কোচিং–বাণিজ্য থামানো কি কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকবে

মানুষের পাঁচটি মৌলিক চাহিদার মধ্যে অন্যতম হলো শিক্ষা। শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য হলো মানুষের সুপ্ত প্রতিভাকে বিকশিত করা; কিন্তু বর্তমানে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় কোচিং-বাণিজ্য মহামারি আকার ধারণ করায় ব্যাহত হচ্ছে শিক্ষার্থীদের নিজস্ব সৃজনশীলতা। শিক্ষার্থীদের পরীক্ষায় নম্বর কম দিয়ে, মানসিক নির্যাতন করে, বিভিন্ন কলাকৌশল অবলম্বন করে এক শ্রেণির শিক্ষকেরা তাঁদের কাছে পড়তে বাধ্য করছেন। তাঁদের কাছে জিম্মি হয়ে আছেন শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা।

দিন দিন কোমলমতি শিশুদের কাছে স্কুলের মুক্ত আঙিনাকে আনন্দময় করার বদলে অপ্রয়োজনীয় করে তোলা হচ্ছে। অনেক শিশু স্কুলের পরিবর্তে প্রাইভেট শিক্ষকের বন্দী কক্ষে সেরে নিচ্ছে পড়াশোনা। অনেকেই সারা বছর স্কুলে না গিয়ে শুধু বিভিন্ন পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে মাত্র। বছরের প্রথম মাসেই শুরু হয় এসব প্রাইভেট বা কোচিং। অনেক অতি উৎসাহী অভিভাবক আবার তাঁদের সন্তানকে সকালে এক কোচিং এবং বিকেলে আরেক কোচিংয়ে পাঠান। অনেক অভিভাবক কোচিং ও প্রাইভেট—দুটিই চালিয়ে যাচ্ছেন। প্রাইভেট না পড়লে বিদ্যালয়ে গিয়েও পাচ্ছে না শিক্ষকের সুদৃষ্টি। আর বেশির ভাগ প্রাইভেট ও কোচিং সেন্টারে ক্লাস কার্যক্রম শুরু হয় দুপুরের পর অথবা সন্ধ্যায়। সারা দিন ক্লান্তির পরে কোমলমতি শিশুদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিয়ে যাওয়া হয় প্রাইভেট ও কোচিং সেন্টারে। ব্যাগভর্তি বই, খাতা ও পেনসিল নিয়ে এসব শিশু সারাক্ষণ শারীরিক ও মানসিক দুর্বলতায় ভোগে। অনেক শিক্ষার্থীই এ চাপ সহ্য করতে না পেরে আক্রান্ত হচ্ছে নানা ধরনের মানসিক সমস্যায়।

সম্প্রতি একাধিক জরিপ থেকে জানা যায়, প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক স্তরের দুই-তৃতীয়াংশের বেশি শিক্ষার্থী প্রাইভেট পড়ে, বিশেষ করে মেট্রোপলিটন, বিভাগীয় ও জেলা শহরে কোনো শিক্ষার্থী প্রাইভেট পড়ে না, তা খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন। উচ্চমাধ্যমিক স্তরেও শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট পড়ার হার বাড়ছে। এ ব্যাপারে অভিভাবকদের উদ্বেগ খুব বেশি কাজ করে। কারণ, এইচএসসিতে ভালো ফল করতে না পারলে শিক্ষার্থীরা মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো জায়গায় প্রতিযোগিতায় টিকতে পারবে না।

গত শতকের নব্বইয়ের দশকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা পর্যায়ে বিশেষ প্রয়োজনে প্রাইভেট ও কোচিং প্রচলিত হয়েছিল। সময়ের পরিবর্তনে নিম্নমাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে সৃজনশীল পদ্ধতি চালু হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রাইভেট বা কোচিংয়ের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাবে এমনটি মনে করেছিলেন শিক্ষাসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। কিন্তু ফল হয়েছে উল্টো। শিক্ষার এ বাণিজ্যিকীকরণের মাশুল গুনতে হচ্ছে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের। একটি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের তথ্য থেকে জানা যায়, কোচিংয়ের কারণে বর্তমানে শিক্ষার ব্যয়ের সিংহভাগই রাষ্ট্রের পরিবর্তে পরিবারের ওপর বর্তাচ্ছে। দেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৫৯ শতাংশ ও সরকারি সহায়তাপ্রাপ্ত (এমপিওভুক্ত) মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ব্যয়ের ৭১ শতাংশই পরিবার নির্বাহ করে। এ ব্যয়ের সিংহভাগই যায় কোচিং ও প্রাইভেটের পেছনে।

২০১২ সালের ২০ জুন কোচিং–বাণিজ্য বন্ধে নির্দেশনা জারি এবং হাইকোর্টের আদেশে ২০১৯ সালে তা গেজেট আকারে প্রকাশ করা নিশ্চয়ই সরকারের প্রশংসনীয় উদ্যোগ। এই নির্দেশনা অনুযায়ী, কোনো শিক্ষক নিজ প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীকে কোচিং করাতে পারবেন না। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানের অনুমতি নিয়ে অন্য প্রতিষ্ঠানের সর্বোচ্চ ১০ শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট পড়াতে পারবেন। এ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের প্রধানকে শিক্ষার্থীর তালিকা, রোল, নাম ও শ্রেণি উল্লেখ করে জানাতে হবে। কোনো শিক্ষক বাণিজ্যিক ভিত্তিতে গড়ে ওঠা কোচিং সেন্টারে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যুক্ত হতে পারবেন না বা নিজে কোনো কোচিং সেন্টারের মালিক হতে পারবেন না। তবে অভিভাবকদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নির্ধারিত সময়ের আগে বা পরে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করতে পারবেন। এমপিওভুক্ত কোনো শিক্ষক কোচিং–বাণিজ্যে জড়িত থাকলে তাঁর এমপিও স্থগিত, বাতিল, বেতন–ভাতা স্থগিত, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিত, বেতন একধাপ অবনমিতকরণ, সাময়িক বরখাস্ত, চূড়ান্ত বরখাস্ত ইত্যাদি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

কিন্তু মোদ্দাকথা হলো সরকারি এসব নিষেধাজ্ঞা শুধু কাগজে-কলমেই সীমাবদ্ধ; বাস্তবে নেই এর কোনো প্রয়োগ। কোচিং–বাণিজ্য বন্ধে যতই বিধিনিষেধ আরোপ করা হোক না কেন, প্রকৃতপক্ষে এই নীতিমালা অকার্যকর। এর অন্যতম কারণ তদারকির অভাব। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পড়ালেখার চাহিদা পূরণ করতে পারে এবং তাকে পরীক্ষায় ভালো ফলের জন্য প্রস্তুত করে তুলতে পারে, তাহলে সে কেন প্রাইভেট পড়ার জন্য উদ্‌গ্রীব হবে?

জ্ঞান বিতরণের কাজটি এখন বাণিজ্যের উপকরণে পরিণত হয়েছে। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকেরা কোচিং–বাণিজ্যে যুক্ত শিক্ষকদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ছেন, যা পরিবারের ওপর বাড়তি আর্থিক চাপ সৃষ্টি করছে এবং এ ব্যয় মেটাতে অভিভাবকেরা হিমশিম খাচ্ছেন। এ ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানের প্রধান, শিক্ষকসমাজ ও তদারকি দলকে সমন্বিতভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। সর্বোপরি সরকারি উদ্যোগে কোচিং–বাণিজ্য কঠোরভাবে দমন করে শিক্ষকদের মানসিকতা, দৃষ্টিভঙ্গি ও নীতিবোধের উন্নয়ন ঘটাতে না পারলে দুর্নীতির ঘূর্ণাবর্তে হারিয়ে যাবে আমাদের এ শিক্ষাব্যবস্থা।