কী দোষ ছিল আমার!

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

খুব অল্প বয়সে একে একে সব হারিয়ে আজ প্রায়ই শূন্য আমি। কী দোষ ছিল আমার। এ নিষ্ঠুর পৃথিবীতে সবাই শুধু ছেড়ে যাওয়ার জন্য আসে। থাকতে কেউ চায় না পাশে। কাছে থেকে আশা দেওয়া, মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়া, সাহস করে দায়িত্ব নেওয়ার মতো কেউ নেই পাশে। সবাই শুধু পালিয়ে থাকতে চাই।

খুব ভালো কাটছিল আমাদের দিনগুলো। মা–বাবা আর দুই বোন মিলে আমাদের ছোট্ট পরিবার। মা–বাবা আমাদের খুব আদর করতেন। খুব সুখে-শান্তিতেই আমাদের দিনগুলো কাটছিল। স্কুলে ভর্তি হলাম দুই বোন। বাবা স্কুলে নিয়ে যেতেন, মা নিয়ে আসতেন। বাবা ব্যবসা করতেন। ব্যবসা করে ভালোই আয় করতেন, বলা যায়, তা দিয়ে আমাদের ভালোই চলছিল দিনগুলো।

হঠাৎ কী যেন হলো, আস্তে আস্তে সব ভেঙে গেল।

মা–বাবার মধ্যে ঝগড়া হতো, ছোটখাটো বিষয় নিয়ে বাবা অনেক রেগে যেতেন। আমাদের সঙ্গে থাকতেন আমার নানি। মা তেমন রান্নাবান্না করতে জানতেন না‌। নানি সবকিছু করতেন। অনেক আদর করতেন আমাদের। মা-বাবাকে অনেক ভালোবাসতেন। নানির অনেক যত্ন করতেন মা–বাবা। তাঁকে ছাড়া কখনো খেতেন না। মা–বাবার ভালোবাসার বিয়ে। কেন জানি দিন দিন মা-বাবাকে সন্দেহ করতে লাগলেন। মা বুঝতে পেরেছিলেন বাবার হয়তো অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে সম্পর্ক আছে। তাই হয়তো মায়ের সঙ্গে এমন করেন। আস্তে আস্তে বুঝতে লাগলাম সংসারটা মনে হয় টিকবে না। তখন আমার বয়স খুবই কম। তাঁদের মধ্যে ভুল–বোঝাবুঝি বেড়েই চলল। একটা পর্যায়ে মা আমাদের নিয়ে অন্য একটা বাসা ভাড়া করলেন। বাবা একা থাকতেন। দুজনেই সিদ্ধান্ত নিলেন, তাঁরা আর একসঙ্গে থাকবেন না। আমি চতুর্থ শ্রেণিতে উঠার পরই মা–বাবার বিচ্ছেদ হয়ে যায়। আমরা মায়ের সঙ্গে থাকি।

বাবা আমাদের খরচবাবদ টাকা পাঠাতেন। মাঝেমধ্যে আমাদের দেখতে আসতেন। তাঁর বাসায় নিয়ে যেতেন। তখনো বুঝতে পারিনি দোষটা আসলে কার। কী কারণ ছিল, বুঝে উঠতে পারলাম না। আমাদের অবস্থা আস্তে আস্তে খারাপ হতে লাগল। মা টিউশনি করে আমাদের খরচ চালাতেন। বাবা যে টাকা দিতেন, তা দিয়ে সংসার চলত না। আর অন্যদিকে বাবারও ব্যবসা-বাণিজ্য আস্তে আস্তে লোকসান হতে লাগল।

আমরা কোনো রকম খেয়ে না–খেয়ে দিন পার করতাম। পড়ালেখায়ও অনেক পিছিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ একদিন বাবা বললেন দেখা করবেন, ঘুরতে নিয়ে যাবেন আমাকে। খুশিতে বাবার কাছে চলে গেলাম। বাবা আমাকে নিয়ে মাকে না জানিয়ে চট্টগ্রামে আমার দাদুর বাড়িতে চলে আসেন। বলেন এখানেই আমার চাচির কাছে, দাদা–দাদির কাছে আমি থাকব, আর মায়ের কাছে যাওয়া যাবে না। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, আমার মায়ের কাছে থাকলে হয়তো আমরা ভালো থাকব না। আমরা থাকতাম ঢাকার ছোটখাটো একটা গলিতে। যেখানে থেকে শৃঙ্খল থাকা বড়ই দায়। আমি জানতাম, আমার বাবা আমাকে অনেক ভালোবাসেন। পুরো একটা দুনিয়ায় ছিলাম। কিন্তু খুব ছোট থাকতেই মাকে ছেড়ে এত দূরে এসে, তা–ও একা থাকাটা আমার জন্য ছিল খুবই কষ্টকর। তাদের কথা মনে পড়ত অনেক। খুব কান্না করতাম, চলে যেতে মন চাইতো। সবাই যখন আমাকে বুঝাল, তখন নিজের ভালোটা নিজেই বুঝতে শিখলাম। তখন মনে হতে লাগলো হ্যাঁ, এখানে তো আমি অনেক ভালোই আছি আগের তুলনায়। সবাই আমাকে অনেক আদর করছেন। তাই একটা পর্যায়ে সেটা সয়ে গেল আর আমি সবকিছু মেনে নিতে শুরু করলাম।

সৎমার সবকিছু মুখ বুঝে মেনে নিয়ে এখনো আছি, শুধু একটি কারণে, তাঁর কথামতো চলে দেখে হয়তো এখনো থাকতে পারছি। তা না হলে তো সেটাও কপালে জুটত না।

চট্টগ্রামে নতুন করে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হলাম। শুরু হলো জীবনের নতুন পথচলা। তার পর থেকে মা-বোন নানিকে আর কখনো দেখিনি। ঢাকায় বেড়াতে সবখানে গেলেও তাঁদের সঙ্গে দেখা হতো না। বাবা চাননি মায়ের সঙ্গে আমার দেখা হোক। কারণ, মায়ের সঙ্গে আমার দেখা হলে মা আমাকে বাবা সম্পর্কে আবার উল্টাপাল্টা কথা বলে আমার মন বিষাদময় করে তুলবেন। তাই তিনি চাইতেন না, আমি তাদের সঙ্গে দেখা করি। আমার আরেক বোনকেও তিনি নিয়ে আসতে চেয়েছিলেন চট্টগ্রামে, কিন্তু মা আসতে দেননি। বাবা অনেক ভালো মানুষ, কিন্তু তা মায়ের চোখে নন। তিনি বাবা সম্পর্কে অনেক উল্টাপাল্টা কথা বুঝাতেন। আর তাই বাবা পছন্দ করতেন না তাঁর সঙ্গে আমি দেখা করি। মা আসলে কখনো বুঝতেই চেষ্টা করেনি আমাকে। তিনি সব সময় ভাবতেন, আমার দাদার বাড়ির মানুষেরা আমার ক্ষতি করবেন। তাঁরও ক্ষতি কররেন, তাঁরা আমাদের দেখতে পারেন না। অথচ দাদার বাড়ির মানুষ মোটেও এ রকম নন। তাঁরা সংসারটা টিকিয়ে রাখার জন্য মাকে অনেক বুঝিয়েছিলেন। মা কখনোই বুঝতে চাইতেন না। তিনি কখনো চট্টগ্রামে আসবেন না বলেছিলেন। শুনেছিলাম মায়ের কাছে সন্তান নাকি অতুলনীয়। সন্তানের জন্য মা আগুনে ও ঝাঁপিয়ে পড়তে দ্বিধাবোধ করেন না। সে জায়গায় এ কেমন মা আমার যে আমাকে দেখতে আসেন না শুধু ইগোর কারণে। তার পর থেকেই বুঝে গেলাম মাও আমার আপন নন।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

দুই বছর পেরিয়ে গেল। সপ্তম শ্রেণিতে উঠলাম। হঠাৎ একদিন জানতে পারি, বাবা বিয়ে করেছেন। দাদার বাড়ির সবাই বাবার বিয়েতে ছিলেন। সবাই পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকা গিয়েছিলেন আমাকে রেখে। আমাকে বুঝতে দেননি সেদিন বাবার বিয়ে। তবে বাবা যাকে বিয়ে করেছিলেন, তাঁর সঙ্গে শর্তে হয়েছিল যেন সে আমাকে দেখে। সব জেনে–বুঝেই বাবাকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছিলেন। কিন্তু আমি সৎমায়ের কাছে থাকতাম না। তাঁরা ঢাকা থাকতেন। আমি দাদাবাড়িতে। আমার সঙ্গে ফোনে কথা বলতেন, ভালো ব্যবহারই করতেন, যত্ন নিতেন। তখন মনে হলো তিনি সত্যিই মনে হয় নিজের মেয়ের মতোই দেখেন, আমাকে মন থেকে মেনে নিয়েছেন। কিন্তু সেটা যে পুরোটাই লোক দেখানো, এটা বুঝতে দেরি হয়নি। সেটা আমি বুঝেছিলাম তাঁর সঙ্গে থাকার পর। আমাকে দেখতেই পারতেন না। শুধু বাবার কাছে শর্ত ছিল, সেই হিসেবে আমাকে না পারতে মেনে নিয়েছেন। এক বছর পর সেই ঘরেও আমার আরেকটি বোন হলো। আমি নিজের বোনের মতোই ভালোবাসতাম, আদর করতাম। কখনো সৎবোন মনে হয়নি। বাচ্চা হওয়ার পর সৎমা আস্তে আস্তে রূপ পরিবর্তন করে ফেলেন। তিনি আমাকে দিয়ে বাসার প্রায় সব কাজই করান। বাবার সামনে এক রূপ, আর বাবা চলে গেলে অন্য রূপ। সব বুঝে–শুনে ধৈর্য ধরে থেকে যেতাম; কারণ, আমার তো যাওয়ার কোনো জায়গা নেই। এর মধ্যে বাবা দেউলিয়া হয়ে একদম নিঃস্ব হয়ে গেছেন।পাওনাদারেরা টাকার জন্য ফোন করতে থাকেন। এ মুহূর্তে যদি বাবাকে সব বলি আরও দুশ্চিন্তা করবেন। তাই কখনোই জানাতাম না সৎমা বহুরূপী। তিনি নিজেকে বাবার সামনে এতটাই ভালোভাবে তুলে ধরতেন যে বাবা তাঁকে সরল মনের মানুষ মনে করতেন। উচ্চমাধ্যমিক পাস করে স্নাতক ডিগ্রির আশায় বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি হয়েছি।

এর মধ্যে তাঁর কাছ থেকেই একটা কথা শুনলাম। শুনেছি তাঁকে নাকি বাবা ভালোবেসে বিয়ে করেছেন, তাঁদের অনেক দিনের সম্পর্ক ছিল। এটা শোনার পর খুব রাগ–জেদ হয়ে ছিল বাবার ওপর। এক প্রতিবেশীর কাছ থেকে জানতে পারি, মায়ের সঙ্গে সম্পর্ক থাকা অবস্থায় নাকি এই নারী বাবার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। বাবা নাকি তাঁকে বলেনি, তিনি বিবাহিত। তাঁরা অনেক জায়গায় ঘুরতে যেতেন ও এ সময় মাকে ডিভোর্জ দেওয়ার পরিকল্পনা করেন বাবা। আমার মা বুঝতে পেরেছিলেন বলেই মনে হয় সেদিন সবাই এত বোঝানোর পরেও তাঁকে ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে সংসার করতে রাজি ছিলেন না। আমার মা সত্যিই অনেক বোকা ছিলেন। তাঁর কাছে কোনো প্রমাণ ছিল না, যদি থাকত, তাহলে বাবার মুখোশ সেদিনই তিনি খুলে দিতে পারতেন। এর পর থেকে বাবার প্রতি আমার ঘৃণা জন্মানো শুরু।

কয়েক বছর পর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার আগে জীবনে নতুন একজন মানুষ আসে, যাকে আমি ভালোবাসতে শুরু করি। মনে হতে লাগলো, হয়তো জীবনের পরিবর্তনটা কিছুটা হলো সৌভাগ্যের হবে। ফেসবুকে পরিচয়। ছবি দেখে প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। সেও আমাকে পছন্দ করত। কখনো দেখা হয়নি। শুধু চ্যাটিং আর ফোনে কথা হতো। সম্পর্কের মাস ছয়েক পরে সেই মানুষটাও ধোঁকা দিল। জানতে পারি, সে শুধু আমার সঙ্গে টাইম পাস করেছে। সে ছিল প্রতারক। তখন আমি প্রায়ই পাগল হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর আর ভয়ে কোনো সম্পর্কে জড়াইনি। কিন্তু মানুষের মন বলে কথা বিশ্বাস না করলেও অনেক সময় অনেক কিছু বিশ্বাস করতে হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠার পর হঠাৎ করে আরেকটা ছেলে আমার জীবনে এল। যদিও কখনোই প্রেম করার ইচ্ছা ছিল না। ঠিক আগের মতো ফেসবুকে পরিচয়, ফেসবুকে কথা, ফেসবুকেই দেখা। ভিডিওকলে আমাদের দেখা হয়। তাকে আমি আমার অতীত সম্পর্কে সব কথাই বলেছিলাম। ভেবেছিলাম, এই মানুষটার আমাকে কখনো কষ্ট দেবে না। ভরসার হাত হয়ে উঠবে। সে আমাকে নিজ থেকেই সব সময় মেসেজ দিতো, আমি প্রথমে পাত্তা দেইনি। কথা বলতে বলতে প্রেমে পড়ে যাই, না চাইতেও। তার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল এক বছরের। সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখতে অনেক চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কথায় আছে না, অভাগীর জন্য সব দরজায় বন্ধ। সেই মানুষটাও বেঈমানি করে। সব সময় চেয়েছিলাম শালীন থেকে ভালোবেসে পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে করব। কিন্তু তার মনে তো অন্য চিন্তা ছিল। সে কখনো আমাকে বিয়ে করত না। শুধু আমাকে ব্যবহার করে যেত। এই মানুষটাকে ভুলতে প্রায় এক বছর লেগে গেল।

আমি বেঁচে আছি সব যন্ত্রণা নিজের বুকে চেপে রেখে। আমার কি মন খারাপ হয় না, আমার কি কষ্ট লাগে না, আমার কি ইচ্ছে করে না অন্যদের মতো বাঁচতে, ভালো থাকতে। কিন্তু কিছু জিনিস ভাগ্যে থাকতে হয়।

সৎমার সবকিছু মুখ বুঝে মেনে নিয়ে এখনো আছি, শুধু একটি কারণে, তাঁর কথামতো চলে দেখে হয়তো এখনো থাকতে পারছি। তা না হলে তো সেটাও কপালে জুটত না। কারণ, নিজের মাও তো আমাকে ফোন দেন না। কোনো খোঁজ নেন না। শুধু নিজের স্বার্থের বেলায় ফোন দেন টাকার জন্য।

এ দিকে বাবা বেকার হয়ে বসে আছেন। নিজে চলার কোনো সাধ্য নাই সৎমার টাকায় চলে। তাই জোর খাটিয়ে কিছু বলার অধিকারও আর তাঁর নেই।

এখন জীবনের গতিটা উল্টো হয়ে গেছে আমার। এখন আর আপন বলতে কাউকেই মনে হয় না। নিজের মতো করে থাকতে বেশি পছন্দ করি। একা থাকতে ইচ্ছা করে। ইচ্ছা করে অনেক দূরে চলে যাই। যেখানে কেউ আমাকে চিনবে না, কাউকে চিনব না। একা নিজের মতো করে ভালো থাকতে পারব। আর কোনো মানুষকে বিশ্বাস করতে মন চায় না। আর কখনো প্রেম বা বিয়ে কোনোটাই করার ইচ্ছা নেই আমার। আমার জীবনের এতটুকু অব্দি সবকিছুই শুধু হারিয়েছি। মানুষ কেন এমন করে, বলেন তো। মানুষ কেন ভালোকে চিনতে–বুঝতে চাই না। ভালো সঙ্গে থাকতে চাই না, একটু বলবেন আমাকে।

আমার আর কারও প্রতি কোনো আস্থা, ভরসা, ভালোবাসা বিশ্বাস কিছু নেই। কারণ, নিষ্ঠুর এ পৃথিবীতে কেউ আপনার দায়িত্ব নিতে চাইবে না মন থেকে। যাঁদের আপনি আপনার দায়িত্বের অধিকারী বলে মনে করবেন, তাঁরাই দিনশেষে আপনার সঙ্গে বেইমানি করবেন। খুব সহজ–সরল, বোকা একটা মেয়ে ছিলাম আমি, তাই হয়তো আজ সবাই আমাকে এভাবে ঠকিয়ে ছেড়ে চলে গেল। সত্যি এ পৃথিবীতে আপন বলতে কেউ হয় না। আল্লাহ ছাড়া আপনার নিঃসঙ্গতার সঙ্গী আর কেউ হবে না।

জানি না, ভবিষ্যতে আল্লাহ ভাগ্যে আমার কী রেখেছেন। হয়তো জীবনসঙ্গী হিসেবে যদি জীবনে কেউ আসে, সে হয়তো বাকিদের মতো প্রতারক কি হবে। ছেড়ে চলে যাবে। আসলে মানুষ না ভালোর কদর করতে জানে না। কী দোষ করেছিলাম আমি, বলুন তো আপনারা।

*লেখক: শায়লা জান্নাত ফারিহা, শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই–মেইল অ্যাড্রেস [email protected]