বাংলাদেশে ঋণের বোঝা ও অলিগার্ক ব্যবসায়ীদের প্রভাব

বাজেটে ঋণের বোঝাসূত্র: প্রথম আলো

বাংলাদেশ বর্তমানে এক বিশাল ঋণের বোঝার নিচে চাপা পড়েছে, এটা মোটামুটি সব স্তরের জনগণ অবগত। রাষ্ট্রের পরিচালনায় ঋণ ব্যবস্থাপনার ভুল নীতি, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত প্রকল্প গ্রহণ এবং সরকারের অপচয়ী নীতিমালা এ ঋণের পরিমাণকে অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছে। ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের শাসনামলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার দেশের অর্থনীতিতে ঋণের পরিমাণ নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি করেছে, যা বর্তমানে দেশের সাধারণ মানুষের ওপর একটি বিশাল বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ঋণ ব্যবস্থাপনার মূল কেন্দ্রে রয়েছে তথাকথিত ‘অলিগার্ক ব্যবসায়ী’ গোষ্ঠী এবং তাদের হাত ধরেই দেশের সম্পদ বিতরণ অসম ও বৈষম্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে বিগত ১৬ বছরের শাসনামলে।

‘অলিগার্ক’ শব্দটি রাশিয়া থেকে এসেছে, যেখানে একটি শক্তিশালী অভিজাত শ্রেণি রাষ্ট্রের সম্পদ ও রাজনৈতিক ক্ষমতার ওপর কর্তৃত্ব স্থাপন করেছিল। বাংলাদেশেও রাতারাতি এ ধরনের একটি গোষ্ঠীর উত্থান ঘটেছে, যারা রাষ্ট্রীয় সুবিধা ও ঋণব্যবস্থার মাধ্যমে নিজেদের সম্পদশালী করেছে। এই অলিগার্করা মূলত রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে সম্পর্কিত ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিরা; যারা সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সুবিধা ও বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে।

২০০৯ সাল থেকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সময়ে, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প ও অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে এই অলিগার্কদের ব্যাপক প্রভাব লক্ষ করা গেছে। বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্প যেমন পদ্মা সেতু, এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অন্যান্য বড় প্রকল্পে রাষ্ট্রীয় ঋণ গ্রহণ করে। এর মাধ্যমে শুধু অলিগার্কদের ব্যক্তিগত সম্পদ বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু দেশের জনগণ সেই ঋণের বোঝা বহন করতে বাধ্য হয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের গভীর শিকড় প্রোথিত হয়েছে। ক্রোনি ক্যাপিটালিজম হচ্ছে এমন এক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যেখানে সরকার ও ব্যবসায়িক গোষ্ঠী পরস্পরের স্বার্থ রক্ষা করে চলে। এ ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা সরকার থেকে বিশেষ সুবিধা গ্রহণ করে এবং তাদের নিজস্ব লাভ বাড়ায়, যা দেশের অর্থনৈতিক সুষম প্রতিযোগিতাকে বাধাগ্রস্ত করে। এর ফলে শুধু কিছু ক্ষমতাধর গোষ্ঠী সুবিধা পায়, সাধারণ জনগণ চরম বৈষম্যের শিকার হয়।

বাংলাদেশে এই ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের উদাহরণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো বিদ্যুৎ খাতে বিশাল বিনিয়োগ, যা সরকারের অলিগার্কদের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে পরিচালিত হয়েছে। এ ধরনের প্রকল্পে ঋণের বোঝা সাধারণ মানুষের ওপর পড়েছে, তবে লাভের মূল সুবিধাভোগী হয়েছে অলিগার্করা। অন্যদিকে দেশীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা এই বৈষম্যপূর্ণ ব্যবস্থার কারণে অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়েছে।

বাংলাদেশের ঋণের পরিমাণ গত কয়েক বছরে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। বৈদেশিক ঋণ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এর সুদ ও আসল পরিশোধের পরিমাণ প্রতিবছর বাড়ছে। ২০০৯ সালে সরকারের ঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ৭০ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৩ সালের মধ্যে ১৩০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এই ঋণ পরিশোধ করতে দেশকে যে চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলা করতে হচ্ছে, তা অর্থনীতির অন্যান্য খাতের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে।
বড় অবকাঠামো প্রকল্পগুলোর জন্য বিদেশি ঋণ গ্রহণ করার ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত কমে গেছে। ঋণ পরিশোধের জন্য বাড়তি মুদ্রাস্ফীতি ও উচ্চ করের বোঝা দেশের সাধারণ জনগণের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে খাদ্যের মূল্য বৃদ্ধি, শিক্ষার খরচ বৃদ্ধি এবং চিকিৎসাসেবার ওপরও নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

সরকার তার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণের জন্য অনেক সময় অপ্রয়োজনীয় প্রকল্প হাতে নিয়েছে, যা দেশের অর্থনীতির ওপর দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। উদাহরণস্বরূপ, পদ্মা সেতু, এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো বিশাল প্রকল্পের জন্য যে ঋণ নেওয়া হয়েছে, তা দেশের অর্থনীতির ওপর চাপ ফেলেছে, যদিও সেই প্রকল্পের সরাসরি কোনো অর্থনৈতিক প্রভাব এখনো সেভাবে দৃশ্যমান নয়।

বিগত দিনগুলোয় রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখার জন্য সরকার নানা প্রকল্প বাস্তবায়নের নামে জনগণের মধ্যে নিজেকে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টা করেছে। এর ফলে ঋণের পরিমাণ আরও বেড়েছে এবং দেশ অর্থনৈতিক দিক থেকে আরও দুর্বল হয়ে পড়েছে। অলিগার্করা এই রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের ব্যক্তিগত লাভ বাড়িয়ে তুলেছে, কিন্তু দেশ ও সাধারণ মানুষের উন্নয়নের পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় ঋণের বোঝা প্রতিনিয়ত মূল্যস্ফীতি দ্বারা শোধ করতে হচ্ছে, যা কত দিন দেশের মানুষের টানতে হবে, তা অনুমান করা কঠিন। বাংলাদেশের মানুষকে ফলাও করে বোঝানো হয়েছে, ভৌত অবকাঠামোই উন্নয়ন! ভৌত অবকাঠামো কখনোই উন্নয়নের মাপকাঠি হতে পারে না, যতক্ষণ পর্যন্ত ওই অবকাঠামোর আয় সংশ্লিষ্ট অবকাঠামোর ব্যয়ের বাইরে জাতীয় জিডিপিতে অবদান রাখতে পারছে।

জনগণের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কর আদায় করেই সরকারের আয় বাড়াতে হবে। জাতীয় আয় না বাড়লে যেখানে ঋণের সব দায় শেষ পর্যন্ত জনগণের কাঁধেই পড়বে, তা জেনেও বিগত সরকার নিজেদের এবং অলিগার্কদের স্বার্থের জন্য একের পর এক মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নে এগিয়ে গিয়েছিল।

বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে যে ঋণের ফাঁদে আটকে পড়েছে, তা থেকে বের হওয়া বেশ কঠিন হবে, যদি না সঠিক ঋণ ব্যবস্থাপনার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। সরকারের উচিত হবে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলো বাতিল করে, প্রয়োজনীয় উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণ করা, যা দেশের দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নে সহায়ক হবে। বাংলাদেশের চাহিদা অনুযায়ী আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে না উল্টো বিদেশে অর্থ পাচার, উচ্চশিক্ষা ও বিদেশে চিকিৎসার জন্য বিলিয়ন ডলারের বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে, যেটা বাড়তি দুশ্চিন্তার বিষয়।

অলিগার্কদের ক্ষমতা সীমিত করে, সুষ্ঠু ও প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসায়িক পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। ক্রোনি ক্যাপিটালিজমের বিরুদ্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, যাতে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সবার জন্য সমানভাবে কার্যকর হয়।
বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন, তা থেকে উত্তরণের জন্য সরকারের ঋণ ব্যবস্থাপনার দিকে গভীর মনোযোগ দেওয়া প্রয়োজন। অলিগার্কদের প্রভাবমুক্ত একটি অর্থনৈতিক কাঠামো গঠন করতে হবে, যা দেশের উন্নয়নের স্বার্থে কাজ করবে এবং সাধারণ জনগণকে সেই উন্নয়নের সুফল ভোগ করতে দেবে। ক্ষমতার অপব্যবহার ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ঋণ গ্রহণের ফলে দেশের অর্থনীতির ওপর যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে মুক্তি পেতে হলে একটি কার্যকর ঋণ ব্যবস্থাপনা এবং সুষ্ঠু অর্থনৈতিক নীতি প্রয়োজন।

লেখক: মাহমুদুল হাসান এফসিসিএ, ফাইন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট স্পেশালিস্ট, পিকেএসএফ

নাগরিক সংবাদ-এ ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]