বেইজিং–পরবর্তী ৩০ বছর; নারীর জীবনে এর  ফলাফল

ছবি: লেখকের সৌজন্য

‘নারীর চোখে বিশ্ব দেখুন’—এই স্বপ্ন নিয়ে ১৯৯৫ সালে অনুষ্ঠিত হয়ে ছিল চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলন। আগামী বছর পূর্ণ হবে এ যাত্রার ৩০ বছর। সারা পৃথিবী জুড়েই আয়োজন চলছে পর্যালোচনা ও  হিসাব–নিকাশ। চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনে যোগ দিয়েছিল সারা পৃথিবীর ৩০ হাজার নারী, পুরুষ ও অন্য পিছিয়ে পরা মানুষ। স্বপ্ন দেখেছিল এক অন্য রকম পৃথিবী গড়বার। অনেকেই সে সময় প্রশ্ন করেছিল, ‘কেন নারীর চোখে বিশ্ব দেখতে হবে? কেন মানুষের চোখে নয়?’ কেন নারীরা বা নারীবাদীরা আলাদাভাবে কিম্বা স্বার্থপরের মতো শুধু নিজেদের কথা ভাবে? উত্তর ছিল নারীদের কথা আলাদা করে কেউ কী কখনো ভেবেছে? নারীর বেদনা, নির্যাতন, ধর্ষণ, অর্থনৈতিক বৈষম্য ও শোষণের যে অভিজ্ঞতা, তা কেন আসেনি উন্নয়ন এজেন্ডায়? কেন এখনো নারী অবহেলিত? দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতি দুজন নারীর একজন পারিবারিক নির্যাতনের শিকার।

বেইজিংয়ে গ্রহণ করা হয়েছিল ‘বেইজিং প্ল্যাটফর্ম ফর অ্যাকশন।’ যেখানে ১২টি ইস্যুকে চিহ্নিত করেছিল সারা পৃথিবীতে থেকে আসা নারী আন্দোলনের কর্মীরা। কাজ করার অঙ্গীকার করে ১৮৯টি দেশ, যার মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশও।

আজ প্রায় ৩০ বছর পর কিছু কি ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে কী কন্যা ও নারীর জীবনে? নারীর প্রতি বৈষম্য ও অবহেলা কতটা দূর করতে পেরেছে রাষ্ট্রগুলো? কোনো মাপ কাঠিতেই কী কোনো দেশ জেন্ডার সমতায় সর্বোচ্চ সফলতা অর্জন করতে পেয়েছে? নারীর সম্পদ কী পূর্বের তুলনায় বেড়েছে? বেড়েছে কি আয়? সারা পৃথিবীতে নারী কাজকর্মে ৬৫ থেকে সত্তর ভাগ, নারীর আয় ১০ শতাংশ আর সম্পদ মাত্র ১ শতাংশ

নিদেনপক্ষে বেড়েছিল কি মর্যাদা? অবশ্যই সারা পৃথিবীতে, এমন কি বাংলাদেশে ও কিছু সংখ্যক নারী তার যোগ্যতায়, মেধায় ও পরিশ্রমে সাফল্য বয়ে এনেছেন।  সর্বোচ্চ কৃতিত্ব হয়তো কেউ কেউ পেয়েছেন? কিন্তু তা সংখ্যায় কতটুকু? কতোটা সামনে আসতে পেরেছে তৃণমূলসহ অন্য পিছিয়ে পরা নারী? সে কারণেই ইন্টারসেকসানিলিটি নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে নারীবাদীদের মধ্যে। সন্দেহ নেই একজন, দুজন নয়, উল্লেখযোগ্য–সংখ্যক নারীর জীবনে আশাব্যঞ্জক উন্নয়ন ঘটেছে। ক্ষমতায়নের সব সূচকেই হয়তো তারা এগিয়ে কিন্তু একটি বড় সংখ্যক নারীর জীবনে উন্নয়নের ছোঁয়া সামান্যই লেগেছে। সব নারীর জীবনেই সমভাবে সমতা, স্বাধীনতা, মর্যাদা বা মুক্তি অর্জিত হয়নি।

গত ১৫ থেকে ২১ নভেম্বর আলোচনা হয়েছে সরকারি, বেসরকারি পর্যায়ে। কী হলো এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলের বসবাসরত নারীর, জেন্ডার পরিচিতির নারী, আদিবাসী, প্রতিবন্ধী, ট্রান্স জেন্ডারসহ সব পিছিয়ে পরা নারী জীবনে? আলোচনা উন্নয়ন ঘটেছে আদতেই। আসলেই কি আশাতীত অর্জন ঘটেছে নারীর জীবনে?  পেরেছে কি তারা সব পিতৃতান্ত্রিক বঞ্চনা থেকে মুক্ত হতে? এশিয়া প্যাসিফিকের দেশের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধের প্রায় ৫০০ জনকে নিয়ে প্রথম দুই দিন চলল  আলোচনা ও পর্যালোচনা। এরপর তিন দিন হলো বিভিন্ন দেশেরমন্ত্রী ও সরকারি উচ্চপর্যায়ের  প্রতিনিধিদের সঙ্গে কথোপকথন ও আলোচনা। সরকারি প্রতিনিধিরা তাঁদের অর্জনগুলোই বেশি তুলে ধরেছেন। কিন্তু বাস্তব হচ্ছে ব্যর্থতার গল্পই বেশি। সেটিও উপলব্ধি করতে পারছেন না। অনেক দেশের সরকারের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তারা।

ব্যাংকক শহরের জাতিসংঘের কার্যালয়ে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিধের নিয়ে পর্যালোচনা শুরু হয়ে ১৬-১৮ শেষ হয় ১৮ নভেম্বর ২০২৪। তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি নিয়ে আলোচনা হয় এক দিন। এরপরই অর্থাৎ ১৯ থেকে ২১ নভেম্বর শেষ হলো মিনিস্ট্রিয়াল সভা। এশিয়া প্যাসিফিকের মধ্যে ৩৮ দেশ বিদ্যমান। যার প্রায় সব দেশের প্রতিনিধি এতে অংশ নেন। আগামী ২০২৫ এর মার্চে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে সিএসডব্লিউর সভায় ৩০ বছরের অগ্রগতি, ব্যর্থতা ও চ্যালেঞ্জসমূহ তুলে ধরবার জন্যে তৈরি হচ্ছে প্রতিটি সরকারই। পাশাপাশি নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরাও অগ্রগতি ও এখন কী করণীয়, তাদের প্রতিবেদনে তুলে ধরবেন। তাই এ পর্যালোচনা খুব  গুরুত্বপূর্ণ নারী সমাজের কাছে। এ সভায় প্রধানত যে অর্জনগুলো আলোচিত হয় তা হচ্ছে—

* মেয়েশিশুদের প্রাথমিক শিক্ষার হার বেড়েছে

* মাতৃমৃত্যুর হার কমেছে

* নারী উদ্যোক্তা বৃদ্ধি পেয়েছে

* বিভিন্ন অপ্রথাগত কাজে নারী যুক্ত হয়েছে

* কেয়ার ইকোনমি বিষয়ে নানাবিধ সৃজনশীল উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে, যার ফলে নারীর জীবনে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে।

* সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারী যুক্ত হয়েছে, যদিও সে সংখ্যা কোনো দেশেই আশাপ্রদ নয়।

* নারীর পাশাপাশি, পুরুষও নারীর সমতা আনয়নে কাজে যুক্ত হচ্ছে

*কোন কোন দেশে জেন্ডার ভূমিকার ক্ষেত্রেও কিছু পরিবর্তন ঘটেছে।

যে বিষয়গুলোয় বাঁধা বা চ্যালেঞ্জ অব্যাহত রয়েছে; তা নিম্নরূপ—

* এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের অনেক দেশেই সাম্প্রদায়িক বা ডানপন্থী সরকারের উত্থান ঘটছে

* একই সঙ্গে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বা আধিপত্যের সম্প্রসারণ ঘটছে। যার ফলে অনেক দেশেই নারীসহ অন্যান্য পিছিয়ে পরা মানুষেরা নানাবিধ সমস্যা মোকাবিলা করছে।

* দরিদ্র ও পিছিয়ে পরা মানুষের সঙ্গে বিত্তবানদের  আয় ও সম্পদে বৈষম্য বেড়েছে।

* কেয়ার ইকোনমি বা গৃহ পরিসরের কাজের সামাজিক ও অর্থনৈতিক মূল্যায়ন না করা এবং তা উত্তরণে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি যার ফলে বৈষম্য বৃদ্ধি পাচ্ছে

* রাজনীতি বা সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় নারীর অবস্থান ও অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে। রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ হতশামূলক।

* নারীর প্রতি সহিংসতা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই কমেনি বরং নানা ধরনের নির্যাতনের মাত্রা যুক্ত হচ্ছে।

* প্রতিকূল পরিবেশ বা উষ্ণতা বৃদ্ধি।

যে সুপারিশমালা কথা উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো—

* নারী ও শিশুর ওপর অর্থবহ  বিনিয়োগ বৃদ্ধি

* নারীর উন্নয়নে সমন্বিত পরিবর্তনমুখী কর্মসূচি গ্রহণ

* নারী পুরুষের জেন্ডার সমতা আনয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকারের ও বেসরকারি সংস্থাকে আর্থিক সহায়তা, বিশেষ করে তৃণমূলের নারী সাংগঠনগুলোকে সহায়তা প্রদান।

* ধর্মীয় আগ্রাসনকে চ্যালেঞ্জ করা ও এর বিরুদ্ধে সচেতনতা সৃষ্টি করা

* নারী উদ্যোক্তা বৃদ্ধি ও এ জন্য স্বল্প সুদে ঋণ–সুবিধাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও নীতিমালা প্রণয়ন

* বহুমুখী সেকটরাল পার্টনারশিপ বৃদ্ধি

* নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন তরান্বিত করা ও সমন্বিত কর্মসূচি ঘোষণা করা

* জেন্ডার রেসপেনসিভ বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করা

* পরিবেশ ঝুঁকি থেকে রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিকভাবে ও যৌথভাবে কাজ করা ও নারীকে ও অন্যান্য পিছিয়ে পরা নারী ও পুরুষকে এই  প্রক্রিয়ায় যুক্ত করা।

* নারী-পুরুষসহ অন্যান্য পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠী ও অন্যান্য জেন্ডার পরিচিতির মানুষের সমতা ও নির্যাতন প্রতিরোধে সরকারকে দায়িত্ববান দায়িত্ববান কর্মসূচি গ্রহণ করা

* সমতা আনয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও আইন প্রণয়ন। নারীদের লিগ্যাল সিস্টেম এ অংশগ্রহণ বাড়ানো

*একটি শিশুও বিশেষ করে মেয়ে শিশু যেন উন্নয়ন পরিকল্পনা থেকে বাদ না পরে তা নিশ্চিত করা।

এ ছাড়া  আঞ্চলিক পর্যায়ে  নাগরিক সমাজের সমন্বয়ে গঠিত হয় কোকাস। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এই কোকাসের স্টেটমেন্ট কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত হয়ে নিম্নলিখিত দাবিগুলো উত্থাপন করার সুযোগ ঘটে।

লেখক

দক্ষিণ এশিয়ার নারীদের দাবিগুলো হলো—

* সব রাষ্ট্র, ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান, করপোরেটসমূহ স্বাস্থ্য, পুষ্টি, শিক্ষা, সামাজিক নিরাপত্তাসহ, নারী নির্যাতন বন্ধের খাতে তাদের আর্থিক সহায়তা বৃদ্ধি করবে।

* নারী নির্যাতন প্রতিরোধ করার জন্য প্রয়োজনীয় বিনিয়োগ এবং মানসম্মত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সেবায় প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করবে।

* অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরতদের দুরবস্থার প্রতি মনোযোগ দেওয়া এবং তাদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।

* রাষ্ট্রকে অবশ্যই মর্যাদাপূর্ণ ও সমতাপূর্ণ কর্ম সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে, যার ফলে তাদের শ্রম অধিকার সুরক্ষিত হবে এবং সব ধরনের বৈষম্য দূর হবে।

* আমাদের অঞ্চলে প্রায় ৫৯  কৃষকই নারী। রাষ্ট্রকে অবশ্যই জীবিকা, সম্পদ এবং জুতসই প্রযুক্তি এবং তাদের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করার জন্য অবিচ্ছেদ্য স্বাধীন, কার্যকর অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

* সব কর্মপরিবেশে ডিজিটালাইজেন এ যথাযথ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

* আমরা আরও দাবি করছি যে নারী আন্দোলন/নারীবাদী সংগঠনগুলোকে আর্থিক সহায়তা প্রদাণ করা। যাতে তারা নারীদের আরও বেশি মাত্রায় স়ংঘটিত করতে পারে।

বাংলাদেশের সরকারি প্রতিনিধিদের সঙ্গে নাগরিক সমাজের এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠক হয়। নিম্নলিখিত দাবিগুলো বিবেচনা ও বাস্তবায়নের জন্য পেশ করা হয়—

—নারীর ওপর সব ধরনের বৈষম্য দূরীকরণে উদ্যোগ গ্রহণ ও সিডোর পুনর্বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।

—নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে এর জন্য আরপিও (RPO) পুনরায় পর্যালোচনা করা।

—তরুণ নারীসহ সব জেন্ডার পরিচিতির নারী , আদিবাসী প্রতিবন্ধী ট্রান্সজেন্ডার নারীদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করন

—সোশ্যাল মিডিয়াসহ সব ক্ষেত্রে নারীর ইতিবাচক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন না হয়, তা নিশ্চিত করা

—নারী উন্নয়ন জন্য একটি যুগ উপযোগী ও একটি সমন্বিত নারী উন্নয়ন নীতিমালা প্রণয়ন

—পোশাকশিল্পের নারীদের ওপর হয়রানি দিতে না হয়, তা নিশ্চিত করা ইত্যাদি

অনুষ্ঠানের সমাপনী বক্তৃতায় এশিয়া প্যাসিফিকের ইউম্যান উইম্যানের নির্বাহী পরিচালক উল্লেখ করেন ‘কী করতে পারিনি এটি বলা বা সমালোচনা করা খুব সহজ, কিন্তু এত  প্রতিকূলতার পরও, যা করতে পেরেছি বা অর্জিত হয়েছে বা করা সম্ভব হয়েছে, সেটিও বলা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ সরকারি প্রতিনিধি দলে এতে অংশগ্রহণ করেন। উপস্থিত ছিলেন শিশু ও মহিলাবিষয়ক অধিদপ্তরের উপদেষ্টাসহ উচ্চপর্যায়ের সরকারি প্রতিনিধিরা। নাগরিক সমাজের প্রতিনিধি ও ইউম্যান উইম্যান বাংলাদেশের এর প্রতিনিধিরা।

ইউম্যান উইম্যানের কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ মিস গীতাঞ্জলি সিং বলেন, ‘বাংলাদেশের  নারী, অন্যান্য জেন্ডার পরিচিতির মানুষসহ, সব পিছিয়ে পরা নারী, জেন্ডার সাম্য বৃদ্ধিতে ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ইউম্যান উইম্যান বাংলাদেশকে সহযোগিতার সব সময়ই দৃঢ় থাকবে বলে আশা করি।’

আগামী বছর ২০২৫,  মার্চ মাসে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে বেইজিং+৩০–এর বার্ষিক সভা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। সবাই তৈরি হচ্ছে আওয়াজ তুলবার আর নয় ক্ষমতার অপব্যবহার, আর ক্ষমতার প্রতি ভালোবাসা নয়, বৃদ্ধি পাক ভালোবাসার ক্ষমতা। মানুষ মানুষের পাশে থাকুক এবং একটি সমতার পৃথিবী গড়ি এই হোক আমাদের অঙ্গীকার।

*লেখক: ফৌজিয়া খন্দকার, নির্বাহী পরিচালক, প্র্যাগ্রোসর,