জুলাই বিপ্লবের গ্রাফিতি: সংরক্ষণ জরুরি
বাংলাদেশে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান ও এর পরবর্তী দেয়ালের গ্রাফিতি ও বাণী মানুষের চিন্তার জগতে নিঃসন্দেহে বড় প্রভাব ফেলেছে। গ্রাফিতি হলো জনসাধারণের অভিমতে শৈল্পিক উপায়ে দেয়ালে লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরা। তবে গ্রাফিতি যখন সমাজ পরিবর্তনের আহ্বান করে, তখন তা কেবল একটি শিল্পকর্ম থাকে না, তখন এটি হয়ে ওঠে একটি পরিবর্তনের মূর্ত প্রতীক। যুগে যুগে গ্রাফিতি আন্দোলন-সংগ্রামকে বেগবান করে তুলতে সক্ষম হয়েছে। এসব গ্রাফিতি সমাজে সাময়িক আতঙ্কের সৃষ্টি করলেও রাষ্ট্রগঠনে ইতিবাচক ভূমিকাই পালন করে থাকে। সম্প্রতি (জুলাই ২০২৪) বাংলাদেশে ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের পর ‘বুকের ভিতর দারুণ ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’, ‘পানি লাগবে পানি’, ‘আমিই বাংলাদেশ’, এ রকম স্লোগানে চিত্রসহ ভেসে ওঠে শহরের প্রায় প্রতিটি দেয়াল। এসব গ্রাফিতিতে ফুটে উঠেছে স্বাধীনতার কথা, স্বাধিকারের কথা, রাষ্ট্র সংস্কারের কথা, ফ্যাসিস্ট ও দুর্নীতিবাজদের রুখে দেওয়ার কথা।
গ্রাফিতি ইটালিয়ান শব্দ, যার অর্থ খচিত। গ্রাফিতি শব্দটি শিলালিপি, ছবি আঁকা এবং এ ধরনের শিল্পকেই বোঝায়। প্রাচীন সমাধি বা ধ্বংসাবশেষের দেয়ালে এই গ্রাফিতি খুঁজে পাওয়া যায়। গ্রাফিতি হচ্ছে দেয়ালে বা যেকোনো সারফেসে আঁকা কোনো চিত্র, যার বিষয়বস্তু থাকবে সহজ ও একমুখী; কিন্তু বোধটা থাকবে জোরালো, যা মানুষকে নাড়া দেয়। মানুষকে সহজেই আলোড়িত করে; অর্থাৎ মানবমনকে আন্দোলিত করার একটি শক্তিশালী উপায় হলো গ্রাফিতি। গ্রাফিতির সংজ্ঞায় বলা হয়, বিনা অনুমতিতে জনসাধারণের অভিমতে শৈল্পিক উপায়ে দেয়ালের ওপর লেখনীর মাধ্যমে তুলে ধরা। এনসাইক্লোপেডিয়া ব্রিটেনিকা বলছে, গ্রাফিতি হচ্ছে ভিজ্যুয়াল যোগাযোগের ফর্ম। অনেকের কাছে গ্রাফিতি হলো পাবলিক আর্টের একটি রূপ, যা ঐতিহ্যকে অব্যাহত রাখে। আবার গ্রাফিতিকে বেশ বিদ্রোহী এক শিল্পমাধ্যম হিসেবে ধরা যেতে পারে, যার মূল লক্ষ্য হলো মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করা। দেশে দেশে সামাজিক অবিচার, সমসাময়িক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বা যুদ্ধের বিরুদ্ধে শিল্পীরা গ্রাফিতির মাধ্যমে তাঁদের বার্তা সমাজে পৌঁছে দিয়ে থাকেন।
যুগে যুগে গ্রাফিতি আন্দোলন-সংগ্রামকে বেগবান করে তুলতে সক্ষম হয়েছে। বর্তমান বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রতিরোধ আন্দোলনগুলোতে দেয়ালে দেয়ালে গ্রাফিতি লিখন অন্যতম অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে। সমাজের অন্যায়, অবিচার আর রাষ্ট্রের নিপীড়নের বিরুদ্ধে গ্রাফিতি যেন এক সৃষ্টিশীল প্রতিবাদের ভাষা। প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে সারা পৃথিবীতেই গ্রাফিতি নির্যাতিত ও অধিকার বঞ্চিত মানুষের কাছে সমাদৃত। তাই দেওয়ালে গ্রাফিতি আঁকা বড় থেকে ছোট বিভিন্ন অন্যায়ের প্রতিবাদে সুস্থধারার আন্দোলনের একটি স্বীকৃত পদ্ধতি হিসেবেই মনে করা হয়। বাংলাদেশে জুলাই বিপ্লবেও ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থান গ্রাফিতিশিল্পে ভিন্ন দ্যোতনা এনে দিয়েছে। এসব গ্রাফিতিতে ছাত্র আন্দোলনে শহীদদের প্রতিকৃতি ও তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধার পাশাপাশি উঠে এসেছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা, উচ্চারিত হয়েছে সমাজ ও রাষ্ট্রে সমতার বাণী, শোষণের কথা, বাক্স্বাধীনতার কথা, মাথা নত না করার প্রত্যয়, বাঙালি ও পাহাড়িদের সম–অধিকার থেকে শুরু করে সব অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ আর প্রতিরোধের অগ্নিময় উক্তি ও সাহসী চিত্রায়ণ। সীমানাপ্রাচীরগুলো হয়ে ওঠে প্রতিবাদ, সাম্য, অসাম্প্রদায়িক, বিপ্লব ও ভ্রাতৃত্ববোধের অভূতপূর্ব নিদর্শন।
গ্রাফিতির ইতিহাস বহু পুরোনো। অনুমান করা হয়, মানুষ গ্রাফিতি প্রথম অঙ্কন করা হয়েছিল গুহার দেয়ালে পশুর হাড় দিয়ে খোদাই করে। মানবসভ্যতার বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে গ্রাফিতিও বিকশিত হয়েছে, বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমান অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ চিত্রকর্ম থেকে গ্রাফিতি হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের ভাষা। প্রাচীন গ্রিস ও রোমান সাম্রাজ্যের সময় থেকে মূলত এই গ্রাফিতির প্রচলন ভালো করে শুরু হয়। ইতালির রোম ও পম্পেই নগরীর সমাধিসৌধের দেয়াল ও ধ্বংসাবশেষে গ্রাফিতির অস্তিত্বের প্রমাণ মিলেছে বলে ইতিহাসবিদদের ধারণা। দক্ষিণ সিরিয়া, পূর্ব জর্ডান ও উত্তর সৌদি আরবে শিলা ও পাথরের ওপর কিছু লেখা পাওয়া গেছে স্যাফাইটিক ভাষায়। ধারণা করা হয়, এই স্যাফাইটিক ভাষার উৎপত্তি গ্রাফিতি থেকে। প্রাচীন গ্রিক নগরী এফেসাসেই আধুনিক গ্রাফিতির উদ্ভব এবং সেখানে গ্রাফিতি বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হতো। বর্তমান সমাজের চেয়ে প্রাচীন সমাজের গ্রাফিতিগুলো অধিক অর্থপূর্ণ এবং ভিন্ন ভিন্ন ধারায় বহমান ছিল। প্রাচীন গ্রাফিতিগুলোতে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ, সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ঘটত। তবে গ্রাফিতি বিংশ শতকের শেষের দিকে নিউইয়র্ক সিটিতে অধিক পরিচিতি লাভ করে। অতীতেও গ্রাফিতির মাধ্যমে প্রতিরোধ আন্দোলনের নজির পাওয়া গেছে। যেমন দিল্লির ধর্ষণবিরোধী আন্দোলন, অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন, ইসরাইলবিরোধী আন্দোলন কিংবা সম্প্রতি কলকাতার যাদবপুরে শিক্ষার্থী নিগ্রহের প্রতিবাদে ‘হোক কলরব’ আন্দোলনেও ছিল গ্রাফিতির জোরাল উপস্থাপনা। এ রকম গ্রাফিতি সমাজে সাময়িক আতঙ্কের সৃষ্টি করলেও ইতিবাচক ভূমিকাই পালন করে থাকে। বহির্বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশেও গ্রাফিতি অঙ্কনের মধ্য দিয়ে প্রতিরোধ আন্দোলন ও জনমনে ঘটনার সত্যটা বোঝানোর প্রয়াস চলে আসছে। বাংলদেশে গ্রাফিতি নতুন নয়। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে শুরু করে পরবর্তী সময়ে যেকোনো আন্দোলনে পোস্টার, দেয়াললিখনের মতো বর্তমান সময়ে গ্রাফিতি হয়ে উঠেছে আন্দোলনের অন্যতম অনুষঙ্গ। দেয়ালে চিকা মারার পাশাপাশি বাংলাদেশেও গ্রাফিতি কিছু কিছু চোখে পড়ে। নব্বইয়ের দশকে, বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় ‘কষ্টে আছি আইজুদ্দিন’ দেয়াললিখনটি বেশ নজর কেড়েছিল। পরের দশকে আরেকটি দেয়াললিখন ‘অপেক্ষায় নাজির’ দেখা গিয়েছিল। তখনকার রাজনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে মিলিয়ে অনেকে এগুলোকে ব্যাখ্যা করতেন। আবার ২০১৭ সালের দিকে আলোচনায় আসে সুবোধের গ্রাফিতি। বিশেষ করে আগারগাঁও ও মিরপুরের কয়েকটি দেয়ালে ‘সুবোধ তুই পালিয়ে যা, এখন সময় পক্ষে না’-এর গ্রাফিতি মানুষের নজরে আসে। জুলাই বিপ্লবের পর এসব গ্রাফিতি অঙ্কনের পুনরাবৃত্তি শুরু হয়। তবে পটভূমি অনুযায়ী গ্রাফিতিগুলো সমসাময়িক দুঃসাহসিকতার বার্তা বহন করে চলেছে বলে অনেকেই তা সমর্থন দিয়েছেন।
গ্রাফিতিতে উঠে আসে সমাজের সমসাময়িক বিশৃঙ্খলার এক ব্যঙ্গাত্মক রূপ, যা চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয় কোন অবস্থায় বাস করছ তুমি, কী তোমার পরিণতি, কিসে তোমার পরিত্রাণ। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পক্ষ থেকে ২৯ জুলাই প্রথম সারা দেশে গ্রাফিতি কর্মসূচি দেওয়া হয়। স্কুল, মাদ্রাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেয়াললিখন আর গ্রাফিতির কাজ শুরু করে। নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে তারা এ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে। বাংলা, ইংরেজি ও আরবি ক্যালিগ্রাফিতে করা এসব গ্রাফিতি সড়কে এনেছে নান্দনিকতা। গ্রাফিতিগুলোর বক্তব্যে প্রধানত ধরা পড়েছে পরিবর্তনেরই আকাঙ্ক্ষা। পাশাপাশি আছে তীব্র স্বৈরাচারবিরোধী আবেগ-অনুভূতি। আছে স্বাধীনতার অনুভূতি। জুলাই বিপ্লবের গ্রাফিতিতে মূলত অভ্যুত্থানে প্রাণ হারানো ছাত্র-জনতার প্রতিকৃতি ও তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধার পাশাপাশি উঠে এসেছে সাম্প্রদায়িক সম্প্রতি, সমাজের-রাষ্ট্রের সংস্কারের দাবি, ঘুষ-দুর্নীতি বন্ধ করা, স্বৈরতন্ত্রের অবসান, বাক্স্বাধীনতা, সম-অধিকার থেকে শুরু করে সব রকমের অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ আর প্রতিরোধের অগ্নিময় উক্তি। এসেছে বহু কালজয়ী গান ও কবিতার পঙ্ক্তি। আছে নবীনদের নতুন বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্নের কথাও। জুলাই বিপ্লবের গ্রাফিতিগুলো বিশ্লেষণ করলে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো নজরে আসে।
রাজনীতি: গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস্টটলের মতে, মানুষ একাধারে সামাজিক ও রাজনৈতিক জীব। জুলাই বিপ্লবের গ্রাফিতির বক্তব্যে যে রাজনৈতিকতা ফুটে ওঠে, তার তাৎপর্য অপরিসীম। যেমন ‘অপরাজনীতি রুখে দাও’, ‘বুকের ভিতর দারুণ ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’, ‘বায়ান্ন দেখিনি চব্বিশ দেখেছি’, ‘তুমি কে আমি কে, বিকল্প বিকল্প’, ‘দেশটা কারো বাপের না’, ‘এখন দরকার জনতার সরকার’, ‘চলো রাষ্ট্র সংস্কার করি’, ‘তুমি কে আমি কে, রাজাকার! রাজাকার! কে বলেছে, কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার’ ইত্যাদি।
স্বাধীনতা ও দেশপ্রেম: দেশপ্রেম যেকোনো দেশ বা জাতির জন্য অন্যতম উপাদান। নবীন প্রজন্মের দেশপ্রেম প্রকাশের এক অনন্য নজির এই গ্রাফিতি। যেমন ‘স্বাধীনতার সূর্যোদয়, ৩৬শে জুলাই’, ‘আমিই বাংলাদেশ’, ‘দেশ গড়ব করছি পণ, ক্ষমতায় আজ জনগণ’, ‘লাখো শহীদের রক্তে কেনা দেশটা কারো বাপের না’, ‘স্বাধীনতা এনেছি স্বাধিকার আনব’, ‘স্বাধীন হয়েছি এবার সভ্য হই’, ‘স্বাধীনতা এনেছি সংস্কারও আনব’, ‘সত্যের জন্য শহীদ যাঁরা’, ‘ব্লাডি জুলাই’ ইত্যাদি।
সামাজিক বৈষম্য: জুলাই বিপ্লবের গ্রাফিতিতে উঠে এসেছে নানা ধরনের আর্থসামাজিক বৈষম্যের কথা। যেমন ‘২৪-এর গল্প, আমি নয় আমরা’, ‘বিকল্প কে? আমি, তুমি, আমরা’, ‘কোটা না মেধা, মেধা মেধা’, ‘কোটাপ্রথা নিপাত যাক, দেশের মেধা দেশে থাক’, ‘সমতল থেকে পাহাড় এবারের মুক্তি সবার’, ‘ছাত্ররাজনীতি নিপাত যাক, শিক্ষাঙ্গন মুক্তি পাক’, ‘মেধা পাচার থেমে যাক’ ‘স্বাধীন বিচার বিভাগ চাই’, ‘নাটক কম করো পিও’, ‘দিনে নাটক, রাতে আটক’, ‘খেটে খাও, চেটে নয়’ ইত্যাদি।
নৈতিকতা ও ধর্ম: জুলাই বিপ্লবের গ্রাফিতিতে নৈতিকতা ও ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়গুলোও ধরা পড়েছে। যেমন ‘ধর্মের চেয়ে মানুষ বড়, বর্ণের চেয়ে কর্ম বড়’, ‘দেশের কোনো ধর্ম নেই, দেশের কোনো বর্ণ নেই, দেশ আমার দেশ তোমার’, ‘হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, উই আর ওয়ান’, ‘ধর্ম যার যার দেশ সবার’, ‘পানি লাগবে পানি’, ‘ঘুষ চাইলে ঘুষি’, ‘শিক্ষক রাজনীতি নিপাত যাক’ ইত্যাদি।
গান ও কবিতা: প্রয়াত, বর্তমান এবং সময়ের প্রয়োজনে আবির্ভূত হওয়া অনেক কবির কবিতা, শিল্পীর গান জুলাই বিপ্লবকে সফল করতে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। যেমন, ‘অরুণ প্রাতের তরুণ দল’, ‘মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম’ কিংবা ‘বল বীর, বল উন্নত মম শির!’, ‘এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’, ‘মনে হয় রক্তই সমাধান, বারুদই অন্তিম তৃপ্তি’, ‘আমরা প্রতিবাদ করতে জানি’, ‘চিরকাল বসন্তের বাহিরেও কিছু ফুল ফোটে’, ‘দেশটা তোমার বাপের নাকি করছ ছলাকলা কিছু বললে ধরছ চেপে সব জনগণের গলা’ ইত্যাদি।
সামাজিক বন্ধন: জুলাই বিপ্লব আন্দোলনকারীদের মধ্যকার সম্পর্কের বন্ধনকে আরও শক্তিশালী করেছে। যেমন ‘হাল ছেড়োনা বন্ধু’, ‘শোনো মহাজন, আমরা তো অনেকজন’, ‘এসেছে ফাগুন, আমরা হয়েছি শত গুণ’, ‘হারতে নয়, জিততে এসেছি’, ‘আমার ভাইয়ের গায়ে রক্ত কেন?’ ইত্যাদি।
এ ছাড়া গ্রাফিতিগুলোতে উঠে এসেছে গণ–অভ্যুত্থানের সময় রিকশাভর্তি লাশের করুণ চিত্র। একটি গ্রাফিতিতে দিনপঞ্জিকার মতো করে গণ–অভ্যুত্থানের দিনগুলো নিউজ পেপার কাটিং কোলাজ আকারে লাগানো হয়েছে; যার শেষ তারিখ দেওয়া হয়েছে ৩৬ জুলাই। একটি দেয়ালে দেখা যায়, সবুজ আইডি কার্ডের ফিতা ঝোলানো আন্দোলনে শহীদ মুগ্ধর হাসিমাখা মুখ। এ রকম সব স্লোগানে চিত্রসহ ভেসে ওঠে বাংলাদেশের প্রতিটি দেয়াল। গ্রাফিতিতে ফুটে উঠেছে স্বাধীনতার কথা, স্বীয় অধিকারের কথা, রাষ্ট্রসংস্কারের কথা, ফ্যাসিস্ট ও দুর্নীতিবাজদের রুখে দেওয়ার কথা।
যুগে যুগে বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর বুকে আন্দোলনে প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে গ্রাফিতি, যা ওই আন্দোলনের অস্তিত্বকে বহন করে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। বাচনিক যোগাযোগের চেয়ে এই অবাচনিক যোগাযোগের মাধ্যম গ্রাফিতির শক্তি সব সময়ই বেশি। যুক্তরাজ্যের বিখ্যাত গ্রাফিতিশিল্পী ব্যাঙ্কসি একদা বলেছিলেন, ‘আপনার কাছে যদি লড়াইয়ের কোনো হাতিয়ারই না থাকে, তবে গ্রাফিতি হয়ে উঠতে পারে একমাত্র অস্ত্র।’ জুলাই বিপ্লব ও বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে দেয়ালের গ্রাফিতি ও কথামালা মানুষের চিন্তার জগতে বড় প্রভাব রেখেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রশংসনীয় গ্রাফিতি ও কথামালা এখন ইতিহাসের অংশ হয়ে গেছে। এর সংরক্ষণ করা অতি জরুরি।
লেখক: কে এম রেজাউর করিম, সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, সরকারি মাইকেল মধুসূদন কলেজ, যশোর