রাজকুমার ও একটি ক্যামেলিয়ার গল্প

গোলাম রব্বানী কিবরিয়া ও রাজকুমার

সম্প্রতি গিয়েছিলাম শ্রীমঙ্গলে। শীতের আমেজ তখনো পুরোপুরি যায়নি বলা চলে। দেশের অন্যতম বৃষ্টিপাতের শহর বলেই হোক অথবা নিবিড় সবুজের ডেরা বলেই হোক শ্রীমঙ্গলের আবহাওয়া তখনো বেশ ঠান্ডা। এমনই এক ভীষণ প্রত্যুষে বেরিয়ে পড়লাম এক চা–বাগানে, বাগানটি শ্রীমঙ্গল শহর থেকে বলা চলে বেশ অনেকটাই দূরে, তার ওপর খুব সকাল হওয়ায় মানুষের আনাগোনা চোখে পড়ছে না। আর চা–বাগান তখন একেবারেই ফাঁকা।

হাঁটতে হাঁটতে দেখা পেলাম এক বিস্ময়কর চরিত্রের। ঢাকার ব্যস্ত আর যান্ত্রিক আবহে যার সংস্পর্শ সদ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া আমি ও আমার বন্ধুদের জন্য কল্পনা করাও অসম্ভব ছিল। ভদ্রলোকের নাম রাজকুমার। তাঁর ভাষ্যমতে জাতিতে ভোজপুরী। বহু বছর আগে ব্রিটিশ গোরা সাহেবরা পাহাড় ডিঙিয়ে এনেছিলেন বিহার অথবা উড়িষ্যা অঞ্চল থেকে। শ্রীমঙ্গলের একজন চা–শ্রমিক তিনি। চা–শ্রমিকদের দুর্দশার গল্প–ইতিহাস আবার বলতে চাই না, তা আপনারা সবাই কমবেশি জানেন।

তবে বলি অন্য কথা।

অনেক কথা হলো রাজকুমারের সঙ্গে। প্রাণ খুলে কথা বললেন। খুব ভোরে গিয়েছিলাম চা–বাগানে, একা পেয়ে অনেক কথাই শোনালেন। কণ্ঠে ঝরে পড়ছিল শত বছরের শৃঙ্খলের গল্প।

কথায় কথায় জানালেন সকালে খেয়েছেন কেবল কচি চা–পাতার সঙ্গে মরিচ ডলে। আর সঙ্গে রেশনে পাওয়া সামান্য আটার রুটি। সে আটাও এসেছে বহু হিসাব–নিকাশের পথ পেরিয়ে। ঘরে বৃদ্ধা মা আছেন, ছোট কয়েকটা ছেলেমেয়ে, সবার নিত্য আহার্য বস্তুর প্রধানতম উপকরণই যে এই চা–পাতার রকমফের পদ, তা বুঝে গেছি ততক্ষণে।

৮০, ৮৫ বছর বয়সী একেকটা চা–গাছ দেখালেন। এ সময়ের মধ্যে ঘটে গেছে একটা মহাযুদ্ধ, দেশভাগ, স্বাধীনতাযুদ্ধ আর কত সহস্র সকাল, দুপুর ও অবসন্ন বিকেল। তবু অসার মাটি আঁকড়ে বসে আছেন রাজকুমার। প্রভূত অর্থ, বিত্ত ও বৈষয়িক উন্নতি যার কাছে খুব সামান্য। খুবই আশ্চর্য হলাম তাঁর অর্থের প্রতি নির্মোহ ভাবনা দেখে।

রাজকুমার যেন এই বহুবর্ষী চা–গাছগুলো ভিন্ন কিছু নন। শ্রীমঙ্গলের একটা চা–বাগানে সারা জীবন কাটিয়ে দিলেও তাঁর জীবনে আজ অবধি দেখেননি জেলা শহর মৌলভীবাজার। শুনেছেন ঢাকার কথা, সে নাকি এক মস্ত শহর। আর পাশ্চাত্যের অভিজাত আলোঝলমলে সন্ধ্যার খবর পেয়েছিলেন সাদা সাহেবদের কল্যাণে। পুরো জীবন এভাবে, এখানেই কাটাবেন রাজকুমার।

গোত্রের বাইরে বিয়ের নিয়ম নেই রাজকুমারদের। আরও বহু শর্তের জাল ছিঁড়ে চা–বাগান থেকে বের হওয়ার কোনো সুযোগ নেই তাঁদের। প্রয়োজনও হয়তো ছিল না। কিন্তু এই পাষণ্ড যুগ কি ভালো রেখেছে তাঁদের? সে প্রশ্নের মীমাংসা হয়নি।

চলে আসার সময় তাঁর হাতে কিছু অর্থ দিতে চাইলাম। যদিও সংকোচ হচ্ছিল খুব। কিন্তু তাঁর আত্মসম্মান আমাকে আবারও আশ্চর্য করল। কোনোভাবেই নেবেন না সে অর্থ। বোঝালেন নিজের জন্য যা নির্ধারিত, তা নিয়েই তিনি বেশ আছেন। ভাবলাম, সত্যি রাজকুমারই বটে।
এত যে দুঃখের গল্প বললেন রাজকুমার, তাতে ছিল না কোনো খেদ কিংবা ক্ষোভ; বরং হাতে ছিল সুগন্ধি ক্যামেলিয়া।

*লেখক: গোলাম রব্বানী কিবরিয়া

**নাগরিক সংবাদে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]