অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে প্রয়োজন টোল ফ্রি ফোন, সরকারি সেবা অ্যাপ ও ওয়েবসাইট ব্যবহারে ফ্রি ইন্টারনেট  

মুঠোফোনপ্রতীকী ছবি

জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্থহীন হয়ে যাবে, যদি আমাদের বিশাল জনগোষ্ঠী এই উন্নতির সুফল না পায়। আমাদের দেশে বৈষম্যমূলক বিতরণব্যবস্থার কারণে ধনী আরও ধনী হচ্ছে এবং দরিদ্র আরও দরিদ্র হচ্ছে। ডিজিটাল রূপান্তরের অগ্রযাত্রায় আমরা আমাদের অনেক অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়ার আশা করছি। তবে এ জন্য আমাদের ডিজিটাল সাক্ষরতার অভাব, স্মার্টফোনের অপ্রাপ্যতা, সাশ্রয়ী মূল্যে ডেটা প্যাকের সীমাবদ্ধতা এবং উপেক্ষিত বা অবহেলিত জনগোষ্ঠীকে অন্তর্ভুক্তির আওতায় নিয়ে আসার প্রচেষ্টার অভাবের ফলে তৈরি হওয়া ডিজিটাল ডিভাইড ঘোচানোর বিষয়ে আরও সচেতন হতে হবে।

ডিজিটাল রূপান্তর এবং সব ধরনের সরকারি সেবার জন্য মোবাইল অ্যাপ বা ওয়েবভিত্তিক সার্ভিসের গুরুত্ব অপরিসীম। দেশব্যাপী বিভিন্ন পর্যায়ে আর্থিক ও অ-আর্থিক সেবা প্রদানকারী সব সরকারি, আধা সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন ডিজিটাল অবকাঠামো গঠনের চেষ্টা করছে। কিন্তু বহুমুখী সেবা চালুর পাশাপাশি সেবার মান, মানুষের প্রয়োজন অনুযায়ী সেবার ডিজাইন এবং ডিজিটাল রূপান্তরের উদ্যোগকে উন্নত করতে হবে, যাতে সাধারণ মানুষের জীবনে সত্যিকারের পরিবর্তন আনা যায়।

এ ছাড়া এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর খরচ এবং প্রাপ্যতার সঙ্গে সম্পর্কিত এখানে আরও কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে:

১। টোল ফ্রি কল সেন্টার বা সহায়তা কেন্দ্রের সংখ্যা এবং

২। নিম্নমধ্যম ও নিম্ন আয়ের বিশাল জনগোষ্ঠীর হাতে ইন্টারনেট বা মোবাইল ইন্টারনেট ব্যালেন্সের প্রাপ্যতা।

সাধারণ মানুষের হাতে কী পরিমাণ স্মার্টফোন রয়েছে এবং মোবাইল টক টাইম ও ইন্টারনেট খরচ কী রকম, এই বিষয়গুলোও এ ক্ষেত্রে সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো নিয়ে অনেক ফোরামে আলোচনাও হচ্ছে।

ডিজিটাল সেবা প্রদান করতে ২৪/৭ কল সেন্টারের প্রয়োজনীয়তা আবশ্যক। তবে এই কল সেন্টারগুলোতে কল করে কথা বলতে খরচ অনেক সময় বেশি হয়ে থাকে। কারণ, শর্টকোড নম্বরে কলের জন্য মিনিট প্রতি ২ টাকার বেশি খরচ হয়। কলের দৈর্ঘ্যের ওপর ভিত্তি করে গ্রাহকদের প্রায় ২০-২৫ টাকা ব্যয় করতে হয়। উন্নত বিশ্বে টোল ফ্রি লাইনের ব্যবহার একটি গ্রাহকবান্ধব সংস্কৃতির অংশ এবং সাধারণ চর্চা। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোও এতে জোর দেয়। আমাদের সমাজে সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ডিজিটাল প্রযুক্তি ও সেবাগুলোর ব্যবহার বাড়াতে নিম্নমানের সেবা এবং অপ্রয়োজনীয় চার্জ থেকে সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতাগুলোর দ্রুত সমাধান করা প্রয়োজন। একজন প্রযুক্তি পেশাজীবী হিসেবে আমি সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান, সেবা প্রদানকারী এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার প্রতি এই বিষয়ে দৃষ্টিপাত করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য বিশেষভাবে অনুরোধ করছি। এতে অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশ গঠন আরও সহজ হবে।

টোল ফ্রি লাইন চালুর পাশাপাশি ব্র্যাক ব্যাংক আমাদের গ্রাহকদের জন্য কোনো ইন্টারনেট খরচ ছাড়াই ব্যাংকিং অ্যাপ ব্যবহারের সুবিধা দিয়েছে। যখন কোনো গ্রাহক ব্র্যাক ব্যাংকের আস্থা অ্যাপ ব্যবহার করেন, তখন গ্রাহকের হয়ে ব্যাংক নিজেই ইন্টারনেট খরচ বহন করে। মোবাইল অপারেটরদের সঙ্গে পরিকল্পিত অংশীদারত্বের ফলে এটা সম্ভব হয়েছে। ইতিমধ্যে আরও অল্পসংখ্যক ব্যাংকও এই উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে থাকা ব্র্যাক ব্যাংকের গ্রাহকেরা এখন আর ইন্টারনেট ব্যালেন্স না থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকিং সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন না। ফলে ব্যাংকিং সেবায় আমাদের ‘ডিজিটাল পেনেট্রেশন’-এর  হার ব্যাংকিং খাতে সর্বোচ্চ।

বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর ইন্টারনেট–সংযোগ নেই। তাই কোনো খরচ ছাড়াই ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ না দিলে কোনো ডিজিটাল সেবাই তাদের জন্য কার্যকর হবে না। আর্থিক সেবা প্রদানকারী বড় প্রতিষ্ঠানগুলো (যেমন বিকাশ, নগদ, রকেট, উপায়, ব্যাংকিং অ্যাপ এবং সরকারি সেবার বিভিন্ন অ্যাপ ও ওয়েবসাইট) নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগুলো গ্রহণ করলে আরও অনেক বেশি মানুষ এ সেবাগুলো নিতে পারবে। এটি সেবা প্রদানকারীদের জন্য বাস্তবায়নযোগ্য হবে।

১। আমরা নির্দিষ্ট সাইট বা সেবা ব্যবহার করার সময় যাঁদের ইন্টারনেট ব্যালেন্স নেই বা শেষ হয়ে গেছে, তাঁদের জন্য মোবাইল অপারেটরের মাধ্যমে ইন্টারনেট খরচ ছাড়াই সাইট বা অ্যাপের সেবা গ্রহণ করার সুযোগ করে দেওয়া যেতে পারে। এখানে সেবা প্রদানকারীরা এই ইন্টারনেট ব্যবহারের খরচ বহন করবেন।

২। এটি গ্রাহক, অপারেটর, সেবা প্রদানকারী এবং দেশ—সবার জন্যই লাভজনক হবে। কারণ, এতে আরও অনেক বেশি মানুষ ডিজিটাল সেবার আওতায় আসবে।

৩। এ নিয়ে সচেতনতা তৈরি হলে এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো সহায়তা করলে অনেক বেসরকারি, আধা সরকারি, সরকারি প্রতিষ্ঠানও এ ধরনের সেবার গ্রাহক হবে।

অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল সেবার সুবিধাগুলো নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বিটিআরসি, অন্যান্য নিয়ন্ত্রক সংস্থা, মোবাইল অপারেটর এবং সেবা প্রদানকারীদের প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তা প্রয়োজন। এই লক্ষ্যে কাজ করার মাধ্যমে আমরা আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকে আরও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থে কাজে লাগাতে পারি। এটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল সেবা প্রদানের প্রতিশ্রুতি পূরণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সাইকেল চালানো একবার শিখলে কেউ যেমন তা আর ভুলে যায় না, তেমনি কোনো ব্যক্তিও একবার ডিজিটালভাবে একটি সরকারি সেবা গ্রহণ করতে শিখে গেলে সেটি আর ভুলবে না। এই আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা পেয়ে গ্রাহক আরও বেশি ডিজিটাল সেবা গ্রহণ করতে উৎসাহিত হবেন। পিছিয়ে পড়া বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন সেবার চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়বে, যদি সেবাগুলো তাঁদের উপযোগী করে তৈরি করা হয়, এগুলোর প্রচার চালানো হয় এবং এটিকে জাতীয় অন্তর্ভুক্তি এজেন্ডায় পরিণত করা হয়।

লেখক: ব্র্যাক ব্যাংকের ডেপুটি ম্যানেজিং ডিরেক্টর অ্যান্ড চিফ অপারেটিং অফিসার