শিক্ষা ও রেলকেন্দ্রিক আর্থসামাজিক উন্নয়ন যেভাবে হতে পারে
২ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটে যশোর থেকে ঢাকায় যাওয়া এখন স্বপ্ন নয়, বাস্তবে রূপ নিয়েছে। একসময় ৭ থেকে ৮ ঘণ্টার পথ পাড়ি, সঙ্গে বাড়তি ঝামেলা হিসেবে ফেরিঘাটের দুর্ভোগ নিয়ে যশোর–খুলনা অঞ্চলের মানুষ ঢাকায় যাতায়াত করতেন। কিন্তু পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকা-বেনাপোল ও ঢাকা- খুলনার মধ্যে রেল যোগাযোগ সময় ও অর্থের অপচয় কমিয়েছে। তবে অপরিকল্পনা ও দুর্নীতি এই মেগা প্রকল্পকে নানা সমালোচনার মুখোমুখি করেছিল। তারপরও নানা চড়াই-উতরাই পেরিয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলেও এখন মাত্র একটি ট্রেন দিয়ে ঢাকা থেকে খুলনা ও বেনাপোলের মধ্যে যাত্রী পরিবহন করা হচ্ছে। কিন্তু সঠিক পরিকল্পনার অভাবে কৃষি ও ব্যবসা–বাণিজ্যের সম্প্রসারণ এবং শিক্ষা ও পর্যটনশিল্পের ক্ষেত্রে অবদান রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে প্রকল্পটি। মাত্র একটি ট্রেন দিয়ে যাত্রী পরিবহনেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। কারণ, পাশ্ববর্তী জেলা ঝিনাইদহের মোবারকগঞ্জ ও কোটচাঁদপুর, চুয়াডাঙ্গার দর্শনা এবং বাগেরহাটের মংলা রুটে কোনো ট্রেন রাখা হয়নি। এ কারণে একটি হযবরল অবস্থার মধ্য দিয়ে সবকিছু চলছে। সঠিক পরিকল্পনার অভাব এ অঞ্চলের সামগ্রিক উন্নয়নকে ব্যাহত করছে।
খুলনা ও যশোরের উন্নয়নে কী ধরনের উদ্যোগ নিতে হবে
পদ্মা সেতু হয়ে সড়ক ও রেল যোগাযোগ স্থাপন হওয়ায় আগের থেকে স্বল্প সময়ে ঢাকায় যাতায়াতের সঙ্গে চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ ও সিলেট অঞ্চলের যাতায়াতব্যবস্থায় সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। ফলে সারা দেশে সড়ক যোগাযোগের সঙ্গে রেল যোগাযোগ স্থাপনের উদ্যোগ নিতে হবে। খুলনা ও যশোরে ছোট–বড় শিল্পকারখানা স্থাপন ও পুরোনোগুলো চালু করতে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। যশোরে পল্লী উন্নয়ন একাডেমি ও ইপিজেড, মহেশপুরের দত্তনগরে কৃষি ইপিজেড, গদখালীতে ফুল উন্নয়ন ও গবেষণাকেন্দ্র, মোবারকগঞ্জ চিনিকল লাভজনককরণ ও গবেষণাকেন্দ্র এবং কৃষি, মাছ চাষ ও পশুপালন বৃদ্ধিতে তরুণদের উৎসাহ দিতে প্রশিক্ষণ, ঋণের ব্যবস্থা করাসহ সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। খুলনার সুন্দরবন, বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ, যশোরের কেশবপুরের মধুপল্লি, গদখালীর ফুলের রাজ্য, ঝাপা বাঁওড়, ঝুলন্ত সেতুসহ পর্যটনকেন্দ্রগুলো পর্যেটকদের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলতে হবে। মংলা, বেনাপোল ও দর্শনা বন্দরের সক্ষমতা বাড়াতে অবকাঠামো উন্নয়ন এবং দৌলতগঞ্জে স্থলবন্দর চালুর ব্যবস্থা করতে হবে, যার মাধ্যমে বৈদেশিক বাণিজ্যের বিস্তার ঘটবে। এ অঞ্চলে সামগ্রিক উন্নয়ন ও শিক্ষা–সংস্কৃতি বিস্তারে মাইকেল মধুসূদন দত্তর নামে একটি সংস্কৃতি বিশ্ববিদ্যালয় ও দত্তনগরে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করতে হবে। চালু করতে হবে কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ–সম্পর্কিত বিভিন্ন গবেষণা ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র। খুলনায় পর্যটন ও প্রত্নতত্ত্ব গবেষণাকেন্দ্র নির্মাণ করতে হবে। সাতক্ষীরায় মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও মৎস্যকেন্দ্রিক কর্মসংস্থান সৃষ্টির সহায়তা প্রদানে গবেষণাগার ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র তৈরি করতে হবে, যেখানে পাঠদানের সঙ্গে এ অঞ্চলের উন্নয়নে সব ধরনের গবেষণাগত সহায়তা প্রদান করবে এবং দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে।
রেল কীভাবে ভূমিকা রাখবে
আমরা জানি, রেল যোগাযোগ তুলনামূলক আরামদায়ক ও নিরাপদ। ফলে পরিকল্পিতভাবে রেল যোগাযোগের ব্যবস্থা করা হলে যাত্রী ও কৃষিপণ্য পরিবহন, বৈদেশিক বাণিজ্য ও শিল্পকারখানায় ব্যাপক উন্নয়ন করা সম্ভব, যা মানুষের কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। ইপিজেডে দেশ–বিদেশের কোম্পানিগুলো তাদের কারখানা তৈরি করবে। কারণ, যোগাযোগব্যবস্থা উন্নত হলে সহজেই শিল্পকারখানা স্থাপন করতে কোম্পানিগুলোকে আগ্রহী করা যাবে। এখানে শ্রমিক সহজলভ্যতা এবং সড়ক, রেল ও বিমান যোগাযোগের ব্যবস্থা থাকায় সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগোলে সাফল্য পাওয়া সম্ভব। যশোর ফুল ও সবজির জন্য বিখ্যাত। ফলে গদখালীর ফুল ও টাটকা সবজি দেশ–বিদেশে সহজেই পৌঁছে দেওয়া যাবে। এতে কৃষিপণ্য, তথা শাকসবজি-ফলমূল ব্যবসার প্রসার ঘটবে। কলকারখানা স্থাপন করে দ্রুতই অন্য বড় শহর ও বাণিজ্যিক কেন্দ্রের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন ও বহু মানুষের কর্মের ব্যবস্থা করা যাবে। পণ্যের চাহিদা বিবেচনায় ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়ন সাপেক্ষে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প, ছোট–বড় কৃষি ফার্ম ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠবে। মানুষের ঢাকামুখী প্রবণতা কমে যাবে এবং নিজ শহর বা এলাকায় থেকে কর্মের ব্যবস্থা করতে পারবে। পর্যটনশিল্পের বিকাশ ঘটবে। ঢাকা থেকে খুলানা ও মংলায় দ্রুত সময়ে যাতায়াতের সুযোগ থাকায় সুন্দরবনে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যটকদের আনাগোনা বৃদ্ধি পাবে। এ ছাড়া অন্যান্য ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক স্থানে পর্যটনকেন্দ্র নির্মাণ করা যাবে। দেশ–বিদেশের শিক্ষার্থীরা সহজেই এ অঞ্চলের বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার পাশাপাশি দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরিত হবেন। খুলনা ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের উৎপাদিত সামুদ্রিক ও মিঠাপানির মাছ সহজেই দেশ–বিদেশে রপ্তানি করা যাবে, যেখানে রেলপথ সেতুবন্ধ হিসেবে কাজ করবে। অন্যদিকে যশোর থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করে দিতে হবে। এতে সড়ক যোগাযোগেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে।
রেল নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও জীবনমানের উন্নয়ন
এখন মাত্র একটি ট্রেন চলাচল করায় কাঙ্ক্ষিত সেবা পাওয়া যাচ্ছে না। এ কারণে ট্রেনের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। পদ্ম সেতু হয়ে খুলনা, মংলা, বেনাপোল ও দর্শনা থেকে ঢাকার মধ্যে দুটি করে ট্রেন চলাচলের উদ্যোগ নিতে হবে। প্রতিটি ট্রেনে পণ্য পরিবহনের জন্য আলাদা বগি সংযোজন করতে হবে। প্রয়োজনে পণ্য পরিবহনের জন্য আলাদা ট্রেনের ব্যবস্থা করতে হবে এবং স্টেশন পর্যন্ত পণ্য পরিবহনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। প্রতিটি রুট থেকে ঢাকাগামী লোকাল ট্রেনের ব্যবস্থা রাখা ও গতি বৃদ্ধি করতে হবে। যশোর থেকে চৌগাছা মহেশপুর হয়ে দর্শনা, মাগুরা থেকে ঝিনাইদহ হয়ে মোবারকগঞ্জ এবং যশোর থেকে সাতক্ষীরা পর্যন্ত নতুন রেলপথ নির্মাণ করতে হবে। এর ফলে রেল নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ এবং কাঙ্ক্ষিত সেবা দেওয়া সম্ভব হবে। এ ছাড়া সপ্তাহে এক দিন বা সুবিধাজনক দিনে এখান থেকে কক্সবাজার, সিলেট ও ময়মনসিংহ রুটে ট্রেন চলাচলের বাস্তবধর্মী উদ্যোগ নিতে হবে। দর্শনা থেকে খুলনা পর্যন্ত ডাবল রেললাইন তৈরি এবং চুয়াডাঙ্গা থেকে খুলনা ও মংলার মধ্যে কমিউটার ট্রেনের ব্যবস্থা করতে হবে। জরাজীর্ণ ও পুরোনো স্টেশন চালু করে লোকাল ট্রেনের মাধ্যমে এ অঞ্চলের আন্তজেলা যোগাযোগ ও ব্যবসা–বাণিজ্য রেলকেন্দ্রিক করে দিতে হবে। পণ্যের গুণগত মান ঠিক রাখতে গুদাম ও কোল্ড স্টোরেজ নির্মাণ, ট্রেনের ভাড়া কমানো, ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরিসহ সব ধরনের সুযোগ–সুবিধা প্রদান করতে হবে। এতে ট্রেন যেমন লাভজনক হবে, তেমনি বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে।
একটা অঞ্চলের সামগ্রিক উন্নয়নে শিক্ষা ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারণ, এখানে গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞান সৃষ্টি ও দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করা হয়। খুলনা, যশোরসহ পার্শ্ববর্তী এলাকার উন্নয়ন করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও প্রশিক্ষণকেন্দ্রের গুরুত্ব বিবেচনায় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন এবং গবেষণাকেন্দ্র ও ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে শিক্ষা ও দক্ষতা, উদ্ভাবনী শক্তির বৃদ্ধি এবং উদ্যোক্তা হওয়ার মনোভাব তৈরিতে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কৃষি উদ্যোক্তা তৈরিতে যথাযথ প্রশিক্ষণ ও ঋণের ব্যবস্থা করে দিলে একজন উদ্যোক্তা সহজেই নিজের উৎপাদিত পণ্য দেশ–বিদেশে বিক্রি করতে পারবেন, যেখানে রেলপথ হবে যোগাযোগের মাধ্যম, যা অল্প খরচের ও নিরাপদের। আবার বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে কৃষি, মৎস্য, প্রকৌশল ও পোশাকশিল্প–সম্পর্কিত বিষয় পাঠদানের মাধ্যমে এখানে কৃষি ও পোশাকশিল্পের বিপ্লব ঘটানো সম্ভব। একই সঙ্গে ট্রেনিং ইনস্টিটিউগুলো সব বিষয়ে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরি করবে, যেটি এখানকার শিল্পকারখানা স্থাপন ও ব্যবসা–বাণিজ্যের সম্প্রসারণে সহায়তা করবে এবং উৎপাদিত পণ্য ও সেবা সহজেই মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়া যাবে।
এভাবে মানুষ যখন উদ্যোক্তা বা চাকরির মাধ্যমে কাজের ব্যবস্থা করতে পারবে, তখন তাদের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। কারণ, সঠিক পরিকল্পনা এখানে শিক্ষিত ও দক্ষ জনশক্তি বৃদ্ধি, কৃষি ও পর্যটন এবং ছোট–বড় শিল্পকারখানার বিকাশ ঘটাবে। ফলে বলা যায়, শিক্ষা ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান এবং যোগাযোগে রেলপথ এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে এ অঞ্চলের সামগ্রিক উন্নয়নে।
মো. শাহিন রেজা, প্রাক্তন শিক্ষার্থী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।