১২ দিনে দেখা বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি, দুর্যোগেও জীবনের হাতছানি-৩
১০.
যা–ই হোক, এ সময় মেজ মামা ফোন দিলেন। মামা গতকাল আসার শুরুর আগ থেকেই কিছুক্ষণ পরপর খোঁজ নিচ্ছেন। মেজ মামা আমার খুব পছন্দের মানুষ। ইনফ্যানিট্যারি রেজিমেন্টের সাবেক সেনা অফিসার, তবে খুব হাস্যোজ্জ্বল আমুদে স্বভাবের। কর্মসূত্রে বাংলাদেশর আনাচকানাচে তাঁর নখদর্পণে। আর আমরা যা করছি, তা–ও ভালোই বোঝেন। তা আজকের আপডেট আর পরবর্তী পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত বললাম মামাকে। সব শুনে কিছু বিষয়ে সতর্ক করলেন, তার সঙ্গে বেশ কয়েকটা ব্যাপারে দিকনির্দেশনাও দিলেন। কথাগুলো টুকে রাখলাম মাথায়।
আনুমানিক রাত ৯টা! চেয়ারম্যান ঘাটে পৌঁছালাম। আমার জানামতে, নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলার ভেতর পড়ে এ এলাকা। ছোটখাটো একটা নৌবন্দর বলা যায় আরকি। মূলত মাছ ধরার ট্রলার এসে ভেড়ে এখানে। দিনের বেলা দু–একটা যাত্রীবাহী লঞ্চ ও আশা যাওয়া করে এই বন্দর থেকে।
গতকালকে পানি খাওয়ার পর একজনের জন্য মন থেকে দোয়া করেছিলাম! তাঁর দোষ কতটুকু, জানি না, তবে এই মুহূর্তে আরেকজনকে মন থেকে গালি দিতে ইচ্ছা করছে! রাগে–দুঃখে হতাশায় ভূমিকম্পের মতো শরীর কাপছে আর মাথায় প্রকম্পিত হচ্ছে, হারামজাদা! হারামজাদা! হারামজাদা!
এসে পৌঁছানোর কিছুটা আগ থেকেই অনুভব করছিলাম—বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বেশি। সাগরের কাছাকাছি এমনটাই স্বাভাবিক। ঘাটে এসে পৌঁছানো পর, সিএনজিচালিত অটোরিকশা থেকে নেমে আকাশের দিকে মুখ তুলে একটা বুক ভরা নিশ্বাস নিলাম। ঠান্ডা-সতেজ নিশ্বাস। অনুভব করলাম, গুঁড়ি গুঁড়ি পানির ফোটা আমার মুখে এসে পড়ছে। ইলশে গুঁড়ি বৃষ্টি শুরুর আগ দিয়ে যেমনটা হয় আরকি।
চায়ের দোকানে, নৌঘাটের মাঝিদের কাছ থেকে যা শুনলাম, তাতে মুখ শুকিয়ে গেল সবার। স্পিডবোট যা ছিল সব নিয়ে গেছে ফেনিতে, দেওয়ার মতো বোট ঘাটে অন্তত নেই কোনো। আছে অবশ্য সাগরে মাছ ধরার বড় নৌকা। তবে এ দিয়ে কাজ হবে না আমাদের। এগুলোর ড্রাফট বেশি, পানিতে ভাসার জন্য গভীরতা প্রয়োজন। প্লাবিত এলাকার কিছু কিছু জায়গায় পানির গভীরতা অল্প থাকে, ওখানে আটকে যাবে।
বুঝতে পারছি না, কী করা উচিত এখন! দোকানে বসে চা খাচ্ছি, এমন সময় আরেকটা উদ্ধারকারী দলের সঙ্গে দেখা হলো। এখান থেকে সর্বশেষ স্পিডবোটটা ওরাই নিয়ে যাচ্ছে। নোয়াখালীর স্থানীয় ওরা! সব শুনে বলল, আমরা চাইলে ওদের সঙ্গেও কাজ করতে পানি। পাঁচ-সাতজনের ছোট টিম ওদের, তাই ওরা যখন কাজ করবে না, তখন আমরা ওদের নৌকা নিয়ে বেরোতে পারব। কাল সকালে আকিবের পরিবারকে উদ্ধারেও সহযোগিতা করতে চাইল ওরা।
প্রাপ্তি আপাতত এতটুকুই। এদিকে রাত গভীর হচ্ছে। তাই ওদের সঙ্গেই ফেনির উদ্দেশে আমরা রওনা দিলাম। পিকআপ ট্রাকে মাঝারি সাইজের স্পিডবোট তোলা হলে, ওর ওপের বসলাম আমরা ৮-১০ জন। ট্রাকের ওপর বোট, বোটের ওপর আমরা, ইন্টারেস্টিং ব্যাপার।
পুনরায় সেই অন্ধকার রাস্তা দিয়ে যখন ফিরছিলাম, অন্ধকার আকাশের দিকে তাকিয়ে, ভাবছিলাম এই যাত্রাপথের শেষ কোথায়? এই আপ্রতাশিত সব একেকটা ঘটনা শেষ বলে আদৌ কি কিছু আছে! নাকি অনিশ্চিত যাত্রা শেষ হয়ে যাক, তাই আমি চাই না। রোমাঞ্চএর নেশা বড় ভয়ংকর!
আবদুল্লার হটাৎ মনে পড়ল—ওর যেন কোনো পরিচিত ব্যক্তি আছে ভোলাতে। মাছের ব্যাবসা করে, তার নিজস্ব স্পিড বোটও আছে। আমাকে কথাটা বলতেই, আমি ফোন দিতে বললাম।
ফোন দিল সঙ্গে সঙ্গে আর কেল্লা ফতে! অবশেষে পাওয়া গেছে সেই সোনার হরিণ। তা–ও অপেক্ষাকৃত কম খরচে। দৈনিক ভাড়া ৫ হাজার টাকা, সঙ্গে ডিজেলের খরচ আমাদের! আমরা যে বোটের ওপর বসা, ওটাও এই সাইজেরই! অথচ এটার ভাড়া দৈনিক ১০ হাজার। কাল ভোরে চেয়ারম্যান ঘাটে এসেই ভিড়বে!
আহ্লাদে আটখানা অবস্থা হলো আমাদের। আকিবও খুশি। ভোরের আলো ফুটতেই ওর বাড়িতে ১ম অপারেশনটা করব আমরা।
ততক্ষণে অবশ্য অনেক দূর এসে পড়েছি। ফেরত যাওয়ার মতো যানবাহন এত রাতে পাওয়াও মুশকিল। তাই, আপাতত আমরা বেসক্যাম্পেই যাচ্ছি। কয়েক ঘণ্টা বিশ্রাম নিয়ে ভোর হওয়ার আগেই রওনা দেব আবার।
এদিকে শরীর খুব ক্লান্ত হলেও মনের ভেতর অনুভব করলাম আংশিক প্রশান্তি। মনে হচ্ছে বুকের ওপর থেকে একটা পাথর হলেও সরে গেছে। অবশ্য আকিব আর ওর বাবার বুকের কোনো পাথরই পরিবারকে পাওয়া আগপর্যন্ত সরবে না। ওর চেহারা দেখলে তা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, সেটাই স্বাভাবিক!
আমার নার্ভাস সিস্টেম বোধ হয় এবার কিছুটা শান্ত হলো! ঝিমুনির ভাব আর প্রচণ্ড ক্লান্তি অনুভব করছি সারা শরীরে! তাই, বোটের ওপরেই এক কোণে গুটিসুটি মেরে শুয়ে পড়লাম আমি। পিচ পথের ওপর ট্রাকের চাকার ঘর্ষণ আর ইঞ্জিনের যান্ত্রিক শব্দে ঘুম নেমে এলো দুই চোখে।
কিছু সময় পর, আধো-ঘুম অবস্থাতেই শুনতে পেলাম মেঘ ডাকার গুড়গুড় আওয়াজ। দূর থেকে ভেসে আসছে কানে। কয়েক মিনিট এভাবেই গেল, সঙ্গে টিপটিপ বৃষ্টি! সারাদিনে এমনা বেশ কয়েকবার হয়ছে অবশ্য, তবে ঝুমবৃষ্টি দেখিনি। তবে এবার মেঘবৃষ্টি আর আমাদের সম্পর্ক বদলে গেল খুব কম সময়ে। কিছু প্রেমিকা থাকে না, যারা খুব রেগে গেলেও প্রথমে স্পষ্ট করে কিছু বলে না। মাঝেমধ্যে মেঘের মতো গুড়গুড় করে শুধু, রেগে আছে এটা বোঝায় শুধু! এরপর বিকেল–সন্ধ্যা অথবা দিনের যেকোনো সময় তার সব রাগ বৃষ্টির মতো ঝরে পড়ে! তেমনভাবেই আকাশে জমানো মেঘ, সে রাতে বৃষ্টি হয়ে ঝরে পরতে শুরু করল আমাদের ওপরে। মস্তিষ্কের ভেতর একটা কবিতার খণ্ডাংশ বিড় বিড় করছে কেউ—
‘মেঘের মতো দুঃখগুলো একটু একটু জমে
জমতে জমতে ঘনমেঘ, বৃষ্টি হয়ে ঝরে
কোন মেঘটা কোন আকাশের,
কোন হাওড়ের
কোন পাহাড়ের
কোন বনেতে জন্ম নিয়ে জমেছে ম্যালা,
দুখ সাগরে পাল তুলিয়া ভাসিল ভ্যাল্যা’
উঠে বসলাম। হেডলাইটের আলোয় আশপাশে যা দেখছি, সবই ঝাপসা। প্রচণ্ড বৃষ্টির ভেতর যেমনটা দেখতে লাগে।
সামনে দেখলাম আমাদের মতোই আরও কয়েকজন ট্রাকের পেছনে রাখা নৌকায় বসে ভিজছে। দুটো ট্রাকই তখন ধীরগতিতে চলছে। কোথাও এমন দুর্যোগ হলে তার ক্ষতি নিসন্দেহে ব্যাপক। তবে কিছু উপকারও আছে। বহু মানুষ নিজেকে নতুন করে মানুষ হিসেবে প্রমাণ করার সুযোগ পায়।
প্রায় আধঘণ্টা পর বৃষ্টি থামল, রাগ ঝারার পর প্রেমিকারা যেভাবে প্রশমিত হয় আরকি! তবে বৃষ্টির সঙ্গে ধুয়ে গেল আমার শরীরের সব ক্লান্তি। ঘুম আর এল না। মণিপাল পৌঁছানোর আগপর্যন্ত জেগেই থাকলাম। এদিকে ভেজা কাপড় শুকিয়ে গেছে আমার শরীরেই।
রাত আনুমানিক ১২টা। মহিপাল মোড়ে প্রধান সড়কের সঙ্গেই একটা নির্মাণাধীন ভবন আর তৈয়বিয়া মাদ্রাসার পুরাটা নিয়ে আমাদের মিরপুর রেসকিউ টিমের ক্যাম্প বসানো হয়েছে। ক্যাম্পে রাজভাই, শাওন ভাইসহ আরও অনেকের সঙ্গে দেখা হলে আপডেট জানালাম। এদিকে ক্লান্তিতে শরীরের হাড়গোড় খুলে আসছে আমাদের। আবার ক্যাম্পে জায়গার সংকট! তাই, ক্যাম্পেরই একজন ভলেন্টিয়ার আমাদের মূল ক্যাম থেকে পাচ মিনিটের দূরত্বে চৌধুরীবাড়ি মসজিদে নিয়ে গেল। ওখানেও থাকার ব্যবস্থা আছে।
৮-৯ ঘণ্টা মরার মতো ঘুমিয়ে পরদিন বেলা ১১টা নাগাদ উঠলাম। মসজিদের একতলায় একেবারে পেছনের দিকে, অর্থাৎ গেট দিয়ে ঢুকলেই প্রথমে যে উঠান পরে, সেখানেই আমি আবদুল্লাহ আর আকিব গতকাল রাতে ঘুমিয়েছিলাম। এই মসজিন আর মসজিদসংলগ্ন আরেকটি ভবনে কয়েক শ মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে এলাকাবাসী। সঙ্গে তিনবেলা খাবারও দিচ্ছে। তবে আমরা যে সময় উঠেছি, ততক্ষণে সকালের খাওয়ার পর্ব শেষ! গতকাল রাতে অবশ্য আমাদের ক্যাম্প থেকে তিন প্যাকেট খাবার দিয়েছিল—খিচুড়ি জাতীয় কিছু একটা, তবে তাড়াহুড়ায় কোনো রকমে রান্না। চাল ছিল আধা সেদ্ধ, লবণ–মসলা কিছু নেই! তাই একটুখানি মুখে দিয়ে আর খেতে পারিনি আমরা। তবে এখন ক্ষুধায় পেট মোচড় দিচ্ছে। যা–ই হোক, আবদুল্লাহকে লক্ষ্য করলাম, আমার পাশেই বসে নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শূন্যে।
হটাৎ মনে পড়ল আজ সকালের পরিকল্পনার কথা!
‘হায়! হায়! আমাদের না ভোরে নৌকা আনতে যাওয়ার কথা। ইশ! এতক্ষণে ঘুম ভাঙল আমার! ওরা কি তাহলে স্পিডবোটটা নিয়ে এসেছে অলরেডি! নাকি আলেয়ার আলোর মতো, কোনোভাবে এবারও হাতছাড়া!’- ভাবনাগুলো ঘুরপার খাচ্ছিল মাথার ভেতর! এ ব্যাপারে আবদুল্লাহকে প্রশ্ন করলে উত্তরে যা বলল, এতে আমার দ্বিতীয় সন্দেহই সত্যি হলো।
নৌকার মালিক নাকি আবদুল্লাহকে ভোরে ফোন করেছিল! ও নাকি ফোন ধরে নাই! অ্যাডভান্স কোনো পেমেন্টও দেওয়া হয় নাই! তাই বোট আরেক টিমের কাছে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। আমাকে ফোন চেক করে দেখাল আবদুল্লাহ, কল টল কিছুই আসেনি। যদিও এদিকে নেটওয়ার্কের অবস্থা খারাপ। প্রায়ই কল ঢোকে না! তবু মনে হল আমাদের সঙ্গে একপ্রকার প্রতারণাই হয়েছে। হতে পারে অন্য কেউ বেশি টাকায় অফার করেছে।
গতকালকে পানি খাওয়ার পর একজনের জন্য মন থেকে দোয়া করেছিলাম! তার দোষ কতটুকু জানি না, তবে এই মুহূর্তে আরেকজনকে মন থেকে গালি দিতে ইচ্ছা করছে! রাগে–দুঃখে হতাশায় ভূমিকম্পের মতো আমার শরীর কাপছে আর বারে বরে মস্তিষ্কের ভেতর প্রকম্পিত হচ্ছে: হারামজাদা! হারামজাদা! হারামজাদা!
এ সময় ইচ্ছে করছিল- বাংলা সিনেমা স্টাইলে চিৎকার করে বুক চাপড়ে বলি—‘স্পিডবোট দিবি কিনা বল’। এ মুহূর্তে এর বাইরে কিছু আর মাথায় আসছে না, আমার তবে যেহেতু মসজিদের ভেতর ছিলাম, তাই বহু কষ্টে নিজেকে সংযত করলাম, তবে যা হচ্ছে, তা সিনেমার চেয়ে কম কিছু নয়। কিছুক্ষণ পর, প্রচণ্ড ক্ষোভ কিছুটা প্রশমিত হলে, ক্ষুদাবোধ আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। চলবে...