মাটির কাছে ফিরে যাওয়ার গল্প

কৃষি নিয়ে পড়াশোনা শুধু একটি বিষয়ের গভীরে প্রবেশ নয়; বরং প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় বন্ধনের এক বিপ্লবের নাম। এটি এমন একটি শিক্ষা, যার দর্শন জীবনের মৌলিক চাহিদা, খাদ্যের উৎপত্তির পাশাপাশি ভাবতে শেখায় তার প্রকৃতি নিয়ে। কৃষির পাঠশালা মানে শুধু বইয়ের পাতা নয়, এটি খোলা মাঠ, সবুজ ধান, শিশিরবিন্দু, পাকা ধানের সুঘ্রাণ, মাটির আর্দ্রতা আর রোদ-মাটির অনন্ত সংলাপ।

কৃষিনির্ভর অর্থনীতির বঙ্গে ধান প্রধান খাদ্যশস্য। শত শত বছর ধরে ধান চাষ আমাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে, কাঠামোগতভাবে এ যেন এক শিল্প। ধান চাষ ও গবেষণায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (ব্রি), যা কৃষির আধুনিকায়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে। এই প্রেক্ষাপটে গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের (গবি) কৃষি অনুষদের শিক্ষার্থীরা এক অনন্য শিক্ষাসফরে অংশ নেন।

তাত্ত্বিক জ্ঞানের বাস্তব প্রয়োগ এবং গবেষণার আধুনিক প্রযুক্তি সম্পর্কে সরাসরি অভিজ্ঞতা অর্জনের লক্ষ্যেই তাঁদের এই সফর। যে সফরের উৎকর্ষ সাধন হবে ভবিষ্যতে। দিনব্যাপী এ পরিদর্শনের শুরু হয় ব্রির বীর মুক্তিযোদ্ধা জহিরুল ইসলাম ট্রেনিং কমপ্লেক্সের সেমিনার কক্ষে। এখানে শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরা হয় ব্রির প্রাতিষ্ঠানিক পরিচিতি, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। ব্রি উদ্ভাবিত ৭টি হাইব্রিড এবং ১০৮টি উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত সম্পর্কে বিশদ আলোচনা শিক্ষার্থীদের মুগ্ধ করে। আলোচনায় অংশ নেন ব্রির সাবেক মহাপরিচালক ড. জীবনকৃষ্ণ বিশ্বাস। তিনি ধান গবেষণার ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনা ও তাঁর অভিজ্ঞতা নিয়ে আলোচনা করেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা একটি ফলপ্রসূ প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নিয়ে তাঁদের জিজ্ঞাসার সমাধান খুঁজে পান।

এ সফর যেন শুধু জ্ঞান অর্জনের নয়; বরং প্রকৃতি-মাটি ও খাদ্য উৎপাদনের প্রতি দায়বদ্ধতা তৈরি করে। মনে করিয়ে দেয়, কৃষি কেবল একটি পেশা নয়; এটি মানবতার বেঁচে থাকার মূলে থাকা একটি শিল্প। এ সময় শিক্ষার্থীরা ব্রি রাইস মিউজিয়ামে ধানের জীবনচক্র, বিভিন্ন জাতের জার্মপ্লাজম এবং ধান উৎপাদনে ব্যবহৃত আনুষঙ্গিক উপাদান সম্পর্কে ঘনিষ্ঠ ধারণা লাভ করেন। ব্রি উদ্ভাবিত আধুনিক প্রযুক্তি, যেমন সি৪ রাইস ল্যাব ও বায়োটেকনোলজি বিভাগের গবেষণার দিকগুলো শিক্ষার্থীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাঁরা ল্যাবরেটরি সরঞ্জাম, আধুনিক গবেষণার পদ্ধতি এবং ধান চাষে উদ্ভাবিত বিভিন্ন পদ্ধতি ও যন্ত্রপাতি সম্পর্কে সরাসরি জানার সুযোগ পান।

আমাদের দেশের কৃষ্টি ও সমৃদ্ধি—দুটোই কৃষি। কৃষিশিক্ষার নান্দনিকতা সেই অনুভবে নিহিত, যখন একজন শিক্ষার্থী এক ফোঁটা বৃষ্টির সঙ্গে ফসলের সম্পর্ক বুঝতে শেখেন বা জানতে পারেন কীভাবে মাটির উর্বরতা বাড়িয়ে উৎপাদনশীলতা দ্বিগুণ করা যায়। কৃষির পাঠ একজন শিক্ষার্থীকে শুধু একজন কৃষিবিদ করে তোলে না; বরং একজন প্রকৃতিপ্রেমী দার্শনিক হিসেবে গড়ে তোলে।

শিক্ষাসফর সম্পর্কে কৃষি অনুষদের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থী সুমাইয়া আক্তার বলেন, ‘ধান নিয়ে গবেষণায় ব্রি সত্যিই একটি মাইলফলক। আমাদের দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও কৃষি অর্থনীতিতে এ প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা অনস্বীকার্য। এ সফর আমাদের তত্ত্বীয় ও ব্যবহারিক জ্ঞানের মধ্যে সেতুবন্ধ তৈরি করেছে।’

মাটি, বীজ আর সূর্যের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলা এই শিক্ষা যেন আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ‘আমরা যা খাই, তা প্রকৃতির এক অমূল্য দান।’ কৃষি পড়া তাই শুধুই পেশা নয়, এটি মানবতার প্রতি এক গভীর দায়বদ্ধতার অঙ্গীকার।

লেখা: শিক্ষার্থী, গণ বিশ্ববিদ্যালয়