সময়টা ইতিহাসের বাঁক বদলের! ব্রিটিশ শাসন ভারতীয় উপমহাদেশে অস্তমিত হওয়ার পথে। মুসলমানদের মধ্যে জাতীয়তাবোধ তৈরি হচ্ছে। বাংলার সমাজে বিভেদ অস্থিরতা বাড়ছে। এমন সময়ে ১৯৩০ সালের মার্চ মাসে চলনবিলে এম এ হামিদের জন্ম। বর্তমান সময়ের নাটোর, সিরাজগঞ্জ, পাবনা জেলার কিছু অংশ নিয়ে যে বিস্তীর্ণ জলাভূমি, তাকে চলনবিল নামে ডাকা হয়ে থাকে। সেই বিশাল চলনবিলের আত্রাই নদের পারে খুবজীপুর গ্রামে তাঁর বাড়ি। সেই সময়ের প্রায় প্রতিটি গ্রামের চিত্র ছিল চারপাশে পানি আর দ্বীপের মতো বসতবাড়ি। শুষ্ক মৌসুম ছাড়া এক পাড়া থেকে অন্য পাড়ায় যেতে লাগত নৌকা। মাঝি, জেলে, কৃষক ও কৃষিজমিতে বেগার খাটা দরিদ্র শ্রমিকেরা গ্রামের জনসাধারণ। গ্রামে ছিল না কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্কুল-কলেজ, হাট-বাজার। এমনকি কোনো চলাচলের রাস্তা! এমন পরিবেশে তিনি জন্মেছিলেন আলোকবর্তিকা হয়ে।
প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম একই ধরনের জীবনযাপন করা চলনবিলের পশ্চাদপদ মানুষের ভাগ্য বদলের জন্য কাজ করতে হবে, এই প্রেরণায় স্কুল থেকেই সমাজসেবামূলক কাজ শুরু করেছিলেন এম এ হামিদ। এলাকার বিভিন্ন সমস্যা যেমন সাঁকো মেরামত, ত্রাণ বা পুনর্বাসনের আবেদন, ডাকঘর স্থাপন, এসব বিষয় নিয়ে নিয়মিত পত্রিকায় চিঠি লিখতেন। বর্ষায় বৈঠানৌকা ঠেলে, অন্য সময়ে হেঁটে গিয়ে উপজেলা সদরের ডাকঘরে সেই চিঠি পোস্ট করতেন। একজন ছাত্রের এমন নিষ্ঠা দেখে অনেক বড় কর্তা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজটি করতেন এবং তাঁর চিঠির প্রতি-উত্তর পাঠাতেন। গ্রামের মানুষদের সংগঠিত করে বড় বড় নেতার কাছে যেতেন বিভিন্ন দাবি নিয়ে, নাছোড়বান্দার মতো কাজ না হওয়া পর্যন্ত লেগে থাকতেন। মানুষের সান্নিধ্যে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত এম এ হামিদ চেষ্টা করতেন সবার মধ্যে শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের বীজ বপন করতে। ছোটদের সবার নাম জিজ্ঞেস করতেন, পড়াশোনার খবর নিতেন, ভালো ফলাফল বা স্কলারশিপের চেষ্টার জন্য উৎসাহিত করতেন। অনেকে তাঁকে পাগল ভাবতেন! কিন্তু কোনো সমালোচনা তাঁকে থামাতে পারত না। তিনি কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে হাসিমুখে অবিচল থেকেছেন তাঁর সেবামূলক কাজে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অসীম ধৈর্যের সঙ্গে গড়েছেন একের পর এক প্রতিষ্ঠান। নাটোর সদর উপজেলার নবাব সিরাজ উদ-দৌলা কলেজ, গুরুদাসপুর উপজেলার বিলচলন শহীদ শামসুজ্জোহা কলেজ, চাঁচকৈড়ে তৎকালীন সময়ের দেশের অন্যতম বৃহত্তম লাইব্রেরি ও হলরুমসহ ক্লাব ‘শিক্ষা সংঘ’। সমাজসেবায় পেয়েছিলেন ‘তমঘায়ে খেদমত’ বা টিকে উপাধি। কিন্তু ১৯৬৯-এ তাঁর রসায়নের বিভাগের অনুজ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর শামসুজ্জোহাকে হত্যার প্রতিবাদে সেই খেতাব বর্জন করেন। পাশাপাশি পাকিস্তানি সামরিক শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে গুরুদাসপুরের বিলচলন কলেজকে ‘বিলচলন শহীদ শামসুজ্জোহা কলেজ’ নামে নামকরণ করেন। নাটোরের সিংড়া, গুরুদাসপুর, বড়াইগ্রাম সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, সলঙ্গা, পাবনার চাটমোহর, ভাঙ্গুরা এসব অঞ্চলের অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, বা সম্পাদক অথবা দাতা সদস্য ছিলেন। এমনকি মওলানা ভাসানীর অনুরোধে জয়পুরহাটের পাঁচবিবিতে বন্ধ হয়ে যাওয়া মৃতপ্রায় হাজী মোহাম্মদ মহসীন কলেজের দায়িত্ব নিয়ে স্থানীয় লোকজনের কাছ থেকে মুষ্টি চাঁদা এবং জায়গিরের ব্যবস্থা করে কলেজটির পুনর্জীবন ঘটান তিনি।
এম এ হামিদ জন্মভূমি নাটরের গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজীপুর গ্রামে করেছেন স্কুল, কলেজ, মসজিদ, মাদ্রাসা, কমিউনিটি হাসপাতাল, জাদুঘর, খেলার মাঠ, হাট-বাজার, সঙ্গে পথে চলার রাস্তা। একই সঙ্গে সমগ্র চলনবিলের প্রত্যন্ত গ্রামজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছেন শিক্ষার আলো। শুধু ওই একটি মশাল চলনবিলের মানুষের কুসংস্কারের অন্ধকার দূর করে ভাগ্য ফিরিয়েছিল।
শিশুতোষ এম এ হামিদ ব্যক্তিজীবনে ছিলেন সাদামাটা, নির্লোভ, নিরহংকার। পেশাগত জীবনে রসায়নের অধ্যাপক হিসেবে কাটিয়েছেন পাবনার এডওয়ার্ড কলেজ, বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজের মতো প্রতিষ্ঠানে। বিজ্ঞানের ছাত্র হয়েও শিল্প-সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য, ধর্ম, ফোকলোর গবেষণা ও সাংস্কৃতিক কাজে ছিল তাঁর অবাধ বিচরণ। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর রচিত ও সম্পাদিত ২৫টির বেশি বই তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্যের সাক্ষ্য দেয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নশাস্ত্রে মাস্টার্স করা এম এ হামিদ সম্ভ্রান্ত পরিবারের জ্যেষ্ঠ সন্তান হয়েও জীবনভর ধবধবে সাদা পাজামা–পাঞ্জাবির সঙ্গে ফিতাবিহীন কালো রঙের জুতো পরে অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন। পরিণত বয়সে তাঁর শুভ্র দাড়ি আর হাসিমাখা মুখের এই মিশেলে তাঁকে সহস্র ভিড়ের মধ্যেও অসাধারণ করে তুলতে পারত। রাষ্ট্রীয় বড় কর্তাদের কোনো অনুষ্ঠানে যখন প্রটোকলের আনুষঙ্গিকতা থাকত, সাধারণ মানুষ তখন সেসব অনুষ্ঠানে যেতে সংকোচবোধ করতেন। কিন্তু এম এ হামিদকে দেখতে পেলে মানুষ ভরসা করত। হাসিমুখে সব শ্রেণির মানুষকে কাছে টেনে কথা বলার গুণ তাঁর প্রবলভাবে ছিল।
জীবনভর সফর করেছেন, কোনো ছুটি বাড়িতে বসে কাটাতেন না। তাঁর পকেটে সব সময় কাগজ-কলম থাকত। পথ চলায় যাঁকে পাশে পেতেন, যেচে পরিচিত হয়ে ঠিকানা নিয়ে রাখতেন, পরে তাঁকে চিঠি পাঠাতেন। প্রতি রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে চিঠি লেখা ও চিঠির উত্তর পাঠানো ছিল তাঁর অত্যাবশ্যকীয় কাজ। দাওয়াত খাওয়াতে এবং খেতে পছন্দ করতেন। একা খেতে পারতেন না, যেদিন মেহমান থাকত না, সেদিন খুব আফসোস করতেন। রাস্তা থেকে মানুষ ধরে আনতেন একসঙ্গে খাওয়ার জন্য। সব সময় মানুষের সঙ্গে চলা মানুষটি ২০০৬ সালের ২৪ আগস্ট সবাইকে ফেলে চিরবিদায় নেন। তাঁর প্রয়াণের প্রায় দুই দশক অতিবাহিত হলেও চলনবিলজুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে এম এ হামিদের পরোক্ষ উপস্থিতি। চলনবিলের প্রতিটি গ্রামে তাঁকে অন্তর থেকে ধারণ করা অসংখ্য ভক্ত অনুরাগী ও তাঁর তৈরি প্রতিষ্ঠানগুলো সাক্ষ্য দিচ্ছে কীর্তিমানের মৃত্যু নেই।
*লেখক: এস এম মহিউদ্দিন, খুবজীপুর, গুরুদাসপুর, নাটোর
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]