ফিলিস্তিন পরিস্থিতিতে কাঠগড়ায় বিশ্ব বিবেক
প্রতিটি জীবকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে, তবে এমন মৃত্যু কাম্য নয় যে মৃত্যুর মাধ্যমে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত ৫০০টির বেশি ফিলিস্তিনি গ্রাম ও শহর ধ্বংস করা হয়েছিল। যাকে ফিলিস্তিনিরা আরবি ভাষায় ‘নাকবা অথবা বিপর্যয়’ হিসেবে উল্লেখ করেন। সে সময় গণহত্যায় কমপক্ষে ১৫ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছিলেন। ইহুদিরা সে সময় ফিলিস্তিনের ৭৮ শতাংশ দখল করেছিলেন। আর অবশিষ্ট ২২ শতাংশ বর্তমানে অধিকৃত পশ্চিম তীর ও অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা। ১৯৪৮ সালের ১৫ মে ইসরায়েল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রথম আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়া হয়। এরপরই শুরু হয় আরব-ইসরায়েল যুদ্ধ। ১৯৪৯ সালের জানুয়ারিতে ইসরায়েল, মিসর, লেবানন, জর্ডান ও সিরিয়ার মধ্যে যুদ্ধবিরতির মাধ্যমে তা শেষ হয়। ১৯৬৭ সালের ৫ জুন আরব সেনাবাহিনীর একটি জোটের বিরুদ্ধে ছয় দিনের যুদ্ধে ইসরাইল গাজা উপত্যকা, পশ্চিম তীর, পূর্ব জেরুজালেম, সিরিয়ার গোলান হাইটস ও মিসরের সিনাই উপদ্বীপসহ ফিলিস্তিনের বাকি অংশ দখল করে। এটি ফিলিস্তিনিদের জন্য দ্বিতীয় জোরপূর্বক স্থানচ্যুতি বা ‘বিপর্যয়’। সে সময় অধিকৃত পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকায়ও বসতি স্থাপন শুরু করেছিলেন ইহুদিরা।
১৯৮৮ সালে ইসরাইলের মানবাধিকার সংস্থা বি’তেসেলেমের মতে, ইন্তিফাদার সময় ইসরাইল বাহিনীর হাতে ১ হাজার ৭০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তার মধ্যে ২৩৭টি শিশু। গ্রেপ্তার করা হয়েছিল ১ লাখ ৭৫ হাজারের বেশি মানুষকে। ২০০০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর লিকুদ বিরোধী নেতা অ্যারিয়েল শ্যারন জেরুজালেমের পুরোনো শহর ও তার আশপাশে হাজারো নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ে আল-আকসা মসজিদ প্রাঙ্গণে সফর করেছিলেন। সে সময় ফিলিস্তিনি বিক্ষোভকারী ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘর্ষে দুই দিনে ৫ জন ফিলিস্তিনি নিহত, ২০০ জন আহত হয়েছিলেন। ২০০৬ সালের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় হামাস। ২০০৭ সালের জুনে হামাসের ওপর ‘সন্ত্রাসবাদের’ অভিযোগ এনে গাজা উপত্যকায় স্থল, বিমান ও নৌ অবরোধ আরোপ করে ইসরায়েল। গাজায় ২০০৮, ২০১২, ২০১৪ সাল পর্যন্ত ৩টি এবং ২০১৭ সালে ড্রোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের ইসরাইলের দূতাবাস তেল আবিব থেকে জেরুজালেমে স্থানান্তরের ঘোষণা দিলে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০২১ সালে একটিসহ চারটি দীর্ঘস্থায়ী সামরিক হামলা করেছে ইসরাইল।
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলার সাড়ে তিন মাস পেরিয়েছে। হামলা-সংঘাতে প্রতিদিনই গাজায় প্রাণ যাচ্ছে বহু মানুষের। সবচেয়ে বেশি আঘাত এসেছে নারী ও শিশুদের ওপর। জাতিসংঘের নারীবিষয়ক সংস্থা ইউএনওমেন জানিয়েছে, গাজায় প্রতি ঘণ্টায় দুজন মা প্রাণ হারাচ্ছেন। ইউএনওমেন গত শুক্রবার সতর্ক করে বলেছে, গাজায় এখন যা ঘটছে, সেসবের ভয়াবহ মানসিক আঘাত (ট্রমা) ফিলিস্তিনিদের প্রজন্মান্তরে বইতে হবে। প্রায় ১৬ হাজার নারী-শিশুর প্রাণ গেছে। গাজায় অন্তত ৩ হাজার নারীর স্বামীর মৃত্যু হয়েছে এবং প্রায় ১০ হাজার শিশু বাবা হারিয়েছে। ইউএনওমেন আরও জানিয়েছে, গাজার ২৩ লাখ বাসিন্দার মধ্যে ১৯ লাখ হামলার জেরে বাস্তুচ্যুত। সেখানকার প্রায় ১০ লাখ নারী ও মেয়েশিশু আশ্রয়–নিরাপত্তা খুঁজছেন।
জাতিসংঘের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসিকে বলেছেন, ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির ফলে তরুণদের একটি ‘প্রজন্ম’ হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে। ইউনাইটেড নেশনস অফিস ফর দ্য কো-অর্ডিনেশন অব হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাফেয়ার্স যুদ্ধের প্রভাবের ওপর নিয়মিত বুলেটিন প্রকাশ করে। সংস্থাটির সবশেষ আপডেট অনুসারে, গাজার অন্তত ৬০ শতাংশ বাড়ি বা আবাসন ইউনিট ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রতি ১০টি স্কুলের মধ্যে ৯টির উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়েছে। হাসপাতাল, পাবলিক বিল্ডিং ও বিদ্যুতের নেটওয়ার্কগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাতের আঁধারে বোমার অগ্নি–ফুলকিই একমাত্র আলোর উৎস। জাতিসংঘ বলেছে, তাদের এক প্রজন্ম পুরোপুরি হারিয়ে যেতে পারে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান উড়িয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ইসরায়েলি সেনাদের উল্লাস করার ছবিগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, গাজার ৩৬টি হাসপাতালের মধ্যে মাত্র ১৩টি কার্যকর। এর মধ্যে বিমান হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে অনেকটি। প্রাথমিক চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতির কারণে যাঁদের চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, তাঁরা প্রায়ই চিকিৎসা না নিয়েই চলে যান।
বিবিসি, আল-জাজিরার খবরে বলা হয়েছে, গত ৭ অক্টোবর থেকে গাজায় ইসরাইলি হামলায় কমপক্ষে ২৬ হাজার ১০৫ জন নিহত ও ৬২ হাজার ৬৮১ জন আহত হয়েছেন। এখন পর্যন্ত এক হাজার মসজিদ ধ্বংস হয়েছে, শতাধিক ইমাম নিহত হয়েছেন। হাসপাতাল, স্কুল, শরণার্থীশিবির, মসজিদ, গির্জাসহ হাজারো ভবন ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস হয়ে গেছে। এমনকি গাজার কবরস্থানগুলোও ছাড়ছে না ইসরায়েল। এটি আন্তর্জাতিক সনদ ও মানবাধিকারের প্রতি স্পষ্ট চ্যালেঞ্জ। ইসরায়েলের এই ধরনের কর্মকাণ্ড আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন ও যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। ২৭ জানুয়ারি গাজায় সামরিক তৎপরতা বন্ধ করতে দখলদার ইসরাইলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে রায় দিয়েছে ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিস (আইসিজে)। দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে (আইসিজে) ইসরাইলের বিরুদ্ধে গাজা ইস্যুতে করা গণহত্যার মামলায় সমর্থন প্রকাশ করেছে মালদ্বীপ, নামিবিয়া ও পাকিস্তান।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী জোর দিয়ে বলেছেন, ‘সম্পূর্ণ বিজয়’ না হওয়া পর্যন্ত গাজায় সামরিক অভিযান অব্যাহত থাকবে। ওদিকে সাম্প্রতিক কালে বারবার ইসরাইলি কর্মকর্তারা আল–আকসা মসজিদে প্রবেশ করেছিলেন। মুসলমানদের তৃতীয় পবিত্র স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয় আল–আকসাকে। এর অমর্যাদা সংগত কারণেই ফিলিস্তিনিদের আহত করেছিল। এ প্রসঙ্গে এও স্মরণ করা যেতে পারে, গাজায় একটানা ১৬ বছর ধরে চলছে ইসরাইলি অবরোধ। এতে ফিলিস্তিনিদের আয়-উপার্জন সীমিত হয়ে পড়েছে। খাদ্যসহ অর্থনৈতিক সংকটে তারা নাজেহাল ও ক্ষুব্ধ।
প্রাণ মুসলমান, খ্রিষ্টান বা ইহুদির হোক, তা সমান মূল্যবান। যুদ্ধ প্রাণহানি ও ধ্বংস ছাড়া আর কোনো কিছু দেয় না। ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড থেকে ফিলিস্তিনিদের সম্পূর্ণ নির্মূল ও বিতাড়নই ইসরায়েলের আসল লক্ষ্য। পশ্চিমারা সব সময় ফিলিস্তিনিদের কোনো জবাবি হামলার পর ইসরাইলের ‘আত্মরক্ষার অধিকারের’ কথা বলে ইসরায়েলকে প্ররোচনা ও শক্তি জোগায়। প্রশ্ন হলো, আত্মরক্ষার অধিকার কি কেবল ইসরায়েলের বা ইহুদিদের আছে, মুসলমান বা ফিলিস্তিনিদের নেই? বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তার অজুহাতে তারা আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া প্রভৃতি মুসলিম রাষ্ট্র ও তাদের জনগণের সঙ্গে কী ব্যবহার ও আচরণ করেছে, তা কারও অজানা নয়। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে’র নামে এসব মুসলিম রাষ্ট্রকে প্রায় ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে।
এত দিনের ‘ফিলিস্তিন সমস্যা’র সমাধান না হওয়া বিশ্ব নেতাদের শোচনীয় ব্যর্থতার প্রমাণ বহন করে। যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো আন্তরিক হলে অনেক আগেই এ সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। বস্তুত তাদের স্বার্থেই সংকট বহাল রয়েছে। তারাই এ সংকট জিইয়ে রেখেছে। ভারত, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, ইউরোপীয় কমিশন, জার্মানি, গ্রিস, ইতালি, স্পেন, চেক প্রজাতন্ত্র, ইউক্রেন ও পোল্যান্ড ন্যক্কারজনকভাবে ইসরাইলের পক্ষে অবস্থান নিয়ে সন্ত্রাসী কাজে মদদ দিচ্ছে। আর ফিলিস্তিনের পক্ষে কথা বলছে—চীন, ইরান, সৌদি আরব, কাতার, মালদ্বীপ, পাকিস্তান, লেবানন, তুরস্ক, বাংলাদেশ, আফগানিস্তান ও নামিবিয়া। আরব বিশ্ব কিংবা ওআইসির ভূমিকাও প্রশ্নবিদ্ধ। আরব লিগ ও ওআইসি দৃঢ়ভাবে ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়ালে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমারা লেজ গুটাতে বাধ্য হতো। গোটা মুসলিম জাহানকে মনে রাখতে হবে—ফিলিস্তিনের পরাজয়ের অর্থ সমগ্র মুসলিম বিশ্বের পরাজয়। তারা শান্তি, স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের পক্ষে কি না, তার প্রমাণ দেওয়ার এখন একটা উপযুক্ত সময়।
* লেখক: গাজী মোহাম্মদ এনামুল হক (ফারুক), প্রভাষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি ফুলতলা মহিলা কলেজ, ফুলতলা, খুলনা