তারা লোটাস এটারদের সঙ্গে পদ্মগাছ খেয়ে নেয় এবং এর স্বাদে এতটাই মগ্ন হয় যে তারা তাদের বাড়ি ফিরে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলে, তারা লোটাস এটারদের সাথেই চিরকাল থেকে যেতে চায়। শীতের সকালের স্মৃতির মুগ্ধতাও আমাকে যেন সেই কাব্যের লোটাস এটারদের দেশে নিয়ে যায়।
গ্রামবাংলার শীতের সকাল শুরু হতো কুয়াশা আর ধোঁয়াশার আচ্ছাদনে প্রকৃতির এক অপরূপ সৌন্দর্য প্রদর্শনের মধ্য দিয়ে, যেখানে মাঝেমধ্যে মনে হতো সাদা মেঘের রাশি পৃথিবীর বুকে নেমে এসেছে প্রকৃতির আলিঙ্গনে। কুয়াশার চাদরে আচ্ছাদিত সূর্য মামাও যেন শীতকাতুরে আলসেমির ছলে নিজেকে আড়ালে রাখে বেশ খানিকটা সময়। পূবের আকাশে মৃদু মিষ্টি কিরণমালার ছোঁয়ায় ভেজা দুর্বাঘাস আর শর্ষে ফুলের নীল দিগন্তে কি যে এক স্নিগ্ধতার মোহ ছিল, প্রকৃতি যেন নিজ হাতে তার সন্তানদের এর প্রভাত স্নান করিয়ে দিত। প্রকৃতির হাজারো আয়োজনের ভিতরেও জনপদের মানুষগুলোর জীবনের কর্মব্যস্ততা কখনোই থেমে থাকেনি, শীতের প্রবল তীব্রতা সত্ত্বেও মায়ের বকুনির ভয়ে লেপের উষ্ণতাকে উপেক্ষা করে দল বেঁধে সবাই চলে যেতাম মাদ্রাসায়, চারপাশে পাখিদের কলরব আর সেই সাথে হুজুরের মুখের শ্রুতি মধুর তিলাওয়াত কি যে এক আবেগঘন ভালো লাগা ছিল।
লাঙল–জোয়াল কাঁধে আর হালের গরুটিকে নিয়ে মেঠোপথের বাঁক ধরে কৃষক ছুটে চলত তার সোনার ফসলি জমির দিকে। জীবিকার আবেদনে তার কাছে শীত ছিল নিতান্তই এক মেনে নেওয়া বাস্তবতা। শিশির ভেজা ধুলাকণাগুলো যখন কৃষকের পায়ে জড়িয়ে থাকত, ওটাই বোধ হয় ধরণীকে খুব কাছে থেকে অনুভবের সবচেয়ে আপন প্রয়াস ছিল। শীতের সকালের সূর্যটা একটু কিপটেই হয় তাইতো কিঞ্চিৎ আলো উঁকি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বাড়ির বুড়ো আর বাচ্চারা ব্যস্ত হয়ে পড়ত, রোদ পোহাতে। উঠোনের যে কণাটায় রোদটা বেশি থাকত, সেখানেই ঘণ্টাব্যাপী চলত প্রয়োজনীয় কিংবা অপ্রয়োজনীয় সংসারের খুঁটিনাটি হাজারো গল্পের পসরা, কেউবা বসে যেত গরম ভাতের সঙ্গে শীতে জমাট বাঁধা পুঁটি মাছের ঝোল নিয়ে, কি যে এক অতুলনীয় তৃপ্তির স্বাদ ছিল, সেই অনুভূতি কোন আভিধানিকতায় প্রকাশ করা যায় না। মাটির চুলার পাশে বসে নতুন ধানের চালে খেজুরের গুড়ে দাদির হাতে বানানো ভাপা পিঠার শুভ্র ধোঁয়া মেশানো বাতাসে এক তৃপ্তির নিশ্বাস। ভোরের বাতাসে মাঝেমধ্যে ভেসে আসত কোনো এক গাছির খেজুরের রসে পাটালি গুড় তৈরির শেষমুহূর্তের এক মাতাল করা ঘ্রাণ। গ্রামের পাসের বিলগুলো যেন নিজেদের সাজিয়ে রাখত ভিনদেশি পাখিদের আগমনে, মাঝেমধ্যে ঘন কুয়াশার চাদর ভেদ করে ভেসে আসত জেলেদের মাছধরা নৌকার টুকটাক শব্দ আর আপন সুরে গাওয়া কিছু গান।
গ্রামের এই ভালোলাগা স্মৃতিময় মুহূর্তগুলোর মোহ কারো হাজার বছরের জীবনেও তার তৃপ্তির স্বাদ মেটাতে পারবে না। তাই হয়তো জীবনানন্দ লিখেছেন, ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিড়িটির তীরে এই বাংলায়।’
*লেখক: মেহেদী হাসান রনি, মার্চেন্ডাইজিং ম্যানেজার