‘প্যারেন্টস ডে’ প্রকৃত মানুষ হওয়ার চর্চা

ছবি: সংগৃহীত

কেউ বাবা-মায়ের পা ধুয়ে দিচ্ছে, কেউ টিস্যু দিয়ে মুছে দিচ্ছে পা। সন্তানেরা যত্নসহকারে বাবা-মায়ের পা স্পর্শ করে ময়লা পরিষ্কার করছে। কেউবা বাবা-মাকে চুমু খাচ্ছে, আলিঙ্গন করছে। বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের এমন মহৎ কর্ম দেখে চোখ দিয়ে ঝরছে অশ্রু অভিভাবকদের। পাশ থেকে শিক্ষার্থীদের পানিসহ টিস্যু এগিয়ে দিচ্ছেন শিক্ষকেরা। একটু দূর থেকে অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত অতিথিরা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ব্যক্তি তা দেখছেন। প্রায় তিন হাজার বাবা-মায়ের সম্মেলনে এমন আবেগঘন ও মমতাময়ী অনেক পর্ব ছিল এ অনুষ্ঠানে। গত শনিবার দিনব্যাপী প্যারেন্টস ডে উপলক্ষে এমন দৃশ্য ঘটে বেসরকারি ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে। বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্ট অব লিভিং কোর্সে আয়োজনে অনুষ্ঠিত হয় এ প্যারেন্টস ডে।

দিনব্যাপী অনুষ্ঠানে বাবা-মায়েদের প্রতিটি পর্বে ছিল স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ। কেউ গেয়েছেন গান, কেউবা নাচ বা অভিনয়, আবার ফাঁকে ফাঁকে স্মৃতিচারণা। মা-বাবা ও সন্তানেরা মিলে গলা মিলিয়েছেন অসংখ্য গানে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিরেক্টর অব স্টুডেন্ট অ্যাফেয়ার্সের পরিচালক সৈয়দ মিজানুর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে ছিল আত্মিক বন্ধনের টান।

ভোলা থেকে এসেছিলেন অভিভাবক শহিদুল ইসলাম। শারীরিকভাবে অসুস্থ তিনি। ডান পায়ে ভর দিয়ে হাঁটতে পারেন না। এক বছর আগে স্ট্রোক করেছিলেন। এতে ডান পা প্যারালাইজড হয়ে যায়। এখন আগের থেকে একটু সুস্থ। এ জন্য এই আয়োজনে এসেছিলেন তিনি। প্যারেন্টস ডেতে এসে তিনি বলেন, ‘অনুষ্ঠানে আসতে আমার অনেক কষ্ট হয়েছে। সঙ্গে আমার স্ত্রীও আছে। আর্ট অব লিভিং কোর্সের শিক্ষার্থীদের এমন মহৎ কর্ম দেখে আমি অনেকটা সুস্থ বোধ করছি এখন। সন্তানেরা এমন ভালো অনুশীলনের মধ্যে থাকলে, কোনো সন্তানকে নিয়ে মা-বাবা আর দুশ্চিন্তা করবেন না। আমি জোর দিয়ে বলতে পারি, এমন আয়োজন বা অনুশীলন করা সন্তানেরা মাদকাসক্ত হবে না। দেশের যুবসমাজ আজ মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে। তাই এমন চর্চা সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে হওয়া এখন সময়ের দাবি।’

জয়নুল আবেদীন বাবলুর মেয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং (সিএসই) বিভাগে পড়ে। তিনি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে করতে বলেন, এমন কর্মকাণ্ড নিঃসন্দেহ মানুষদের প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে তুলবে। এখন যোগ্য মানুষের অভাব নেই, তবে প্রকৃত মানুষের অভাব রয়েছে পৃথিবীতে। এ সন্তানেরা মানুষ হওয়ার চর্চার মধ্যে রয়েছে। তাঁর দাবি, ‘তবে আগামী দিন থেকে আমাদের সামনে আগে শিক্ষকদের পা ধুয়ে দেবে শিক্ষার্থীরা, এমন দৃশ্য দেখতে চাই।’

ছবি: সংগৃহীত

লালমনিরহাটে থেকে আসা আকলিমা বেগম বলেন, ‘আজ আমি খুব আনন্দিত, আমার জীবনে আর কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই। আমার সন্তান দীর্ঘদিন ধরে আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখত না। বিশ্ববিদ্যালয়ের এ অনুষ্ঠানে আসার পর আমার সন্তান আমাকে জড়িয়ে ধরে শপথ নিয়েছে, বাবা-মাকে আর কোনো দিন কষ্ট দেবে না। এর চেয়ে বড় আনন্দ আর কী হতে পারে! আমি পৃথিবীর প্রত্যেক মানুষকে বলব, দেখো এখনকার প্রজন্ম নাকি বাবা-মাকে সম্মান করে না। দেখো যাও তোমরা, আমাদের সন্তানেরা শুধু সম্মানই করে না! পা ধুয়ে দেয়, দায়িত্ব নেয়। এ অনুষ্ঠান তার জীবন্ত উদাহরণ।’
প্যারেন্টস ডেতে আসা প্রত্যেক অভিভাবক একটাই কথা বলেছেন যে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এমন শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা উচিত। শিক্ষিত হওয়ার আগে মানুষ হওয়া জরুরি সবার। ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্ট অব লিভিং ডিসিপ্লিন এমন শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, ‘আমি অভিভূত। সন্তানেরা বাবা-মায়ের পা ধুয়ে দিচ্ছে, এমন দৃশ্য এখন সচরাচর চোখে পড়ে না। এখনকার প্রজন্ম স্মার্ট ফোন নিয়ে ব্যস্ত থাকে বলে অভিযোগ আছে। তবে বাবা-মাকে সম্মান করা সন্তানও হারিয়ে যায়নি, এ অনুষ্ঠান দেখে তা বোঝা যাচ্ছে।’ দেশের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন চর্চা থাকা উচিত বলে তিনি মনে করেন।

ডিআইইউর চেয়ারম্যান মো. সবুর খান বলেন, ‘ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নিজ সংস্কৃতির ওপর ভর করে আগামী দিনের বিশ্বকে নেতৃত্ব দেবে, এমন পরিকল্পনা নিয়ে এখন কাজ করছি আমরা। এ জন্য সততার পাশাপাশি বিনয় ও দক্ষ মানুষ হওয়া দরকার আমাদের’, বলে অনুষ্ঠান শেষ করেন তিনি।
লেখক: বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্ট অব লিভিং কোর্সের শিক্ষক।