সেই কাকভোর থেকে মাজেদা খাতুন খুব ব্যস্ত। আজ তাঁর নাতনির বিয়ে। হুট করেই গতকাল বিকেলে বিয়েটা ঠিক হয়েছে। এক রাতের মধ্যে সব জোগাড়যন্ত গুছিয়ে নিতে হয়েছে। বাড়ির এত মানুষের জন্য সকালবেলায় খিচুড়ি রেঁধেছে, এরপর দুপুরের খাবারের আয়োজনের জন্য সব কিছু তদারক করছেন তিনি। বাড়িতে তাঁর তিন ছেলের বউ রয়েছেন, তারপরও এসব তাঁকেই দেখতে হচ্ছে, করতে হচ্ছে। সকাল থেকে আদা, রসুন, জিরা বাটার জন্য এত করে বলেও যখন কাউকে পাওয়া গেল না, তখন নিজেই শিলপাটা নিয়ে বসে গেলেন। মসলা বাটছেন আর আপনমনে গজগজ করে চলেছেন—

‘বাড়িভর্তি মানুষ কেউ একটা কামে আউগায় না! তিন ঘণ্টা ধইরা কইতেছি, কেউকে পাওয়া গেল না আর...’

বুকের ভেতর পাহাড়সমান যন্ত্রণা চেপে রেখে সকাল থেকে একা হাতে কত কাজ সামলে যাচ্ছেন তিনি! আজ তাঁর নাতনির বিয়ে, বাড়িতে কত লোক আসবেন অথচ তাঁর একমাত্র মেয়েটাকে দাওয়াত করা হয়নি! মেয়েটা হাসপাতালে অসুস্থতা নিয়ে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন, সে খোঁজও ছেলেরা কেউ নিচ্ছেন না। মেয়ের জন্য তাঁর অন্তরে কতটা ভাঙচুর হয়ে যাচ্ছে, কেউ দেখেও দেখছেন না! মেয়েটাকে না হোক, মেয়ের জামাইটাকে তো অন্তত আসতে বলবেন? ছেলেগুলো তাঁর এত নিষ্ঠুর কী করে হয়ে গেলেন? অশিক্ষা আর অজ্ঞতার কারণে চেষ্টা করেও সন্তানদের শিক্ষিত করতে পারেননি মাজেদা, কিন্তু মানবিক শিক্ষা তো তিনি ঠিকই দিয়েছিলেন! মাঝেমধ্যে তাঁর মৃত স্বামীর ওপর জমাট অভিমান হয়...কেন তাঁকে একা ফেলে চলে গেলেন তিনি? আর কিছু দিন কী তাঁর সঙ্গে থাকতে পারতেন না? জীবদ্দশায় যাঁকে ছেড়ে একটা রাত মানুষটা কোনো দিন কাটাতে পারেননি, তাঁকে ছেড়ে কী করে চলে গেলেন? কোথায় গেল তাঁর সেই পাগলকরা প্রবল ভালোবাসা? শ্যামবর্ণের একহারা গড়নের শক্তসমর্থ ষাটোর্ধ বিধবা মাজেদা কারও ওপর নির্ভর করতে চান না। ছেলেরা বিয়ে করে যাঁর যাঁর স্ত্রীর আঁচলের তলায় গিয়ে নিজের সংসার নিয়ে ব্যস্ত। সেখান থেকে গলা বাড়িয়ে একটা উঁকি দিয়েও মাকে দেখার সময় কোথায় তাঁদের? অথচ ছেলেদের কাছ তাঁর চাওয়া শুধু ‘তাঁর পাশে এসে বসবে, মুখের দিকে চেয়ে বলবে—মা, তোমার শরীর ভালো লাগে তো? পান আছে? শেষ হওয়ার আগেই জানিয়ো কিন্তু।’ এমন সময় বড় বউয়ের ডাকে তিনি ভাবনা ছেড়ে বাস্তবে এলেন। তাঁর বাটাবাটি শেষ। সব গুছিয়ে রেখে উঠে গেলেন তিনি।

দুপুর হয়ে আসছে...মাজেদা হাতের কাজগুলো দ্রুত শেষ করে নেন। তাঁকে কেউ মূল্যায়ন না করলেও তাঁরা সব তো তাঁরই, তাই সব দিক তিনি ঠিকই খেয়াল রাখেন। এত ব্যস্ততার ভেতরেও মেয়েটার জন্য তাঁর বুক থেকে হাহাকার যায় না। নানাভাবে আকুতি–মিনতি করে ছেলেদের বোঝান- ‘ও মাসুদ শিল্পীকে আনবার পাঠা কেউকে দিয়া? একটাই বোইন, মানুষ শুনলে কী কইব? জামাল কী মনে করব? জামালকে তো একটা খবর দিবি?’

নরম মনের মাসুদ নিজের স্ত্রীর কথার বাইরে যাওয়ার সাহস রাখে না। তাই ব্যস্ততা দেখিয়ে মাকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। মাজেদা তখন মেজো ছেলের কাছে যায়—

‘মাজেদুলরে, তোরা কী তোর বোইনটারে আনবি না? একটাই বোইন, তা–ও এমুন কাম কেমনে করবি?’ মাজেদুল মিনমিন স্বরে বলে—

‘আমি কী করমু মা? বিয়া তো আর আমার মেয়ের নয়। তোমার ছাওয়াল যদি দাওয়াত না দেয়, তালি আমার কী করার আছে?’

মাজেদা নিঃশব্দে চোখ মোছে। তার ছোট ছেলেকে আর কী বলবে? তার শান্তশিষ্ট ছোট ছেলেটাকে পরিবারের বাকিরা তো মূল্যায়নই করে না। তার ছেলেরা কেউ আগে এমন ছিল না, এখনো তারা নরম মনের মানুষ। বাড়িতে বউ এসে সব কেমন পাল্টে গেল! মাজেদা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবার কাজে হাত লাগায়।

দুপুর নাগাদ রান্নাবান্নার সব আয়োজন শেষ হয়ে এলে নাতনিকে ছোট করে হলুদ মাখানোর অনুষ্ঠান শেষ করে মাজেদা নদীর দিকে ছুটলেন গোসল করতে। বাড়ির সঙ্গেই চিরযৌবনা যমুনা নদী বয়ে গেছে। নদীতেই তিনি গোসল করেন। জন্মের পর থেকে রাক্ষুসি এই নদীকে শুধু কেড়ে নিতেই দেখেছে তিনি, তারপরও কী এক বিস্ময়কর কারণে এর সঙ্গ ছাড়া যায় না! নদীর দিকে ছুটতেই তাঁর বড় ছেলের বউ নাজমা এসে বলল—
—সাবান নিয়া কই যান?
—ডুব দিয়া আসি।

নাজমা তাঁর হাত থেকে গোসলের সাবানটা কেড়ে নিয়ে মুখ ঝামটা দিয়ে বলল—‘ডুব দিবেন দেন, সাবান নিছেন ক্যান? সাবান কী আপনে কিনছেন?’ ‘আবার সাবান দিয়া ডুব দেওয়া লাগে…‘বলে গজগজ করতে করতে সাবান নিয়ে সে বাড়ির ভেতর চলে গেল!

মাজেদা কয়েক মুহূর্ত বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে রইলেন...নিজেকে এত ক্ষুদ্র মনে হলো তাঁর...তিনি সাবধানে চোখের পানি আড়াল করে নদীর দিকে চলে গেলেন। নিজেকে বোঝালেন, সাবান ছাড়া গোসল করলে কী হয়? কিছুই হয় না। আর এসব তো রোজকার ঘটনা...এত কষ্ট পেলে চলবে? আজ তাঁর নাতনির বিয়ে! আজকের দিনে তাঁর চোখের পানি ফেলা চলবে কেন? মৃদু পায়ে তিনি নদীর ঠান্ডা পানিতে নেমে চোখের পানি ঢেউয়ে ঢেউয়ে ভাসিয়ে দিলেন...এ যে তাঁর চোখের পানি নদীর পানিতে মিলেমিশে একাকার হয়ে হারিয়ে গেল, এমনি করে তাঁরও হারিয়ে যেতে ইচ্ছে হয়। পোড়া দুই চোখ সংসারের এই কদর্যতা আর কত সহ্য করবে? বুকের গভীর থেকে হৃদয় নিংড়ানো একটা দীর্ঘশ্বাস উঠে এল তাঁর...নদীর মতোই তাঁর বুকের ভেতর ছলাৎ ছলাৎ করে দুঃখগুলো অবিরাম ভেসে বেড়ায়... শীতল পানিতে ডুব দিয়ে ভাবেন— ‘এই যে বিপুল জলরাশি, সেও কেমন অক্ষম তার এই ছোট্ট বুকের আগুন নেভাতে!’

শান্তিপূর্ণভাবে বিয়ের সব আনুষ্ঠানিকতা শেষ হয়ে সন্ধ্যার পর নাতনি চলে গেল। মাজেদা চোখের পানিতে প্রাণভরে নাতনিকে দোয়া দিয়ে দিলেন। রাতে ক্লান্ত দেহে বিছানায় গিয়ে একাকী তাঁর আর ঘুম আসে না। কতশত ভাবনা এসে ঘুরঘুর করে মাথার ভেতর...নাতনির বিয়ে থেকে নিজের বিয়ের কথা মনে পড়ে গেল...তিনি ডুবে গেলেন তাঁর সোনালি অতীতে...

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

সে দেখতে বলতে গেলে কালোই, আর তাঁর স্বামীর গায়ের রং ছিল কাঁচা হলুদের মতো ফর্সা! শুধু ফর্সাই নয়, রূপবানও। এমন রূপবান একটা মানুষ কীভাবে কেমন করে যে তাঁর মতো কালো মেয়ের প্রেমে পড়ে গেল! অবশ্য তাঁর গায়ের রং কালো হলেও তিনি দেখতে ভীষণ মিষ্টি ছিলেন। পাড়া-গাঁয়ের মধ্যে প্রেমপিরিতি চলে না, আর এত ছোট বয়সে মাজেদা এসব কিছু বুঝতেনও না। তাই তাঁর স্বামী তাঁকে সরাসরি বিয়ে করে ঘরে তুলে নিলেন। তাঁর শ্বশুরের ছিল সাত ছেলে আর দুই মেয়ে। তাঁদের মধ্যে তাঁর স্বামী ছিলেন দ্বিতীয় সন্তান। ভাসুর এখনো বিয়ে করেননি, দেবরগুলোও সব ছোট ছোট। এত বড় সংসারে তিনি একমাত্র বউ, তা–ও আবার ছেলে নিজে পছন্দ করে বিয়ে করে এনেছেন! গাঁয়ের মেয়েদের তখন ১০ পেরোনোর আগেই বিয়ে হয়ে যেত। তাঁর বয়সও এমনই ছিল...পুতুল খেলার বয়সে সংসারে ঢুকে যেতে হয়েছিল। সংসারে তাঁর কতটা মূল্যায়ন হবে, সে হিসাব তাঁর ডানা মেলে উড়ে বেড়ানো জগতে এখনো অচেনা। কিন্তু তাঁর শাশুড়ি ছিলেন চমৎকার এক ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। তিনি কীভাবে কীভাবে জানি তাঁকে আগলে নিলেন। সংসারধর্ম শিখিয়ে নিতে লাগলেন। একে একে বাড়িতে বউ আসতে লাগলেন। ছেলেমেয়ে দিয়ে ঘরভর্তি হয়ে যেতে লাগল। এত বড় গেরস্ত বাড়ি... খেত ভরা ফসল, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ, বাড়ির সঙ্গে সবজির বাগান...এর সঙ্গেও আছে তাঁতের কাপড় তৈরির একটা ফ্যাক্টরি। সারাদিনে কতশত কাজ সবাইকে করতে হতো! এত বউ, এত কাজ, তারপরও সংসারে সবাই মিলেমিশে থাকতেন। তাঁর শাশুড়ি সবাইকে কীভাবে যেন জুড়ে রাখতেন। পরিবারে এত সদস্য যে একবেলার খাবার খেতে তিন বৈঠক বসতে হতো। প্রথম বৈঠকে বাড়ির সব বাচ্চাকাচ্চারা বসত, তারপর বাড়ির ছেলেরা। আর সবার খাওয়া হয়ে গেলে শাশুড়ি বাড়ির বউদের নিয়ে একসঙ্গে গোল হয়ে খেতে বসতেন। তাঁদের খাওয়ার সময় আসতে আসতে প্রতিবারই অনেক বেলা হয়ে যেত। প্রায়দিনই তাঁদের খাওয়ার সময় খাওয়ার জন্য তরকারিতে টান পড়ে যেত... শুকনা মরিচের বাটা, ভর্তা দিয়ে ভাত খেয়ে নিতে হতো। তারপরও কী শান্তি ছিল...ক্রমে শ্বশুর চলে গেলেন, শাশুড়ি চলে গেলেন... সংসারে ভাঙন লাগল! শ্বশুর–শাশুড়িকে আল্লাহ বরকতময় করেছিলেন, যা তাঁর ছেলেরা ধরে রাখতে পারলেন না! তাই শ্বশুর–শাশুড়ি চলে যেতেই সংসারের আয় উন্নতিও সব চলে যেতে লাগল। ছেলেরা সবাই যাঁর যাঁর হাঁড়ি আলাদা করে নিলেন। বড় পরিবারটা ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে গেল। তারপর চলে গেছে বহু বছর...ছেলেমেয়েরা সবাই বড় হয়ে গেছে, সবার বিয়েসাদি হয়ে নাতি–নাতনিও বড় হয়ে গেছে। এরপর বড় জা চলে গেলেন। বড় ভাসুর প্যারালাইজড হয়ে বিছানায় পড়ে একা কষ্ট করলেন প্রায় এক বছর। তাঁর ছেলে আর ছেলের বউরা তাঁকে ছুঁয়েও দেখলেন না! মেয়েরা থাকেন দূরে...বড় মেয়ের যখনই সুযোগ হয়, এসে করে দিয়ে যান, কিন্তু নিজের সংসার ফেলে যখন–তখন তিনিও তো আসতে পারেন না। ভাসুরের এমন অবস্থা মাজেদা দেখতে পারেন না কিন্তু তিনি দেবরের বউ হয়ে কতটুকুই বা করতে পারেন? তাঁর পক্ষে যতটা সম্ভব হয়, তিনি করেন। বাবার এমন দুর্ভোগ দেখে ছোট মেয়ে এসে ঢাকায় তাঁর বাড়িতে নিয়ে যান। ছোট মেয়ের জামাই পোশাক কারখানার চাকরি করেন। ছোট্ট ঘুপচি ঘরে থাকেন। তাঁর তেমন সামর্থ্য কই? অথচ আল্লাহ তাঁকে এত বড় কলিজা দিয়েছেন যে এ ছোট্ট ঘরেও শ্বশুরের থাকার ব্যবস্থা করে ফেললেন। জামাই নিজেও শ্বশুরের নষ্ট করে ফেলা কাপড় ধুয়ে দিয়েছেন অসংখ্যবার! ওই মুহূর্তে শুধু শ্বশুরের অযত্ন হবে ভেবে তিনি সন্তান নেওয়ার পরিকল্পনাও পরিত্যাগ করেন! মেয়ের জামাই এত করলেও ছেলেদের কারণে প্রায় এক বছর অবর্ণনীয় কষ্ট পেয়ে আর কষ্ট করে বড় ভাসুর দুনিয়া ছাড়লেন। এরপর মাজেদার নিজের স্বামীও চলে গেলেন দীর্ঘদিন রোগে ভুগে। মাজেদা তাঁর সামর্থ্য অনুযায়ী যতটা সম্ভব চিকিৎসা করিয়েছেন। শেষ সময়গুলোয় মাজেদার খুব কষ্ট হতো। এই মানুষ তাঁকে কী অসম্ভব ভালোবাসতেন...বিয়ের পর একটা রাত তাঁকে ছাড়া থাকেননি। মাজেদা কখনো মায়ের বাড়ি গেলে ঠিক রাতের বেলা হলেও গিয়ে হাজির হয়ে যেতেন! এত ভালোবাসা দিয়েও মানুষটার চিরকাল আক্ষেপ ছিল, তাঁকে কিছুই দিতে না পারার। তাই মৃত্যুর আগে মাজেদার জন্য তিনি কিছু টাকা রেখে যান। আর বলে যান, তিনি যেন গলায় পরার সোনার ধান-তাবিজের একটা গহনা বানিয়ে নেন। মাজেদা তার স্বামীর কথা রেখেছেন। তাঁর গলায় এখন সেই ধান-তাবিজের গহনা ঝুলে থাকে সর্বক্ষণ। এই সংসারে তাঁর মূল্য না থাকলেও তিনি মারা যাওয়ার পর তাঁর এই ধান-তাবিজ কে কে ভাগ করে নেবেন, সেই বাটোয়ারা ঠিকই চলে! মাজেদা এসব দেখে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলেন... এই ছোট্ট এক টুকরা গহনারও কত দাম, কত চাহিদা!

মাজেদার শ্বশুরবাড়ি কুলের সবচেয়ে প্রবীণ ব্যক্তি এখন তিনি। কেউ না মানলেও তিনি তো জানেন যে তিনি এখন সবার অভিভাবক। তাই সবার আপদে–বিপদে তিনি সশরীরে এগিয়ে আসেন। ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখেন। এতগুলো মানুষকে তিনি বটবৃক্ষের মতো একা ছায়া দেওয়ার চেষ্টা করেন...শুধু তাঁর মাথার ওপর কারও ছায়া নেই! তাঁর হাহাকার লাগে...কেন এ বেঁচে থাকা? কাদের জন্য বেঁচে থাকা? কোনো উত্তর খুঁজে পান না তিনি...তাঁর সার্বক্ষণিক বিশ্বস্ত সঙ্গী এখন ‘দীর্ঘশ্বাস’!

মাজেদার ছোট ছেলেটা দেখতে বাবার মতো হয়েছে। বাবার মতোই তাঁর বুকভরা ভালোবাসা। ছেলেদের মধ্যে একমাত্র তিনিই মায়ের খোঁজ রাখেন। তবু মাজেদাকে সাবধান থাকতে হয়, কখন কীভাবে ছেলের বউয়ের রোষানলে পড়ে যান? তাঁর এ এত ভালো ছেলেটা নিঃসন্তান! বিয়ের কতগুলো বছর পার হয়ে গেলেও এখনো সন্তানের মুখ দেখতে পেলেন না...অথচ ধাত্রীর কাজ করে তাঁর নিজের হাতে কত সন্তানের জন্ম হয়েছে, হচ্ছে! হাসপাতাল থেকে ট্রেনিং নিয়ে তিনি ধাত্রীর কাজ করেন। সেই সুবাদে তাঁর হাসপালের সঙ্গে ভালো সম্পর্ক আর জানাশোনা রয়েছে। ছোট ছেলের জন্য তিনি তাঁর সাধ্যমতো ডাক্তারও দেখিয়েছেন, কবিরাজি চিকিৎসা তো আছেই। কিন্তু ছেলেটার কিছুই হচ্ছে না। ছোট ছেলের প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা আর দুঃখ দুটোই কাজ করে। ছেলেটাকে যদি একটা ভালো আর বড় ডাক্তার দেখাতে পারতেন? এই হাতে যদি তাঁর ছোট ছেলেটার একটা সন্তান হওয়াতে পারতেন?

মাজেদার সারাটা রাত কাটে এসব আকাশ-পাতাল ভাবনায়। তারপর দিন শুরু করে ছেলের বউদের হিসেব করে। এ যে ছেলের বউরা এত ‘আমার আমার’ করে তাঁরা একবারও কেন ভাবে না যে এই বয়সটা তাঁদেরও একসময় আসবে? নাজমা নিজে এখন শাশুড়ি হয়েছেন অথচ পরিস্থিতিতে পড়েও কিছু উপলব্ধি করতে পারেন না। হ্যাঁ, নাজমা তাঁর পুত্রবধু দ্বারা জঘন্যভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন!

মাজেদার বড় ছেলের দুই পুত্র। দুজনেরই বিয়ে হয়েছে। নাজমা যেমন করে তাঁর শাশুড়িকে সমাদর করেন, তাঁর ছেলের বউরাও তাঁর চেয়েও বেশি সমাদর করেন তাঁকে! কোনো কথা মাটিতে পরবার আগেই তাঁদের ঝগড়া লেগে যায়, সাপেনেউলের মতো সম্পর্ক। এক দিন তো বাড়িসুদ্ধ লোকের সামনে তেড়ে এসে শাশুড়ির চুল ধরে টেনেহিঁচড়ে সে কী মারামারি! কেউ থামাতে পারেন না। মাজেদা দেখে আর ভাবে, নিয়তি কাউকে ছাড় দেয় না! এত কিছুর পরও কেউ শেখে না, শুধরে যায় না... তাঁদের ভেতর আল্লাহভীতি বলে কিছু নেই বলেই হয়ত তাঁরা শুধরে যায় না! একবারও ভাবে না মৃত্যুর পর কী জবাব দেবে সৃষ্টিকর্তাকে?

মাজেদার তিন ছেলেই ঢাকায় পোশাককারখানায় চাকরি করেন। খুব অল্প সময়ের জন্যই বাড়ি আসে তাঁরা। আর বাকি সময়টা মাজেদা একাই থাকেন। বাড়িটা তখন তাঁর কাছে মরুভূমির মতো লাগে... নিঃসঙ্গ মাজেদা তাঁর চারপাশের মানুষগুলোর মরুভূমির মতো শুষ্ক রুক্ষ হয়ে যাওয়া মনে মরু গোলাপের মতো কোমল সৌন্দর্য ধরে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যান। আলোকিত করতে চায় সবার হৃদয়...পারেন কোথায়? বুকের ওম দিয়ে যে সন্তানদের তিনি আগলে রেখেছেন আজ সেই সন্তানদের বুকে তার জন্য মরুভূমি!

এই যে সবার নিজের জন্য এত ছুটে চলা, দিন শেষে সেই তো নিজের মানুষের কাছেই উদবাস্তু আর বাতিলের মতো অর্থহীন বেঁচে থাকা! মাঝেমধ্যেই দম বন্ধ হয়ে আসে তার... তিনি সারাদিন এখানে–সেখানে ছুটে বেড়ান, কাজের বাহানায় শান্তির খোঁজে। গ্রামের প্রায় সব ডেলিভারিই তিনি করান। তাই নিজের হাতখরচ আর পরনের শাড়ির অভাব তাঁর নেই। তাঁকে লালন করতে ছেলেদের আলাদা করে ব্যয় বহন করতে হয় না অথচ তারপরও পরিবারের মধ্যে তিনি কেমন বাড়তি জিনিস! তাঁর ঘরভরা সব আছে, শুধু এতটুকু সম্মানের বড় অভাব! বয়স বাড়লেই কী মূল্য এমন হয়ে যায়? যাঁদের কারণে নিষ্ঠুরতম পৃথিবীর আলো হাওয়ায় আগলে থেকে টিকে যাওয়া শিখে যায়, তাঁদেরই কী প্রচণ্ড অনাদর, অবহেলা আর অবজ্ঞা!

মাজেদার একমাত্র মেয়ে শিল্পী নানা ধরনের জটিল রোগে আক্রান্ত। তাঁর ফুসফুস, কিডনি পুরোপুরিভাবে ড্যামেজ, জরায়ুতেও সমস্যা। চিকিৎসার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন, যার পর্যাপ্ত জোগান দেওয়া তাঁর স্বামী জামালের পক্ষে এক প্রকার অসম্ভব। তারপরও জামালের পক্ষে যতটা সম্ভব হয়েছে, তার সবটুকুই তিনি করেছেন। মাজেদার নাতনির বিয়ের পরপরই শিল্পীর শারীরিক অবস্থার ভয়ানক অবনতি ঘটতে থাকে। তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করালে মাজেদা মেয়ের সঙ্গে হাসপাতালেই থাকেন। তাঁর ফুসফুসের সার্জারি করতে হয়েছে, সেই সঙ্গে পিত্তথলিও ফেলে দিতে হয়েছে। অবস্থা খুবই খারাপ শিল্পীর। মাজেদার ঘুম নেই, খাওয়া নেই, গোসল নেই... সারাক্ষণ আল্লাহর কাছে মেয়ের সুস্থতা চেয়ে দোয়া করেন আর উদভ্রান্তের মতো ডাক্তারের পেছনে ছোটাছুটি করেন। ছেলেদের দেওয়ার সামর্থ্য নেই, তারপরও যতটুকু পেরেছে দিয়েছেন। আত্মীয়স্বজনের কাছে চাইবেন, সে সাহস মাজেদার হয় না। কে দেবেন তাঁকে এত টাকা? টাকার অভাবে শিল্পীকে হাসপাতালে বেশিদিন রাখতে পারলেন না জামাল। শিল্পীর জন্য যে ওষুধের প্রয়োজন, তার ব্যবস্থাও করতে পারে না। মাজেদা অস্থিরচিত্তে বাড়ি ফেরেন। সারাক্ষণ মেয়ের অসুস্থতা তাড়া করে তাঁকে। স্বামী মারা যাওয়ার পর সুখে–দুঃখে শিল্পীই ছিল তাঁর একমাত্র আশ্রয়স্থল। মেয়েটার কিছু হয়ে গেলে তিনি কোথায় একটু মমতার ছায়া পাবেন, আশ্রয় চাইবেন? তাঁর ওপর শিল্পীর ছোট মেয়েটা খুব বেশিই ছোট। শিল্পীর যদি কিছু হয়ে যায়, মেয়েটার কী হবে? বাকি সবাই দিন গেলে শিল্পীর শূন্যতা কাটিয়ে উঠবে, শুধু এই দুটো মানুষ হয়ে যাবে চিরকালের মতো আশ্রয়হীন! ভয়ে মাজেদা কুঁকড়ে যায়... তার এত অসহায় লাগে, যা আগে কখনো লাগেনি... তিনি মনে প্রাণে শুধু দোয়া করে যান মেয়ের জন্য।

হাসপাতাল থেকে ফেরার পর পর্যাপ্ত ওষুধ, সেবা আর পথ্য না পাওয়ায় কয়েকটা দিন যেতেই আবার অসুস্থ হয়ে পড়েন শিল্পী। অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে আবার হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার এবার বলে দেন শিল্পীর শরীরে ক্যানসার বাসা বেঁধেছে। তাকে বাঁচাবার কোনো উপায় নেই! দিশাহারা মাজেদা মেয়েকে আঁকড়ে ধরে হাসপাতালে পড়ে থাকেন। একমুহূর্তের জন্য মেয়েকে ছেড়ে থাকেন না। দুই দিন যেতেই মাঝরাতে শিল্পী ঘুম থেকে জেগে উঠে এলোমেলো কথা বলতে থাকেন। মাজেদা বুঝতে পারেন, মেয়ের হুশ নেই! তিনি মেয়েকে শান্ত করে ওয়াশরুমে যান। ফিরে এসে দেখেন শিল্পী কেমন যেন করছেন! তিনি দৌড়ে এসে মেয়েকে জাপ্টে ধরেন ‘কেমন লাগছে, কী হয়েছে’ জিজ্ঞাসা করতে থাকেন, কিন্তু শিল্পী কোনো কথা বলতে পারলেন না। মাজেদা তাঁর মুখে পানি তুলে দিলেন, তিনি দুই ঢোক পানি পান করলেন, তারপর দুইবার ‘আল্লাহ’ বলে ডেকে ওঠেন। এরপরই তিনি আস্তে করে মৃত্যুর কোলে ঢোলে পড়েন! গভীর রাতে একাকী নিজের হাতের ওপরই কলিজার টুকরা মেয়েটার মৃত্যু মাজেদার চোখে কান্নার ঢল নামিয়ে নিয়ে আসে... মুহূর্তেই রাতের সুনশান নীরবতা চুরমার করে দিয়ে ঘুমন্ত হাসপাতাল জেগে ওঠে তার কান্নার আহাজারিতে।

মাজেদার কান্না শুনে নার্স ছুটে আসেন। রোগীর মৃত্যু হয়েছে দেখে তিনি ছুটে গিয়ে আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে ফিরে আসেন কিছু কাগজপত্র হাতে নিয়ে। এসেই কান্নারত মাজেদাকে বলতে থাকেন, সেখানে সই করতে। কিসের সই জানতে চাইলে তাঁরা বলেন ‘রোগীর অবস্থা খুব খারাপ, তাঁকে এক্ষুণি নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রতে (আইসিইউ) নিতে হবে।’ মাজেদা হতবিহ্বল হয়ে যান... তিনি জানেন তাঁর মেয়ে মারা গিয়েছেন, তাঁরা কেন ওকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে নেবেন!! কিন্তু নার্স তাঁর কথা মানতে নারাজ। তাঁরা তাঁকে বোঝাতে লাগলেন, মেয়ে বেঁচে আছে। মাজেদার কাছে উত্তরটা মুহূর্তেই পরিষ্কার হয়ে গেল। তাঁরা ভাবছেন হাসপাতাল সম্পর্কে মাজেদার ধারণা নেই। যেকোনো উপায়ে ৭/৫ বুঝ দিয়ে মৃত রোগীকে নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে নিয়ে গেলেই তো মোটা অঙ্কের বিল তুলে ফেলা যাবে! অশিক্ষিত মানুষ এসব টেরই পাবেন না। কিন্তু মাজেদা তাঁদের এই বিকৃত মস্তিষ্কের খেলায় ধরা দিলেন না। তিনি তাঁদের সামনে থেকে সরে গিয়ে বাইরে এসে অপরিচিত একজনকে ডেকে বলেন, ‘আমার ফোনে জামাল, সজীব লেখা নাম্বার আছে, একটু বের করে ফোন দিয়ে দাও, আমার মেয়েটা মারা গেছে, খবর দিতে হবে।’ এদিকে বাড়ি থেকে সবাই চলে আসা পর্যন্ত মাজেদাকে হাসপাতাল থেকে বার বার ফোর্স করা হচ্ছিল স্বাক্ষর দেওয়ার জন্য, কিন্তু মাজেদা কোনোভাবেই রাজি হয়নি। তিনি এটা–সেটা বলে পালিয়ে থাকার চেষ্টা করতে লাগলেন। মেয়ে হারাবার তীব্র শোকের মুহূর্তেও তাঁকে স্থির থাকতে দিচ্ছিল না তাঁরা... লড়াই করতে হচ্ছিল অর্থলোভী মানুষ নামের কিছু রক্তপিপাসুদের সঙ্গে!

বাড়ির লোকজন এলে মাজেদা তাঁদের দ্রুত সব কিছু বলে লাশ বের করার ব্যবস্থা করতে বলেন। অতঃপর তাঁরা লাশ নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করেন। বাড়ি এসে সকাল ৮টা নাগাদ লাশ দাফন করা হয়।

শিল্পীর এমন পরিণতি সবাই দেখতেই পাচ্ছিলেন, তবু তাঁর চলে যাওয়াটা পরিবারের সবাইকে ভেঙে দিয়ে গেল। সবচেয়ে বেশি আহত হলেন মাজেদা। নিজেকে ভেঙেচুরে জমা রাখার একমাত্র আশ্রয়টা হারিয়ে তিনি নিজেকে পুরোপুরি নিঃস্ব বোধ করলেন।

এই ছোট্ট এক জীবনে মাজেদা নিজের মা-বাবা, ভাইসহ শ্বশুরবাড়ির কত প্রিয় মুখ মৃত্যুর মিছিলে শামিল হতে দেখেছেন! তবে একমাত্র মেয়েটার মৃত্যু তাঁকে সবচেয়ে বেশি কাবু করে ফেলেছেন। শোক বইবার একরত্তি ক্ষমতা তাঁর মধ্যে আর অবশিষ্ট নেই। এখন তিনি অপেক্ষা করেন—কখন তাঁর চলে যাওয়ার ডাক এসে যায়?

আকাশের দিকে নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে মাজেদা একটা প্রশ্নের উত্তরই খুঁজে যান, ‘এই পৃথিবী কেন কারও কারও বেঁচে থাকাটাকে এত অসহায় করে তোলে??’

এমন হাজারো গোলাপ আমাদের অযত্ন–অবহেলায় অভিমান লুকিয়ে রেখে ঝরে যায়! আমরা তো একটু যত্নশীল হতেই পারি?