টালমাটাল শিক্ষাব্যবস্থা, বন্ধুর পথে বাঁকা মেরুদণ্ড নিয়ে এগোব কী করে
বাঙালির কথায় কথায় হাইকোর্ট দেখানোর স্বভাব। তাই সংবিধান দিয়েই শুরু করছি।
বাংলাদেশের সংবিধানের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, রাষ্ট্রীয় নীতির আলোকে গণমুখী, সর্বজনীন, অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
এক
কিন্তু চোখ কপালে তোলার মতো তথ্য হলো—আইনের দ্বারা শিক্ষা কতদূর পর্যন্ত বাধ্যতামূলক হবে, সেই প্রশ্নে বহু বছর ধরে অস্বচ্ছতা ও সিদ্ধান্তহীনতা চলছে। বর্তমানে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক শিক্ষা বলবৎ আছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো, অষ্টম শ্রেণি পেরিয়ে একজন শিক্ষার্থী কতটা প্রস্তুত দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিক হিসেবে? সোজা উত্তর, নড়বড়ে পাঠ্যবই, মুখস্থনির্ভর পরীক্ষা আর ক্লাসরুমের একমুখী লেকচারে দাঁড়িয়ে সে একদমই প্রস্তুত নয়।
এমনিতেই শিক্ষকেরা পাঠ দিচ্ছেন, শিক্ষার্থীরা শুনছে, মুখস্থ করছে আর পরীক্ষায় লিখে দিচ্ছে। কোনো বিশ্লেষণ নেই, যুক্তির চর্চা নেই, আর নেই বাস্তব জ্ঞান অর্জনের সুযোগ। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই বদলাচ্ছে শিক্ষানীতির গতি-প্রকৃতি। মাঝেমধ্যে নতুন নতুন কারিকুলাম চালু করে এক্সপেরিমেন্ট চলছে শিক্ষার্থীদের ওপর। সম্প্রতি আলোচনা উঠেছে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত বাধ্যতামূলক শিক্ষা করার। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, এ পরিকল্পনাও কি আগের মতোই সময়ক্ষেপণমূলক ও দুর্বল বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনা? আসলে এখানে কোনো দীর্ঘমেয়াদি দূরদর্শী পরিকল্পনা নেই বলেই হরদম আমরা ‘শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড’ বলে বুলি আওড়ালেও বাস্তবে তার মেরুদণ্ড বাঁকা।
১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে আমাদের উচ্চশিক্ষার সূচনা। পরে রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগরসহ অর্ধশতাধিক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। সংখ্যায় বৃদ্ধি ঘটলেও মানের দিক দিয়ে আমরা নিম্নগামী। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক নিয়োগে দলীয়করণ, তোষামোদ আর গোষ্ঠীগত রাজনীতি এখন স্বাভাবিক চর্চা। শিক্ষক রাজনীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে শিক্ষকের গবেষণা, পাঠদানের দায়বদ্ধতা নয়, রাজনৈতিক আনুগত্যই হয়ে উঠেছে পদোন্নতির মাপকাঠি।
দুই
স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত সাতটি শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছে। প্রথমটি ছিল ১৯৭২ সালের কুদরাত-এ-খুদা কমিশন, যেটি ১৯৭৪ সালে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেটিই ছিল সবচেয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক ও সময়োপযোগী শিক্ষাকাঠামোর প্রস্তাবক। কিন্তু বাস্তবায়ন? প্রায় কিছুই হয়নি। এর পরবর্তী কমিশনগুলোর সুপারিশ বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, বাস্তবায়িত সুপারিশগুলোর প্রভাব বিশ্লেষণ করে কোনো প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়নি। অর্থাৎ পরিকল্পনা হয়েছে, কিন্তু তার প্রয়োগে রাষ্ট্র ব্যর্থ।
শুধু প্রাথমিক বা মাধ্যমিক নয়, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও চিত্র একই রকম হতাশাজনক। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে আমাদের উচ্চশিক্ষার সূচনা হয়। পরবর্তী সময়ে গড়ে ওঠে রাজশাহী, চট্টগ্রাম, জাহাঙ্গীরনগরসহ অর্ধশতাধিক সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। সংখ্যায় বৃদ্ধি ঘটলেও মানের দিক দিয়ে আমরা নিম্নগামী। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় শিক্ষক নিয়োগে দলীয়করণ, তোষামোদ আর গোষ্ঠীগত রাজনীতি এখন স্বাভাবিক চর্চা। শিক্ষক রাজনীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে শিক্ষকের গবেষণা, পাঠদানের দায়বদ্ধতা নয়, রাজনৈতিক আনুগত্যই হয়ে উঠেছে পদোন্নতির মাপকাঠি।
এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শিক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দের সংকট। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ হয়েছে মোট বাজেটের মাত্র ১ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ইউনেসকো প্রস্তাবিত ন্যূনতম ৪ থেকে ৬ শতাংশ বাজেটের ধারেকাছেও আমরা নেই। ফলে অবকাঠামোগত দুর্বলতা, শিক্ষকসংকট, গবেষণা অনুদানহীনতা ইত্যাদি সমস্যা থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মুক্ত হতে পারছে না।
তিন
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
২০২৪ সালের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান শুরু হয়েছিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই—সরকারি চাকরিতে বৈষম্যমূলক কোটা সংস্কারের দাবিতে। ধীরে ধীরে সেই আন্দোলন রূপ নেয় স্বৈরাচারবিরোধী গণ–আন্দোলনে। অবশেষে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হলো একটি অন্তর্বর্তী সরকার, যে সরকার সংস্কারমূলক কর্মসূচির আওতায় ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো, শিক্ষা নিয়ে কোনো কমিশন গঠিত হয়নি! অথচ এই ছাত্ররাই তো আন্দোলনের মূল চালিকা শক্তি ছিল, যাদের মৌলিক সমস্যার কেন্দ্রে ছিল শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা।
এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন ওঠে, শিক্ষা নিয়ে রাষ্ট্র কি আদৌ সিরিয়াস? যেখানে রাস্তায় জনতা আন্দোলন করে সরকার বদলায়, সেখানে শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারের প্রশ্নে বুদ্ধিজীবীরা সেমিনার–সিম্পোজিয়ামে বক্তৃতা দিয়েই দায়িত্ব শেষ করেন। রাজনীতিবিদেরা থাকেন যথারীতি নিশ্চুপ।
*লেখক: গিয়াস উদ্দিন: শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়