কুর্দিদের নতুন বন্দোবস্ত নাকি মধ্যপ্রাচ্যে নতুন পরাশক্তির আগমন
সিরিয়ায় গত বছরের ডিসেম্বরে বাশার আল–আসাদের পতনের পর থেকে সিরিয়া ও তার প্রতিবেশী দেশগুলোর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বেশ পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। আসাদ পালিয়ে যাওয়ার পর সিরিয়ার ক্ষমতা গ্রহণ করেছেন আহমেদ আল-শারা। উল্লেখ্য, আল-শারা সিরিয়ার স্বৈরাচারী আসাদবিরোধী প্রধান বিদ্রোহী গোষ্ঠী এইচটিএসের প্রধান ছিলেন। তাঁর নেতৃত্বেই আরও কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠী আসাদ হটানোর চূড়ান্ত অভিযানে অংশ নিয়েছিল। তবে এ অভিযানে এইচটিএস, সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মিসহ বিদ্রোহী গোষ্ঠীদের ব্যাপক সহায়তা করেছে তুরস্কের রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান সরকার, যা আর গোপন নয়। তাইতো অনেক বিশ্লেষকের দাবি, তুরস্কপন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর প্রতি এরদোয়ানের সরাসরি সমর্থন ছিল বলেই ১৩ বছরের গৃহযুদ্ধের অবসান হয়েছে এবার।
সিরিয়ায় তুরস্কের এমন হস্তক্ষেপ যেমন মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বেশ রহস্যের সৃষ্টি করেছে, তেমনি তুরস্কের এমন হস্তক্ষেপের টার্গেট শুধু আসাদ ছিল এমনটাই নয়। বরং সিরিয়ার আরেক বিদ্রোহী কুর্দিগোষ্ঠী এসডিএফও ছিল তুরস্কের আরেক প্রতিপক্ষ। অন্য গোষ্ঠীগুলোর পাশাপাশি এসডিএফের কুর্দিযোদ্ধারা বাশার আল–আসাদের স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে বহু দিন গৃহযুদ্ধ করে সিরিয়ার শতকরা প্রায় ৩০ ভাগ অঞ্চল নিজেদের দখলে আনে। এসডিএফের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন ছিল প্রথম থেকেই। এসডিএফের এক লাখ কুর্দি সৈন্য ছিল এবং সিরিয়ার প্রায় ৬০ শতাংশ খনিজ সম্পদ তাদের অঞ্চলের আওতাভুক্ত ছিল। তবে এসডিএফের সঙ্গে অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সম্পর্ক ভালো ছিল না। বিশেষ করে তুরস্কপন্থী প্রধান দুই বিদ্রোহী গোষ্ঠী এইচটিএস ও সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মির সঙ্গে এ কুর্দিগোষ্ঠীর বিরোধ ছিল। এর প্রধান অন্তরায় ছিল তুরস্ক ও কুর্দিদের বিরোধ।
তুরস্কের বর্তমান শাসক এরদোয়ানের আমল ছাড়াও তুরস্কে ১৯৮৪ সাল থেকে কয়েকটি সশস্ত্র কুর্দিগোষ্ঠীর সংঘাত চলমান ছিল। ৩১ বছরের এ দীর্ঘ সংঘাতে ৪০ হাজারের মতো প্রাণহানিও ঘটেছে। এরদোয়ান বরাবরের মতো কুর্দিদের সংগঠন কুর্দিস্তান ওয়ার্কার্স পার্টি (পিকেকে) ও যুক্তরাষ্ট্র–সমর্থিত কুর্দিগোষ্ঠী দ্য পিপলস প্রটেকশন ইউনিটসকে (ওয়াইপিজে) এ সংঘাতের জন্য দায়ী করে থাকেন। তা ছাড়া সম্প্রতি তুরস্ক শাসিত কুর্দি অঞ্চলে বেশ কিছু বিস্ফোরণ ও বিচ্ছিন্ন সংঘাতের ঘটনায়ও পিকেকে সংগঠনকে দায়ী করা হয়। আর তাই সিরিয়ায় এরদোয়ানের চিন্তার আরেক কারণ ছিল বিদ্রোহী কুর্দি–অধ্যুষিত সিরিয়ান ডেমোক্রেটিক ফোর্সেস (এসডিএফ)। কারণ, এসডিএফকে অর্থায়ন ও অস্ত্রসহায়তা করায় পিকেকে ও ওয়াইপিজির বিরুদ্ধে তুরস্ক বেশ কয়েকবার আলামতসহ অভিযোগ তুললেও এসডিএফ বরাবরের মতো তা প্রত্যাখ্যান করেছিল। তবে এসডিএফের সঙ্গে পিকেকে ও ওয়াইপিজির সখ্য নতুন কিছু নয়। তাদের অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক যে বেশ মজবুত ছিল, তা কারোরই অজানা নয়। আসাদের বাহিনীকে হটিয়ে এসডিএফ নিজেদের দখলকৃত অঞ্চলে কয়েক বছর ধরেই স্বায়ত্তশাসন করছিল। যদিও আসাদের সঙ্গে তাদের গোপন সখ্য ছিল, এমন অভিযোগও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এমনকি কয়েক বছর আগে তুরস্কের দেওয়া সিরিয়া অভিযানের হুমকিতে এসডিএফ আসাদের স্বৈরাচারী সরকারের পক্ষে থাকার অবস্থানও সুস্পষ্ট করেছিল।
‘নাগরিক সংবাদ’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
এখন আসাদের পতনের পর প্রেক্ষাপট একদমই বদলে গেছে বলা যায়। আল–শারা ক্ষমতা গ্রহণের পরই নতুন করে সিরিয়ার রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ঢেলে সাজানো হচ্ছে। আসাদের পতনের পরপরই এসডিএফের কুর্দি শাসিত অঞ্চলে তুরস্কপন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো হামলা চালিয়ে কয়েকটি স্থান দখলে নেয়। তবে নতুন প্রেসিডেন্ট আল–শারার আদেশের পর কুর্দি নিয়ন্ত্রিত এ অঞ্চলে আগ্রাসন কয়েক দিনের মধ্যেই বন্ধ করে আসাদকে হটানো বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলো। উল্লেখ্য যে আসাদ হটানো চূড়ান্ত অভিযানে তুরস্কপন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে অংশ নেননি এসডিএফের কুর্দিযোদ্ধারা। তারপরও সিরিয়ার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান আল-শারা ‘ঐক্যবদ্ধ সিরিয়া’ গঠনে এসডিএফকে নতুন সরকারের অধীন আসার প্রস্তাব প্রদান করেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে এ বছরের মার্চ মাসে এসডিএফের শীর্ষস্থানীয় নেতৃত্বের সঙ্গে সিরিয়ার বর্তমান সরকারের চুক্তি হয়। ফলে, এসডিএফ বর্তমান সরকারের অধীন এসে পড়ে এবং তুরস্কপন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে তাদের এত দিনের বিরোধের অবসান হয়। তা ছাড়া এ চুক্তির ফলে এসডিএফের আওতাধীন এক লাখ সৈন্যকে বিলুপ্ত করে সিরিয়ার নতুন সরকারের নিরাপত্তা বাহিনীতে যুক্ত করা হয়। ফলে বৃহৎ ঐক্যবদ্ধ সিরিয়ার স্বপ্নের দিকে এগোতে থাকে আল-শারার অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তুরস্কের সঙ্গেও এবার ধীরে ধীরে দূরত্ব ঘুচতে থাকে এসডিএফ কুর্দিগোষ্ঠীর। এ ছাড়া এ চুক্তির মাধ্যমে আসাদের পতনের পর সিরিয়ায় এসডিএফের আওতাধীন কুর্দিদের অঞ্চলে তুরস্ক সেনাবাহিনীর অভিযানের যে সম্ভাবনা ছিল, সেটাও আপাতত শেষ হয়ে গেছে। আল-শারা প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই এরদোয়ানের তুরস্ক সরকার সব ধরনের সহায়তা করে যাচ্ছে সিরিয়ার নতুন সরকারকে। সিরিয়ার নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের ভিত্তি তুরস্কই গড়ে দিচ্ছে বলা যায়। বিশ্লেষকদের মতে, আল-শারা তুরস্কপন্থী বিদ্রোহী গোষ্ঠী এইচটিএসের প্রধান হওয়াতেই এরদোয়ানের সিরিয়া পরিকল্পনা সফল হয়েছে।
এদিকে সম্প্রতি তুরস্কে থাকা সশস্ত্র কুর্দিগোষ্ঠী পিকেকে সাফ জানিয়ে দিয়েছে, তারা তুরস্কের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে আর কোনো সংঘাতে জড়াবে না। ফলে আপাতদৃষ্টিতে বলা যায়, এভাবেই ৩১ বছরের তুরস্ক বনাম কুর্দি সংঘাতের অবসান হয়েছে। কয়েক দিন আগেও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সিরিয়ার ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেন তাঁর সৌদি আরব সফরে। এখানেও সিরিয়া পুনর্গঠনে এরদোয়ানের ভূমিকার কথা যেমন জোরালোভাবে উচ্চারিত হচ্ছে, তেমনি ট্রাম্প প্রশাসনও এরদোয়ানের প্রতি আস্থাশীল আছে বলে লক্ষ করা যাচ্ছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ ইস্যুতে এত বছর সৌদি নেতৃত্বাধীন আরব জোট তেমন হস্তক্ষেপ না করলেও তুরস্কের এক ঢিলে দুই পাখি মারার প্রবাদ (আসাদ হটানো ও কুর্দিদের বন্দোবস্ত করা) মধ্যপ্রাচ্যে বেশ বড় রাজনৈতিক পরিবর্তন এনেছে বলা যায়। তাইতো দূরদৃষ্টি হিসেবে বলা যায়, তুরস্কের সিরিয়া সমস্যার সমাধান যেন মধ্যপ্রাচ্যের নতুন শক্তির আবির্ভাব ঘটিয়েছে।
*লেখক: তাওহীদ জানান অভিক, শিক্ষার্থী, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়