স্থানীয়-অস্থানীয় দ্বন্দ্বেই কি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বিনোদপুর বাজারে সংঘর্ষ
আমাদের সমাজে গভীর গভীরতর অসুখ। উন্নত তথ্যপ্রযুক্তির যুগে, চাঁদে মানুষ যাওয়ার অর্ধশতক পূর্তিকালেও বাংলাদেশের বহু মানুষ যে কূপমণ্ডূকতা, কুসংস্কারের অন্ধকার, বিদ্বেষ ও বিভেদের বেড়াজাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসতে পারেনি, বিষয়টি আমাদের কষ্ট দিলেও এটি বাস্তবতা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে স্থানীয় লোকজনের সংঘর্ষের ঘটনা যেরূপ মাত্রা নিয়েছে, তা সত্যিই নিন্দনীয় ও হতাশাজনক। তুচ্ছ একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে অন্তত দুই শতাধিক শিক্ষার্থীর আহত হওয়াই প্রমাণ করে, মূল সমস্যা কত গভীরে। সংঘর্ষের পর যেসব শিক্ষার্থী হাসপাতালের বেডে কাতরাচ্ছেন, তাঁদের কারও মস্তক বিদীর্ণ, কারও চোখ আঘাতপ্রাপ্ত আর কারও মুখমণ্ডল বা সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। সংঘর্ষকালে এক দিকে পুলিশ বক্স ও শিক্ষার্থীদের মোটরসাইকেল পোড়ানো হয়েছে, অন্য দিকে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের দোকানপাট। কেন একই সঙ্গে এত মানুষ বর্বর দানবে পরিণত হলো, নিজেরাই একই সঙ্গে বিচারক ও জল্লাদ হয়ে উঠল, এই হিংস্রতার অযুতবিশ্রুত ব্যাখ্যা, পুলিশ প্রশাসনের ওপর জনতার ভরসা নেই বলেই তারা আইন নিজেদের হাতে তুলে নেয়। যদিও রাজশাহীতে এ রকম ঘটনা প্রথম নয়, তবে এটা অনায়াসে বলা যায়, ঘটনার শুরুতেই যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিক্ষার্থীদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিত এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণে সক্ষমতা দেখাত, তবে জল এতটা ঘোলা হয় না।
মূলত ঘটনাটির সূত্রপাত বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থী বগুড়া থেকে বাসে আসার সময় আসনে বসাকে কেন্দ্র করে বাসচালকের সহকারীর সঙ্গে কথা-কাটাকাটির জেরে। বাসটি বিশ্ববিদ্যালয় ফটকে পৌঁছালে আবারও বাগ্বিতণ্ডার সময় স্থানীয় এক দোকানদার জড়িত হলে সংঘাতটি স্থানীয়-অস্থানীয় রূপ নেয়। পরিবহনশ্রমিকদের নৈরাজ্যের গল্প আমরা সবাই কম-বেশি জানি। কিন্তু রাজশাহীতে স্থানীয় লোকজন কর্তৃক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যে কতটুকু নির্মমতার শিকার হন, তা হয়তো অনেকেরই অজানা। আমার শিক্ষাজীবনে অনেক স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে মিশেছি, যাঁরা ছিলেন খুবই মহৎপ্রাণ। আবার তিক্ত অভিজ্ঞতা পেয়েছি, এমন মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। শিক্ষার্থী ও স্থানীয় লোকজনের মধ্যে তিক্ততার সম্পর্কের কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যায়, এসব এলাকার বাসিন্দারা নিজেদের স্থানীয় ভাবটা বড় করে দেখেন। স্থানীয় শক্তি তাঁরা শিক্ষার্থীদের ওপর প্রয়োগ করেন। আবার বয়স্ক ব্যক্তিদের অনেকেই মনে করেন, দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা এখানে পড়তে আসার কারণে নিজেদের সন্তানসন্ততি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা ও চাকরির সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। মোট কথা, স্থানীয় লোকজনের একগুঁয়ে বিশ্বাস, উগ্র ধ্যানধারণাই এ তিক্ততার অন্যতম কারণ। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের ভেতরেও বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার দাম্ভিকতা থাকতে পারে, তবে সে সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে রাবি শিক্ষার্থীদের বিরোধ অনেক আগে থেকেই চলতে থাকলেও এবারের ঘটনা সম্ভবত গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি রক্তক্ষয়ী ও ঘৃণ্য। একটি তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র কয়েক দফায় সংঘর্ষ, দীর্ঘক্ষণ চলা সংঘাত ও বিপুলসংখ্যক আহত হওয়ার বিপরীতে তৃতীয় পক্ষের কোনো ইঙ্গিত রয়েছে কি না, এ নিয়ে জনমনে যথেষ্ট উদ্রেক রয়েছে।
এটা অনেকাংশে সুস্পষ্ট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীরা শুধু স্থানীয় গোষ্ঠী ও পুলিশের নির্মমতার শিকার হননি; বরং অপরাজনীতির শিকার হয়েছেন রাজনীতির মদদপুষ্ট বিশেষ শক্তির দ্বারা। এটা ছিল জঘন্য অপরাজনীতির খেল, যেখান তাঁদেরসহ বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, পুলিশ ও স্থানীয় লোকজনকে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে শিক্ষার্থীদের মেরে স্থানীয় লোকজনের কাছে সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জন ও ভোটব্যাংক ভারী করার উদ্দেশ্য নিয়ে। আমাদের দুর্ভাগ্য, এ দেশের রাজনীতিবিদদের মুখে মানবিকতার ফুলঝুরি থাকলেও অন্তরে নেই। রাজনীতির জঘন্য খেলায় তাঁরা ভুলে যান প্রাণের দাম। এ প্রসঙ্গে একটি গল্প মনে পড়ে গেল। গল্পটি বহু বছর আগে পড়া।
একদল দুষ্টু বালক খেলাচ্ছলে ঢিল ছুড়ছিল একটি ডোবায়। সে ডোবায় ছিল অনেক ব্যাঙ। ঢিলের আঘাতে ওদের অনেকেই মারা যাচ্ছিল। তাতে বালকেরা বেশ মজা পাচ্ছিল। অবশেষে একটি মা-ব্যাঙ মুখ ভাসিয়ে বলল, ‘ওহে বালকেরা, বন্ধ করো তোমাদের এ সর্বনাশা খেলা। তোমাদের কাছে যেটা খেলা, আমাদের জন্য সেটা মৃত্যু।’
রাজনৈতিক শক্তির অন্ধ উপাসনা বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অগ্রগতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা। শুধু স্থানীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তির কারণে প্রতিষ্ঠা লাভের ৭০ বছরেও শিক্ষার্থীদের শতভাগ আবাসন নিশ্চিত করতে পারেনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সবচেয়ে দুঃখজনক ব্যাপার হচ্ছে, শিক্ষার্থীদের জীবনের প্রতি শিক্ষকের দায়বদ্ধতার সীমা-পরিসীমা পর্যন্ত নির্ধারণ করে দেয় আমাদের দেশের রাজনৈতিক শক্তিগুলো। ফলে বহিরাগত ব্যক্তিদের দ্বারা শিক্ষার্থীদের জীবনের ওপর আঘাত এলেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিশেষ গোষ্ঠীর ইশারায় নির্বিকার ভূমিকা পালন করে। আবার বিশেষ গোষ্ঠীর ইন্ধনেই আপ্তবাক্যে শিক্ষার্থীদের মনোরঞ্জন করার চেষ্টা করে। তাই প্রশাসনকে ‘সর্প হইয়া দংশনের পর ওঝা হইয়া ঝাড়ার’ ভূমিকা না ছাড়লে এ সংকটের কোনো সমাধান হবে না, সেটা বোধ হয় নিশ্চিত করেই বলা যায়।
লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।