চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ দিবস, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির বাণী প্রদানের উদ্যোগ সময়ের দাবি

পুলিশ লাইন অস্ত্রাগার -১৯৩০

‘ধীর শান্ত গম্ভীর। তাঁর মুখে প্রশান্তি দেখে কে অনুমান করতে পারবে তাঁর অন্তরে আগ্নেয়গিরির জ্বালা? বিস্ফোরণের পূর্বমুহূর্তে বারুদের স্তূপ যেমন শান্ত স্থির নিশ্চল হয়ে ঘুমিয়ে থাকে, ঝড়ের আগে সমস্ত পৃথিবী যেমন নিশ্চুপ হয়ে যায়, তেমনি ১৮ এপ্রিলের প্রত্যুষে অতলস্পর্শী সমুদ্রের মতো, গগনচুম্বী হিমাদ্রি শিখরের মতো ধীর স্থির, শান্ত, অচঞ্চল হয়ে বসেছিলেন মাস্টারদা, যুব বিদ্রোহের মহানায়ক সূর্য সেন।’ বিপ্লবী অনন্ত সিংহ মাস্টারদা সম্পর্কে ‘চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ-০১’ বইয়ে লিখেছেন।
১৭৫৭ সালের জুন মাসে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ে ভারত উপমহাদেশে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়ে পরাধীনতার অন্ধকার নেমে এসেছিল। তাই সাংবাদিক, সাহিত্যিক, প্রবন্ধকার কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন:
স্বাধীনতা-হীনতায় কে বাঁচিতে চায় হে,
                  কে বাঁচিতে চায়?
দাসত্ব-শৃঙ্খল বল কে পরিবে পায় হে,
                  কে পরিবে পায়।
কোটিকল্প দাস থাকা নরকের প্রায় হে,
                  নরকের প্রায়!
দিনেকের স্বাধীনতা, স্বর্গসুখ-তায় হে,
                  স্বর্গসুখ তায়!

পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আন্দোলন শুরু করেন। তাই পার্বত্য চট্টগ্রামের জুমিয়া রাজাদের বিদ্রোহ, মেদিনীপুরের দুর্জন সিং চোয়ার জনগোষ্ঠীর বিদ্রোহ, ফকির মজনু শাহ, দেবী চৌধুরাণী ও ভবানী পাঠকের নেতৃত্বে ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহ। সৈয়দ আহমদ ও শাহ ওয়ালীউল্লাহর নেতৃত্বে ওহাবি আন্দোলন, তিতুমীরের বিদ্রোহ (‘বাঁশের কেল্লা’ দেশীয় দুর্গ বানিয়ে প্রতিরোধ), হাজী শরীয়তুল্লাহ ও তাঁর পুত্র দুদু মিয়ার নেতৃত্বে ফরায়েজি আন্দোলন, ব্যারাকপুরে মঙ্গল পাণ্ডের নেতৃত্বে ও চট্টগ্রামে হাবিলদার রজব আলীর নেতৃত্বে সিপাহি বিদ্রোহ, সিধু কানু চাঁদ ও ভৈরবের নেতৃত্বে সাঁওতাল বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। সবশেষে পাঞ্জাবের অমৃতসরের জালিয়ানওয়ালাবাগে কুখ্যাত রাওলাট আইনের প্রতিবাদে প্রায় ১০ হাজার নিরস্ত্র জনতার ওপর জেনারেল মাইকেল ও ডায়ারের নির্দেশে ব্রিটিশ পুলিশ বাহিনী নির্বিচার গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে সরকারি মতে ৩৭৯ জন নিহত ও ১ হাজার ২০০ জন আহত হযন। নিহত ও আহতের সংখ্যা বাস্তবে অনেক বেশি ছিল বলে ধারণা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে চট্টগ্রামের ছাত্ররাও ক্লাস বর্জনসহ সভা-সমাবেশ করেন। সভায় সূর্য সেন তাঁর বক্তব্যে ব্রিটিশবিরোধী মনোভাব জাগিয়ে তুলতে সক্ষম হন।

এসব ঘটনায় কিশোর, তরুণ, বৃদ্ধসহ সব বয়সের নারী–পুরুষের মধ্যে ক্ষোভ বাড়তে থাকে। ইতিমধ্যে ১৯ শতকের প্রথম থেকেই অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা অনুশীলন, যুগান্তর নামে বিপ্লবী দলের মাধ্যমে সশস্ত্র আন্দোলনের প্রস্তুতি নিতে থাকে।

এই প্রেক্ষাপটে মাস্টারদা সূর্য সেন আইরিশ রিপাবলিকান আর্মির বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখা’ গঠন করেন। চট্টগ্রামের আসকার দিঘীর পাড়ে অবস্থিত কংগ্রেস অফিসে বসে যুব বিদ্রোহের পরিকল্পনা করেন। মাস্টারদার নির্দেশে বাংলার মুক্তিপিয়াসী কিশোর ও যুবক বিপ্লবী প্রস্তুত। অস্ত্র জোগাড় হলো ও করলডেঙ্গার গহিন পাহাড়ি জঙ্গলে হলো প্রশিক্ষণ।

চট্টগ্রাম জেলা কারাগারে মাস্টারদা ও তারকেশ্বরের ফাঁসির মঞ্চ

১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল রাত ১০টায় শুরু হয় চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ। পাঁচটি দলে বিভক্ত সহযোগীসহ ৬৫ জন বিপ্লবী মাঝরাত অবধি সফল যে অভিযান পরিচালনা করেছিলেন, সংক্ষেপে বর্ণনা করা হলো।

লালমোহন সেনের নেতৃত্বে সুবোধ মিত্র, সুকুমার ভৌমিক ও সৌরীন্দ্র কিশোর চট্টগ্রাম থেকে ৬০ কিলোমিটার দূরে ধুম স্টেশনের কাছাকাছি এবং গজেন্দ্রকুমার ভট্টাচার্য্যের নেতৃত্বে বিজয় আইচ, শংকর সরকার ও সুশীল দে চট্টগ্রাম থেকে ৭২ কিলোমিটার দূরে নাঙ্গলকোট স্টেশনের কাছে রাত আটটায় রেললাইন উপড়ে ফেলেছিলেন। তাঁরা পাশের টেলিগ্রাফের তার কেটে চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগ ও সাহায্য আসার পথ বন্ধ করে দিয়েছিলেন।

টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ বিচ্ছিন্নকরণের দায়িত্বে ছিলেন অম্বিকা চক্রবর্তীর নেতৃত্বে কিশোর বিপ্লবী আনন্দ গুপ্ত, কালিপদ চক্রবর্তীসহ সাতজন বিপ্লবী। তাঁরা সফলভাবে চট্টগ্রাম শহরের টেলিফোন ও টেলিগ্রাফ অফিসের বোর্ড হাতুড়ি দিয়ে ভেঙে যন্ত্রাংশে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। গুড ফ্রাইডের কারণে ইউরোপিয়ান ক্লাব রাত ৯টায় বন্ধ হওয়ার কারণে রাত ১০টায় নরেশ রায়ের নেতৃত্বে ছয়জন বিপ্লবী দল ব্যর্থ হয়ে পুলিশ লাইন অস্ত্রাগার আক্রমণকারী দলের সঙ্গে যোগ দেয়।

অক্সিলিয়ারি ফোর্সের অস্ত্রাগার দখলে লোকনাথ বল এবং নির্মল সেনের নেতৃত্বে ছয়জন বিপ্লবী অংশ নেন। তাঁরা অস্ত্রাগার ইনচার্জ মেজর ফ্যারেলকে হত্যা করে বেশ কিছু অস্ত্র গাড়িতে উঠিয়ে নেন। অস্ত্রাগারটিতে আগুন লাগিয়ে অপারেশন শেষ করে পুলিশ লাইন আক্রমণকারী দলের সঙ্গে যোগ দেন। চট্টগ্রাম পুলিশ লাইন অস্ত্রাগার দখলের নেতৃত্বে ছিলেন গণেশ ঘোষ ও অনন্ত সিং। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন দেবপ্রসাদ গুপ্ত, হরিপদ মহাজন, হিমাংশু সেন আর সরোজ গুহ। ৩০ জন বিপ্লবী পুলিশ লাইন অস্ত্রাগারের পাশের জঙ্গলে আগে থেকে আত্মগোপন করে ছিলেন। টর্চ লাইটের সংকেতে স্লোগান দিয়ে যোগ দেওয়ার অপেক্ষায় ছিলেন তাঁরা।

সফলভাবে বিদ্রোহ সম্পন্ন করার পর মাঝরাতে মাস্টারদার নির্দেশে বিপ্লবীরা পুলিশ লাইন অস্ত্রাগারের সামনে সমবেত হন। ব্রিটিশ জ্যাকপট নামিয়ে উত্তোলিত হয়েছিল স্বাধীন ভারতের পতাকা। উত্তোলিত পতাকার নিচে দাঁড়িয়ে ৩৬ বয়সী এই যুবক দৃপ্তকণ্ঠে শপথবাক্য পাঠ করে ঘোষণা করলেন, ‘চট্টগ্রাম এ মুহূর্তে স্বাধীন।’ সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের সমস্ত অহংকার চূর্ণ করে মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে কিশোর ও তরুণ যোদ্ধারা একটি বার্তা দিয়েছিলেন। বার্তাটি হলো, ‘ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্তমিত হয়।’ এ ঘটনা অবিভক্ত ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাস ‘চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত।

পুলিশ লাইন অস্ত্রাগারে আক্রমণের সময় ব্রিটিশ পুলিশ অফিসাররা ভয়ে পাশের জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পুলিশ লাইন অস্ত্রাগার দখলের খবরে শহরে থমথমে অবস্থা ছিল। ইংরেজরা কেউ বাসা থেকে বের হচ্ছিল না। মনে চরম ভীতির সঞ্চার হয়েছিল। অনেকে পরিবারসহ কর্ণফুলীর মোহনায় জাহাজে আশ্রয় নেয়। থানার পুলিশ সদস্যরা আত্মসমর্পণের চিন্তা করছিল। মাস্টারদা বললেন, ‘এখন কোনো নতুন প্রোগ্রামে হাত দিয়ো না। আপাতত কোনো নিরাপদ আশ্রয়ে আত্মগোপনই একমাত্র পন্থা।’ তাই বিপ্লবীদের নিয়ে অম্বিকা চক্রবর্তীর নির্দেশনায় উত্তর দিকে জালালাবাদ পাহাড়ে চলে যান। পরদিন মাস্টারদা আলোচনায় বসে শহরে ঢুকে অতর্কিত আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। চার দিন চট্টগ্রাম ইংরেজ শাসনমুক্ত ছিল।

ইতিমধ্যে জেলা প্রশাসক প্রাণ হাতে নিয়ে জাহাজের রেডিও বার্তায় বাইরে খবর পাঠালে বিপ্লবীদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য ইংরেজরা ২২ এপ্রিল বিকেলে প্রশিক্ষিত ও ভারী অস্ত্রে সজ্জিত বিশাল সৈন্যবহর জড়ো করেছিল। সম্মুখযুদ্ধে ১২ বিপ্লবী প্রাণ দিলেও ব্রিটিশদের ৮২ জন প্রশিক্ষিত সৈন্য নিহত হয়েছিল। সেদিন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের অহংকার চূর্ণ করে দিয়েছিলেন মাস্টারদা ও তাঁর সহযোদ্ধারা।

চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের মামলায় ফাঁসীতে মৃত্যুদন্ড প্রাপ্তদের নাম ও ছবি।

হকচকিত ইংরেজরা মাস্টারদাকে ধরতে পুরস্কার ঘোষণা করে। প্রায় তিন বছর আত্মগোপনে থাকার পর পটিয়া উপজেলার গৈড়লা গ্রামে ক্ষীরোদপ্রভা বিশ্বাসের বাড়িতে ১৯৩৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি রাতের বৈঠকে থাকা অবস্থায় ইংরেজ সেনাবহর সূর্য সেন ও ব্রজেন সেনকে গ্রেপ্তার করে। তাঁদের গ্রেপ্তারে সাহায্য করেন বিশ্বাসঘাতক নেত্র সেন। তারকেশ্বর দস্তিদার দলের দায়িত্ব নেন। আনোয়ারা থানার গহিরা গ্রামে পুলিশ আর মিলিটারির সঙ্গে ১৯৩০ সালের ১৮ মে সংঘর্ষের পর তারকেশ্বর দস্তিদার ও কল্পনা দত্ত গ্রেপ্তার হন।

ইংরেজরা প্রহসনের বিচার শুরু করে। ইন্ডিয়ান পেনাল কোডের ধারা অনুযায়ী স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। বিচারে সূর্য সেন ও তারকেশ্বর দস্তিদারকে প্রাণদণ্ড এবং কুমারী কল্পনা দত্তকে যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। রায় অনুযায়ী ১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি মধ্যরাতে মাস্টারদা সূর্য সেন ও তারকেশ্বরকে ফাঁসিতে ঝোলানো হয়। তাঁদের ফাঁসি কার্যকর করার আগে ব্রিটিশ সেনা ও জেল পুলিশ মিলিতভাবে হাতুড়ি দিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে তাঁদের দাঁত, হাড় ভেঙে, মুখ থেঁতলে অর্ধমৃত করে ফেলে। ফাঁসি কার্যকর করার পর ‘দ্য রিনাউন’ নামে ব্রিটিশ জাহাজে করে শরীরের সঙ্গে লোহা বেঁধে ভারত মহাসাগরের কাছাকাছি কোনো স্থানে পানিতে ফেলে দেয়।

শারীরিক মৃত্যু হলো মাস্টারদার। কিন্তু তাঁর আদর্শে এগিয়ে চলল সংগ্রাম। মুক্ত হলো মাতৃভূমি। বিপ্লবীদের আন্দোলনের পথ ধরে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আজকের এই বাংলাদেশ। কিন্তু ‘চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ’ দিবসটি স্বাধীনতার যাত্রায় ইতিহাসের মাইলফলক হলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন, প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির বাণী প্রদানের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদনের ব্যবস্থা করা হয়নি। রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যোগ নেওয়া সময়ের দাবি।

*লেখক: তপন ভট্টাচার্য্য, অর্থ সম্পাদক, বিপ্লবী তারকেশ্বর দস্তিদার স্মৃতি পরিষদ, চট্টগ্রাম