আমার জুলাই স্মৃতি

রাত প্রায় সাড়ে ৩টা। ঘুম ঘুম চোখে স্মৃতি রোমন্থনে নেমেছি।

কত কী মনে পড়ে আজ।

সেই ১৫ জুলাই ২০২৪।

রাজশাহী থেকে দুই দিনের জন্য পালিয়ে বাসায় আসতেছি।

বাসে উঠে দেখি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কোটা সংস্কার আন্দোলনকারী ছাত্রছাত্রীদের ওপর হামলা।

সেই থেকে শুরু হলো একের পর ঘটনা আতঙ্ক।

পুরোটা সময় ঢাকায় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে থাকার সুবাদে মনে হচ্ছিল চোখের সামনে দিয়ে ঘটনাগুলো ঘটে যাচ্ছে। এই গোলাগুলি, মিছিল, পুলিশ—এগুলো পেরিয়ে প্রায়ই নীলক্ষেত, ইরাকি মাঠ গিয়েছি।

মনে পড়ে ১৯ জুলাই যাত্রাবাড়ী গিয়েছিলাম পরিবারের এক অত্যাবশকীয় কাজে বাসার সবাই। সিএনজিচালিত অটোরিকশা যাত্রাবাড়ীর এক ওভারব্রিজের সামনে থামিয়ে দিল। আর যাবে না। দেখলাম খানিক দূরেই আগুন জ্বলছে, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস কাজ করছে। ওভারব্রিজে অনেক ধোঁয়ার মধ্য দিয়ে পার হচ্ছি ফোন বের করে ভিডিও করতে যাব ভাইয়া কড়া ভাষায় একটা ধমক দিল যে ‘গুলি খেয়ে মরতে না চাইলে দ্রুত পার হ।’ (আমার এক ফ্রেন্ড মজা করে বলেছিল আজ বাসায় আমরা দু–একজন কম ফিরতে পারি মানসিক প্রস্তুতি রাখতে।)

নিজেরাই বুঝতে পারিনি এত বিপজ্জনক দিনে আমরা বাসার সবাই এমন ভয়াবহ জায়গাতে গিয়েছি।

ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। ফিরতে হচ্ছিল হেঁটে আন্দোলন–পুলিশের মাঝ দিয়ে। কারণ, যাত্রাবাড়ী থেকে ফেরার আর কোনো দ্বিতীয় রাস্তা নেই। গাড়িঘোড়াও নেই। এর মধ্যে আমার পায়ে ফোস্কা পড়ে গেছে হিল পরে হাঁটতে হাঁটতে, হিল খুলে হাতে নিয়ে খালি পায়ে হাঁটছি। রাস্তার ছোট ছোট সুরকি পায়ে ফুটে যাচ্ছে।

একদম থমথমে অবস্থা।

মাঝেমধ্যে দু–একটা মিছিল এলোমেলোভাবে আমাদের মাঝ দিয়ে চলে যাচ্ছে। জায়গায় জায়গায় অস্ত্র তাক করে আছে পুলিশ।

আব্বু, আমি, ভাবি, আমার দুই ভাই। আমার তিন বছরের ভাতিজা কোলে উঠে ভয়ে জড়সড়। একসময় খেয়াল হলো আমরা সবাই মনে মনে দোয়া পড়ছি।

ওয়ারীর দিকে গিয়ে রিকশা পেলাম। রিকশাওয়ালা বলল, ‘আপা জবাই মুরগি যেমন ছুড়ে ছুড়ে ফেলে, অমনে আজ লাশ পুলিশ ট্রাকে তুলে নিয়ে গেছে।’

আমার অতিরঞ্জন মনে হলো। পরে এসে দেখি যাত্রাবাড়ীতে ওই দিন সব থেকে বেশি গুলি করে মারা হয়েছে। আর যাত্রাবাড়ী ট্র্যাজেডি ১৯ জুলাই ছিল ৫ আগস্টের পর উন্মোচন হলো।

নাগরিক সংবাদ-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

বাসায় ফিরে সবাই অনেক পানি খেলাম। মুগ্ধসহ অনেকেই গুলি খেয়ে মারা গেছে। দেখে এত খারাপ লাগতে শুরু করল। আমি সহ্য করতে পারছিলাম না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সারা দিন থাকতাম। কী এক ঘৃণা জন্মাইতে শুরু করল। পরে অবশ্য নেট বন্ধ করে দেওয়ায় সেটাও সম্ভব হচ্ছিল না।

এরপরে কারফিউ জারি হলো। বাসার নিচেই পুলিশ থাকত।

আমরা বাসায় জড়সড় অলস দিন পার করছি সারা দিন এসব আলোচনা করে। ফোনে বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে, বাসায় কথা বলে। আব্বু শুধু নামাজ পড়ত। এসব দেখে সহ্য করতে না পেরে কেমন চুপ হয়ে গেল।

২৭ জুলাই বা এর আশপাশে হেলিকপ্টার থেকে গুলি আসতে লাগল। কত মানুষ যে স্নাইপারের গুলিতে মারা গেল! জানালার পাশে দাঁড়ানোও ভয়ের হয়ে গেল। কোথা থেকে স্নাইপার শট আসে।

তীব্র ক্ষোভ জেগে উঠল দেশে।

আমি একদম অস্থির হয়ে গেছি কারফিউতে বাসায় থেকে।

আমি আমার ভাতিজাকে নিয়ে বাইরে বের হলাম নিশ্বাস নিতে। বাসা থেকে বুড়িগঙ্গা কাছে হওয়ায় ভাবলাম নৌকায় ভাসলে অস্থিরতা কমবে।

বুড়িগঙ্গা তখন টইটম্বুর পানিতে। কোনো দুর্গন্ধও নেই। এত সুন্দর ঝিলিমিলি পানি জুলাই ছাড়া দেখা যায় না। মিটফোর্ডের ঠিক সোজা আমরা যখন মাঝ নদীতে দেখলাম একটা হেলিকপ্টার ঠিক আমাদের মাথার ওপরে।

গা–হাত–পা হিম হয়ে গেল। দোয়াও মুখ দিয়ে বের হচ্ছিল না। আমার তিন বছরের ভাতিজাকে কোলের মধ্যে জড়ায়ে ধরলাম। হেলিকপ্টার কিছুক্ষণ এদিক–ওদিক করে চলে গেল। বাসায় এসে কাউকে কিছু বলিনি। চুপচাপ দোয়া পড়তে পড়তে বিছানায় ঢলে পড়লাম।

এই কয়েক দিনে ছাত্রদের কোনো কর্মসূচি চলছিল। এত লাশ, মৃত্যু, ঘৃণা, ক্ষোভের সময় আর হয় না। মনে হচ্ছিল রক্তে আন্দোলনের জোয়ার বইছে।

সবাই জেগে গেছে। আর থামানো যাবে না।

২ কি ৩ আগস্ট সম্ভবত শহীদ মিনারে সমবেত সবাই ‘এমন দেশটি কোথাও খঁজে পাবে নাক তুমি’ গানটা শুনে গায়ের সমস্ত লোম দাঁড়িয়ে গেল। মনে হলো দেশের জন্য জীবন দিয়ে দিই। এক অদ্ভুত তীব্র অনুভূতি! এত ভালোবাসা, প্রেম দেশের জন্য সবার। সঙ্গে আরেক মাত্রা যোগ করেছিল ছাত্রছাত্রীদের পুলিশের সঙ্গে প্রতিরোধ দৃশ্যের ‘আমার বিচার তুমি কর তোমার বিচার করবে কে?’ ভেবেছিলাম এই গানের ব্যান্ডের সবাই পরে সম্মাননা পাবেন। এমন কিছু হয়েছে কি না জানা নেই।

এরপরে এল সেই দিন। সারা দিন অঝোরে বৃষ্টি। যেদিন সারা দেশের লাশ পড়ল। বেশির ভাগ এইচএসসির ছাত্ররা। আমার ইন্টারমিডিয়েটে পড়া ছোট ভাই ও কোন ফাঁকে কারফিউ ভেদ করে চলে গেছে জানিই না। আফনানসহ কত কলেজপড়ুয়া বাচ্চা যে মারা গেল। পাবনার দুইটা ছেলের লাশ দেখে মনে হচ্ছিল আমার ভাই এগুলো। পরে তো মনে হয় নেটই বন্ধ করে দিল।

দেশে এক দফা জারি হলো। লংমার্চ এক দিন এগিয়ে ৫ আগস্ট করল আজ ছিল সেই রাত।

আমি রাতে ঘুমাইতে পারছিলাম না এন্টিসিপেশনে। ভাবছিলাম আল্লাহ কাল না কত লাশ পড়ে। আল্লাহ তুমি বাঁচাও সবাইকে। অনেক রাত ধরে বিভিন্নজনের সঙ্গে এই নিয়ে ফোনে কথা বললাম। কারণ, নেট বন্ধ, ফেসবুক বন্ধ।

রাতে ঘুম না হওয়ায় ৫ আগস্ট দেরিতে ঘুম ভাঙল। ভাইয়া বলল হাজারো মানুষ নাকি বের হইছে রাস্তায়। কিন্তু বুঝতে পারছি না কী হয়। আজ একটু এদিক–ওদিক হলে পুরো রক্ত দিয়ে দেশ ভেসে যাবে। আব্বু অনেককে ফোন দিচ্ছে খবর নিতে কী অবস্থা।

আমি ভাবলাম শেষ। এত লাশের পরে লাশ আর তীব্র ক্ষোভ নিয়েই বাঁচতে হবে। আবার অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানলাম সেনাবাহিনী মাঠে নামছে; কিন্তু জনগণের পক্ষে। কেমন উৎফুল্লতা কাজ করল যখন পরে একটার দিকে নেট এল। ভাবলাম নাহ, সামথিং হ্যাজ হ্যাপেন্ড। আবার জাতির উদ্দেশে ভাষণ।

অ্যান্ড ইয়েস! ঘটনা বদল গ্যায়া। আপা ফ্লায়িং।

চারদিকে কী যে উত্তেজনা মুহূর্তেই। ঢাকার সমস্ত মানুষ রাস্তায় নেমে এল।

আহ! স্বৈরাচারের পতন। মানুষের ক্ষোভে ঘৃণায় দম বন্ধ উপক্রম থেকে রাস্তায় নেমে কী যে তার প্রতিফলন। আমার মনে হয় জীবনে এমন দিন আর আসবে না। একা একা পায়ে হেঁটে পুরান ঢাকা হয়ে টিএসসি হয়ে গণভবনের দিকে যাচ্ছি। কাউকে চিনি না; কিন্তু মনে হচ্ছে সবাই পরিচিত। মনে হতে থাকল একাত্তরের ১৬ ডিসেম্বরের কথা। মানুষের কী তীব্র উচ্ছ্বাস, সে তো সবাই দেখেছে। আর আমার নিজের চোখে দেখার অভিজ্ঞতা হলো। আমি জুলাইয়ের জীবন্ত সাক্ষী। এটা জীবনের একটা বড় পাওয়া।

কিন্তু সব থেকে কষ্ট হয় আজ রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধিতে সবাই ব্যস্ত। এত এত যে তাজা প্রাণ ঝরে পড়ল, তাদের কথা যেন কেমন সবাই পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে।

কথা ছিল ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাক তুমি, সকল দেশের রানী সে যে আমার জন্মভূমি’ করার। কারা শহীদদের কথা রেখেছে?

ঘুমে ঢলে পড়ছি আর ওই রাতের কথা ভাবছি, আজ আমি সেদিনের মতোই ঘুমাব না।

* ৩৬ জুলাই ২০২৫, ভোর ৪টা ৩০ মিনিট।