শিশিরের প্রণয় ও শীতের টেকনাফ

একটু একটু করে নেমে আসা শীতের এ সন্ধ্যায় লেদার শরণার্থী আশ্রয়শিবির থেকে টেকনাফ শহরের দিকে ফিরতি যাত্রা করছে শিশির। শরণার্থী আশ্রয়শিবির থেকে লেদা বাজারে এসে সে মাহিন্দ্রা অটো নামক কানের পর্দাফাটা আওয়াজের এক অদ্ভুত যাত্রীবাহী যানবাহনে উঠল। মাহিন্দ্রার চালক আরও কজন যাত্রী তার গাড়িতে নিল। গাড়িটি পূর্ণ হওয়ার অপেক্ষায় গাড়ির ইঞ্জিন চালু করে রেখেছে। শিশিরও অপেক্ষায় আছে কবে গাড়িটি যাত্রা শুরু করবে।

প্রায় ২০ মিনিট পর গাড়িটি লেদা বাজার থেকে টেকনাফ শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করল। শিশির প্রতিদিন কাজের শেষে যখন টেকনাফ শহরে ফিরে যায়, তখন তার এই সময়টা খুবই ভালো লাগে। শিশির আজ বসেছে গাড়িটির সামনের সিটে, চালকের পাশে।

নিত্যদিনের মতো লেদা থেকে টেকনাফ শহরে ফিরতে মহাসড়কটির দুপাশের মনোমুগ্ধকর দৃশ্যগুলো শিশিরের খুবই ভালো লাগে। সারা দিনের কাজের চাপ আর মনেই থাকে না।

লেদা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গেটের সামনে একজন যাত্রীর ডাকে গাড়িটি একটু পর থামল। যাত্রীটিকে নামিয়ে গাড়িটি আবার যাত্রা শুরু করল।

যেতে যেতে নয়াপাড়া শরণার্থী আশ্রয়শিবির ও জাদিমুড়া বাজার পার করে মহাসড়কের পশ্চিম পার্শ্বে টেকনাফ গেম রিজার্ভের মোচনী বনবিটের দমদমিয়ায় টেকনাফ নেচার পার্কের মূল ফটকটি দেখে শিশিরের অনেক স্মৃতি মনে পড়ল। কারণ, কিছুদিন আগেই শুক্রবারে শিশির তার এক রুমমেটকে নিয়ে জীববৈচিত্র্যের সৌন্দর্যময় এই পার্কটি ঘুরে এসেছিল। কিন্তু এই পার্কটি এখন আর আগের মতো নেই, কালের বিবর্তনে সংস্কারের অভাবে দর্শনার্থী কমে গেছে।

একটু পর দ্রুতগতিতে গাড়িটি চলার কারণে সম্বিত ফিরে পেয়ে শিশির নিজেকে দেখল পেল, সে এখন দমদমিয়াস্থ সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ভ্রমণের জাহাজ ঘাটে। এ সন্ধ্যায় থেকে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ভ্রমণ শেষে জাহাজ থেকে নেমে মহাসড়কে এসে শতশত পর্যটক বাড়িতে ফেরার জন্য চট্টগ্রাম-ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করতে যাওয়া বাসগুলোতে আরোহণ করছে।

গতবছর শীতের ঠিক এই সময়ে শিশির তার অফিসের সহকর্মীদের সঙ্গে সাপ্তাহিক বন্ধের দিনে জাহাজে করে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ঘুরে এল। জাহাজে করে নাফ নদ থেকে বঙ্গোপসাগরে সেন্ট মার্টিন দ্বীপে যাওয়ার সময় সে একপাশে টেকনাফ শহর ও সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর দ্বীপের জেটিঘাটসহ গ্রামীণ সব দৃশ্য দেখতে পেল, অন্যদিকে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারের পাহাড় ও অন্যান্য দৃশ্য দেখতে পেল। সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পাশে গড়ে ওঠা ছোট্ট ছেঁড়া দ্বীপেও তারা গিয়েছিল কাঠের নৌকায় করে। ছেঁড়া দ্বীপে শিশির সবার সঙ্গে ডাবের মিষ্টি পানিও পান করেছিল। সবাই মিলে ছবিটবি তুলল। সেন্ট মার্টিন দ্বীপ ভ্রমণকালে শিশিরের সব চাইতে ভালো লেগেছিল যখন সে এক সিনিয়র সহকর্মীর সহযোগিতায় লঞ্চের তৃতীয়তলার ডেকে অনুমতি নিয়ে ক্যাপ্টেনের রুমে প্রবেশ করার পর কীভাবে সাগরে এত বড় জাহাজ চালানো হয়, তা সচক্ষে দেখতে পারল।

দমদমিয়া জাহাজঘাটের যানজট শেষে গাড়িটি পৌঁছল টেকনাফ স্থলবন্দর ও কোস্ট গার্ড বাহিনীর সিজিসি স্টেশন এলাকায়। বন্দর এলাকা শেষে যখন গাড়িটি নাফ নদ ও পাহাড়ের মাঝখানের জায়গা পৌরসভা গেট নামক উঁচু স্থানে (উঠনি) উঠল, তখন বরাবরের মতো শিশির পশ্চিম পাশের বনের সুউচ্চ নেটং পাহাড় এবং পূর্ব পাশে নাফ নদের জলে রাতের পূর্ণিমার আলোর কিরণ দেখতে পেল। রাতের তারা-নক্ষত্রগুলো নাফ নদের জলে জোনাকির মতো আলো দিচ্ছে, আর চাঁদ-তারার আলোতে নাফ নদের নীল রংয়ের জলকে আরও অসাধারণ মনে হয় শিশিরের। রাত বাড়ার সঙ্গে শীতের হিম প্রবাহও বেড়ে যাচ্ছে, তাই শিশির শেষ পর্যন্ত ব্যাগ থেকে জ্যাকেটটি বের করে গায়ে পরে নিল।

গাড়িটি চলতে চলতে টেকনাফ বাস টার্মিনাল পার হয়ে ঝর্ণা চত্বরে গিয়ে থামল। শিশিরের বাসা টেকনাফ শহরের কেকে পাড়ার এক ব্যক্তির বিল্ডিংয়ের দ্বিতীয়তলার একটি ফ্ল্যাটে। শিশির ও আরও কয়েকজন চাকরিজীবী মিলে এই ফ্ল্যাটে দীর্ঘদিন ধরে থাকে।

শিশিরের জন্ম ও বেড়ে ওঠা কিশোরগঞ্জ জেলায়। শৈশব থেকেই চরাঞ্চলে তাদের নিম্ন আয়ের পরিবারের নৈমিত্তিক দুঃখ-কষ্টকে লালন করে পড়াশোনা করে শিশির। কোনোরকম স্নাতক পর্যায় পর্যন্ত পড়াশোনা করে সে গত দুই বছর টেকনাফের শরণার্থী আশ্রয়শিবিরে চাকরি করছে।

রাতের খাবার শেষে শিশির যখন তার স্মার্টফোনটির ইন্টারনেট সংযোগ চালু করল, তখনই দেখতে পেল বীথি তার খবরাখবর জানতে চেয়ে অনেকগুলো খুদে বার্তা পাঠিয়েছে। বীথিকে সে অনেক ভালোবাসে। স্বপ্ন দেখে বীথিকে নিয়ে একদিন সুখের ঘর বাঁধার। বীথি সবেমাত্র একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হলো। শিশির যখন নিয়মিত এলাকায় থাকত, তখন থেকেই বীথিরও শিশিরকে ভালো লেগে যায়। তাই বীথি শিশিরের ভালবাসাকে হৃদয়ে গহীনে ধারণ করে নেয়। সেই থেকেই বীথি নিয়মিত শিশিরের খবরাখবর নেয়, তার মনের সব কথা শিশিরকে জানায়। অপেক্ষা করে শিশির কখন ছুটিতে বাড়িতে বেড়াতে আসে, তাকে দেখতে আসবে।

এদিকে শিশির স্বপ্ন দেখে, এই রকম কোনো এক শীতের সময়ে বিয়ের পর সে বীথিকে নাফ নদ ও পাহাড়ের মাঝখানের টেকনাফের পৌরসভা গেট (উঠনি), টেকনাফ নেচার পার্ক, সেন্টমার্টিন দ্বীপ, বাহারছড়ার বাঘ ঘোনা ঝর্ণা, মেরিন ড্রাইভের জিরো পয়েন্টের সাবরাং ট্যুরিজম পার্ক, সি বিচ, শাহপরীর দ্বীপের জেটিঘাট ও মনোরম রেস্টুরেন্ট সাউদার্ন পয়েন্ট ইত্যাদি সব জায়গায় বেড়াতে নিয়ে যাবে।

রাত তখন ১১টা, মুঠোফোনে বীথির সঙ্গে আলাপ করতে করতে কবে যে শিশিরের চোখে ঘুম চলে এল টেরই পায়নি। তাই সে বীথিকে শুভ রাত্রী বলে মুঠোফোনের আজকের আলাপের সমাপ্ত করল। কারণ, পরদিন ভোরে উঠে আবারতো কাজের জন্য অফিসে যাওয়া লাগবে।
*লেখক: মাহবুব নেওয়াজ মুন্না: প্রাবন্ধিক, বেসরকারি সংস্থার কর্মী