ভোটে যেসব আসন নিয়ে আলোচনা বেশি
৭ জানুয়ারি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন। দেশের অন্যতম বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি, জামায়াতসহ কয়েকটি দল নির্বাচন বর্জন করায় ভোটের মাঠে উত্তাপ ছিল অনেকটাই কম। তারপরও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতায় যাওয়ার একমাত্র বৈধ সিঁড়ি হলো ‘ভোট’। তাই জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের এ পদ্ধতিকে কেন্দ্র করে হামলা-মামলা, উৎকণ্ঠা, উৎসাহ-উদ্দীপনা, প্রচার-প্রচারণা এবং সংশয় শেষ আগামীকাল রোববার ভোট।
আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতারা সংসদীয় আসনগুলোতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নেওয়ায় ভোট একতরফা, বিনা ভোট কিংবা প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন হচ্ছে না। বরং অনেক আসনে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জাসদ, ওয়ার্কার্স পাটি ও জেপির প্রার্থীদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। বলা যায় দলীয় অনেক প্রার্থীর আরামের ঘুম হারাম করে দিয়েছেন এসব প্রার্থী।
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ২৬৫ আসনে নৌকা প্রতীকে প্রার্থী দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আর দলটির সঙ্গে সমঝোতা করে ভোটে অংশ নেওয়া জাতীয় পার্টিকে ২৬টি আসন এবং ১৪ দলের শরিকদের ৬টি আসন ছেড়ে দিয়েছে শাসক দলটি। নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী ৪৩৬ জন। এবার ভোটে লড়ছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটি ও উপদেষ্টা পরিষদের ৪১ জন প্রার্থী। এর মধ্যে কমপক্ষে ১৪-১৫ জন প্রার্থী হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের মুখে পড়ছেন বলে মনে করা হচ্ছে।
৩০০ সংসদীয় আসনের মধ্যে কমপক্ষে ৩০ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী আওয়ামী লীগ এবং ১৪–দলীয় জোটের প্রার্থীর সঙ্গে জোর লড়াই হবে। দলীয় হেভিওয়েট প্রার্থীরা যেসব জনপ্রিয় স্বতন্ত্র প্রার্থীদের চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন হবিগঞ্জ-৪ আসনে (চুনারুঘাট-মাধবপুর) বিমান ও পর্যটন প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলীকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী সায়েদুল হক সুমন। এলাকায় প্রচুর রাস্তাঘাটের উন্নয়ন, কালভার্ট, ব্রিজ, সাঁকো নির্মাণ করে সাধারণ মানুষের মন জয় করেছেন। এ ছাড়া ‘ব্যারিস্টার সুমন ফুটবল একাডেমি’ তৈরি করে সারা দেশে ফ্রেন্ডশিপ ফুটবল খেলে জনপ্রিয়তা অর্জন করা সুমন ভোটের খেলায় প্রতিপক্ষকে কাটিয়ে দ্রুত সামনে উঠে এসেছেন।
তিনবারের সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী এবার রাজশাহী-১ (তানোর-গোদাগাড়ী) আসনে আওয়ামী লীগের আলটিমেট চয়েস। এখানে বৈধ প্রার্থী ১১ জন। এর মধ্যে তাঁকে কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থীকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচনা ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী অভিনেত্রী মাহিয়া মাহিকে (শারমিন আক্তার নিপা) নিয়ে। আরেক শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী গোলাম রাব্বানি। কাঁচি প্রতীকের এই প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আখতারুজ্জামান (ঈগল প্রতীক)। গোলাম রাব্বানি তানোর উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ও মুন্ডুমালা পৌর মেয়র ছিলেন। অন্যদিকে আখতারুজ্জামান জেলা আওয়ামী লীগ নেতা ও দেওপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের তিনবারের চেয়ারম্যান। রাজশাহী-১ আসন বিএনপি-জামায়াতের শক্ত ভোটব্যাংক। তাদের বুঝিয়ে ভোটকেন্দ্রে যিনি নিয়ে আসতে পারবেন, তিনিই হাসবেন বিজয়ীর হাসি!
একসময় জামায়াতে ইসলামীর ভোটব্যাংকখ্যাত পিরোজপুর-১ (নাজিরপুর, পিরোজপুর সদর ও ইন্দুরকানী) আসন এবার ব্যাপক আলোচনায়। এখানে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম। তবে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়ছেন জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ কে এম এ আউয়াল ওরফে সাইদুর রহমান। পিরোজপুর আওয়ামী লীগ মূলত দুই ভাগে বিভক্ত। একটি অংশের নেতৃত্বে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী শ ম রেজাউল করিম এবং আরেক অংশের সাবেক সংসদ সদস্য এ কে এম আউয়াল। এ আসনে জামায়াত-বিএনপির ভোট আছে।
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য এবং সাবেকমন্ত্রী কামরুল ইসলাম প্রার্থী হয়েছেন ঢাকা-২ (কেরানীগঞ্জ মডেল থানা, কামরাঙ্গীরচর ও সাভারের একাংশ) আসনে। এখানে তাঁর শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী ট্রাক প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী হাবিবুর রহমান। হাবিবুর রহমানের পক্ষে কাজ করছেন কামরুল ইসলামের দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দ্বী উপজেলা চেয়ারম্যান শাহীন আহমেদ। তাই কামরুল ইসলামের জয় সহজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। এই আসনে অসংখ্য কওমি মাদ্রাসা রয়েছে। এসব মাদ্রাসার ভোট এবার গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারে।
ঢাকা-৪ (শ্যামপুর ও কদমতলী) আসনে লড়ছেন তিন হেভিওয়েট প্রার্থী। এখানে বর্তমান সংসদ সদস্য জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা। জোটের স্বার্থে আওয়ামী লীগ গত দুটি নির্বাচনে তাঁকে ছাড় দেয়। এবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী দলের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য সানজিদা খানম। তবে দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে স্বতন্ত্র হিসেবে ভোটে আছেন প্রধানমন্ত্রীর সাবেক সহকারী একান্ত সচিব আওলাদ হোসেন। তাঁর প্রতীক ট্রাক। আওয়ামী লীগের ভোট সানজিদা ও আওলাদের মধ্যে ভাগ হলে লাভ জাতীয় পার্টির প্রার্থী বাবলার। এই আসনে ত্রিমুখী লড়াইয়ের সম্ভাবনা আছে। তবে চারবারের সংসদ সদস্য হওয়ায় লাঙ্গলের প্রার্থীর রয়েছে শক্ত ভিত।
বর্তমান এবং সাবেক ৩ সংসদ সদস্যর ত্রিমুখী লড়াইয়ে জমে উঠেছে নেত্রকোনা-৩ (কেন্দুয়া ও আটপাড়া) আসনের ভোটের মাঠ। এখানে নৌকার মাঝি হয়েছেন বর্তমান সংসদ এবং আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল। তাঁকে বেকায়দায় ফেলতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়িয়েছেন সাবেক দুই সংসদ সদস্য মঞ্জুর কাদের কোরাইশি (ঈগল) এবং ইফতিখার উদ্দিন তালুকদার পিন্টু (ট্রাক)। দীর্ঘদিন ধরে তাঁরা সবাই কমবেশি এলাকায় উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন। তাই এবার হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের সম্ভাবনা আছে।
মৌলভীবাজার-২ (কুলাউড়া) আসনে নৌকার মাঝি আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল। এ এলাকা মূলত বিএনপি-জামায়াতের ঘাঁটি। শফিউল আলম চৌধুরী নাদেলের সঙ্গে ত্রিমুখী প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী সাবেক এমপি এম এম শাহীন (সোনালী আঁশ) এবং কুলাউড়া উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান এবং আওয়ামী লীগ নেতা অধ্যক্ষ এ কে এম সফি আহমদ সলমানের (ট্রাক প্রতীক) সঙ্গে।
চাঁদপুর-৩ (চাঁদপুর সদর ও হাইমচর) কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক দীপু মনি। তাঁর মূল প্রতিদ্বন্দ্বী ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. শামছুল হক ভূঁইয়া। চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি ভূঁইয়া এ আসনের সাবেক সদস্য। এখানে অনেক বছর ধরে মনোনয়ন চেয়েও পাননি আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী। সাবেক এই ছাত্রনেতার রয়েছে বিশাল জনসমর্থন। তাঁর সমর্থকদের ভোট ফলাফল নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
ফরিদপুর-১ (মধুখালী, বোয়ালমারী ও আলফাডাঙ্গা) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও দলের সভাপতিণ্ডলীর সদস্য আবদুর রহমানকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম)-এর ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান শাহ মো. আবু জাফর। দলীয় পরিচয়ের বাইরেও মুক্তিযোদ্ধা এবং শ্রমিকনেতা হিসেবে শাহ জাফরের ভোটব্যাংক আছে। ভোটের আগে বিএনপি ছেড়ে বিএনএমতে (কিংস পার্টিখ্যাত) যোগ দিয়ে নোঙ্গর প্রতীকে নির্বাচন করছেন। এ ছাড়া স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে (ঈগল প্রতীকে) আলোচনায় আছেন সাংবাদিক আরিফুর রহমান দোলন।
বিএনপির অন্যতম দুর্গ ফরিদপুর-৩ (সদর) আসন। এখানে দীর্ঘদিন সংসদ সদস্য ছিলেন বিএনপি নেতা চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ। এবারের নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি শামীম হক এ আসনে নৌকার প্রার্থী। আর স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে আছেন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ। শামীম হকের বিদেশি নাগরিকত্ব রয়েছে দাবি করে তাঁর বিরুদ্ধে আইনি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিলেন এ কে আজাদ। বিষয়টি নিয়ে জল কম ঘোলা হয়নি। দুই পক্ষের সমর্থকেরা সংঘাতে লিপ্ত হয়ে সংবাদের শিরোনাম পর্যন্ত হয়েছেন। সর্বশেষ উচ্চ আদালতের নির্দেশনা পেয়ে ভোটের মাঠে টিকে আছেন শামীম হক। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এ আসনে সংখ্যালঘু ভোট, চর এলাকায় কামাল ইউসুফের পরিবারের ভোট, সাবেক মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ ও তাঁর সমর্থকদের ভোট এবং জামায়াতের ভোট গুরুত্ব রাখবে।
ফরিদপুর-৪ (ভাঙ্গা, চরভদ্রাসন ও সদরপুর উপজেলা) আসনে দুই হেভিওয়েট প্রার্থীর মনোমালিন্য বেশ পুরোনো। এ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী (নৌকা) দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য কাজী জাফর উল্যাহ। তাঁর বিরুদ্ধে ঈগল প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মজিবুর রহমান ওরফে নিক্সন চৌধুরী। তিনি এলাকায় সব বয়সী মানুষের কাছে জনপ্রিয়। এর আগে দুইবার ভোটের লড়াইয়ে জাফর উল্যাকে হারিয়েছেন মাদারীপুর থেকে ভাঙ্গায় এসে নির্বাচন করা এই যুবনেতা। যদিও কাজী জাফর উল্যাহ এবং তাঁর স্ত্রী নিলুফার জাফর এই আসনের সাবেক সদস্য, তারপরও ভোটের হিসাবে নিক্সন অনেকটাই এগিয়ে।
নির্বাচনী সংঘাতে আলোচনায় মাদারীপুর-৩ আসন (কালকিনি, ডাসার ও সদরের একাংশ)। এখানে নৌকার প্রার্থী আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক আবদুস সোবহান গোলাপ। অন্যদিকে ঈগল প্রতীক নিয়ে গোলাপকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন সংরক্ষিত মহিলা আসনের এমপি এবং কালকিনি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি তাহমিনা বেগম। এই আসনের বেশির ভাগ আওয়ামী লীগের উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন কমিটির সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক ঈগলের পক্ষে কাজ করছেন। তাহমিনা বেগমের পুঁজি তৃণমূলের জনসমর্থন।
জাসদের সভাপতি হাসানুল হক ইনু নির্বাচনী সাঁকো পার হতে কুষ্টিয়া-২ (মিরপুর-ভেড়ামারা) আসনে নৌকার মাঝি হয়েছেন। তবে ট্রাক প্রতীকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ইনুকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন মিরপুর উপজেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক কামারুল আরেফিন। জেলা, থানা এবং পৌর আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা এবার কামারুলকে সমর্থন দেওয়ায় বিপাকে পড়েছেন সাবেক তথ্যমন্ত্রী।
কুষ্টিয়া-৩ (সদর) আসনে আওয়ামী লীগের আরেক হেভিওয়েট প্রার্থী এবং দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফের নৌকা প্রতীক চ্যালেঞ্জের মুখে। তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী কুষ্টিয়া পৌরসভার পাঁচবারের মেয়র আনোয়ার আলীর ছেলে তরুণ ক্রীড়া সংগঠক পারভেজ আনোয়ার তনু। তনুর প্রতীক ঈগল। একসময় সর্বহারাদের ঘাঁটি হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পাওয়া এই আসনে হানিফ এবং তনুর মধ্যে জোর লড়াইয়ের সম্ভাবনা আছে।
রাজশাহী-২ (সদর) আসনে লড়ছেন আলোচিত দুই প্রার্থী দুই ‘বাদশা’। ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশার দুর্গে হানা দিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছেন রাজশাহী মহানগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি শফিকুর রহমান বাদশা। তিনি লড়ছেন কাঁচি প্রতীকে আর ফজলে হোসেন বাদশা নৌকা প্রতীকে। আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয়ভাবে জোটের প্রার্থী ফজলে হোসেনকে সমর্থন দিলেও স্থানীয় নেতা-কর্মীরা বিভক্ত হয়ে পড়েছেন। তাঁদের অধিকাংশই শফিকুর রহমানের পক্ষে নামায় নির্বাচন প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হবে বলে ধারণা।
পোস্টারে ‘আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী’ লিখে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছেন কিশোরগঞ্জ-৩ (করিমগঞ্জ-তাড়াইল) আসনে জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীকের প্রার্থী মুজিবুল হক চুন্নু। দলের মহাসচিব এবং সাবেক মন্ত্রী চুন্নুকে মোকাবিলা করতে হচ্ছে চারজন আওয়ামী স্বতন্ত্র প্রার্থীকে। এঁরা হলেন নিউইয়র্ক আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মাহফুজুল হক (ঈগল), মেজর (অব.) নাসিমুল হক (কাঁচি), স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় নেতা গোলাম কবির ভূঁইয়া (কেটলি), রুবেল মিয়া (ট্রাক)। এই আসনটি জোটের কারণে কেন্দ্রীয়ভাবে জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দিলেও স্থানীয় আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ চুন্নুর বিপক্ষে মাঠে আছে।
সুনামগঞ্জ-২ (দিরাই ও শাল্লা) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীকে লড়ছেন আবদুল্লাহ আল মাহমুদ ওরফে আল আমীন চৌধুরী। তিনি শাল্লা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান। তবে সব পরিচয় ছাপিয়ে তিনি আলোচনায় এসেছেন পুলিশের আইজি আবদুল্লাহ আল মামুনের ভাই হিসেবে। মাহমুদের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে কাঁচি প্রতীকে লড়ছেন সাবেক রেলমন্ত্রী এবং ছয়বারের এমপি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্ত্রী জয়া সেনগুপ্ত। জয়া এই আসনে দুইবারের সংসদ সদস্য। এটি মূলত সেনবাবুর দুর্গ হিসেবে পরিচিত। এই আসনে সংখ্যালঘু ভোটার বেশি থাকায় কাঁচি প্রতীকের পাল্লা ভারী বলেই মনে করছেন অনেকে।
সুনামগঞ্জ-৪ (সদর ও বিশ্বম্ভরপুর) আসনে নৌকার মাঝি হয়েছেন নির্বাচন কমিশনের সাবেক সচিব এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাদিক। ভোটের মাঠে তাঁকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন এই আসনের দুইবারের জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ।
সিলেট-৬ (বিয়ানীবাজার ও গোলাপগঞ্জ) আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তাঁকে লড়তে হচ্ছে তৃণমূল বিএনপির চেয়ারম্যান শমসের মুবিন চৌধুরী এবং কানাডা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি সারওয়ার হোসেনের সঙ্গে। সোনালী আঁশ প্রতীকে নির্বাচন করা এ শমসের মুবিনের পক্ষে কাজ করছে জেলা, উপজেলা ও থানা আওয়ামী লীগের বড় একটি অংশ। আর স্থানীয় আওয়ামী লীগের আরেকটি অংশ কাজ করছে সারওয়ার হোসেনের ঈগল প্রতীকের পক্ষে। নুরুল ইসলাম নাহিদকে কঠিন লড়াইয়ে মুখোমুখি হতে হবে।
চট্টগ্রাম-১ (মীরসরাই) আসনে ভোটের হিসাব–নিকাশ পাল্টে দিতে পারেন ঈগল প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং মিরসরাই উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান মো. গিয়াস উদ্দীন। এই আসনে নৌকা প্রতীক পেয়েছেন সাবেক মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের ছেলে মাহবুব উর রহমান রুহেল। এখানে ভোটে লড়াইয়ের আভাস মিলেছে।
নির্বাচন বিশেষজ্ঞ এবং ডেমোক্রেসি ইন্টারন্যাশনালের মুখ্য পরিচালক আবদুল আলীমের মতে, এবার ৩০০ আসনের মধ্যে অন্তত ৩০ জন শক্তিশালী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে হেভিওয়েট প্রার্থীকে টেক্কা দিচ্ছেন এবং সহিংসতায় জড়াচ্ছেন। এর অর্থ হলো অনেক আসনে সত্যিকার অর্থে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হচ্ছে। এই ধারাবাহিকতা ভোটের দিনও চলতে পারে বলে তাঁর ধারণা। ফলে ভোট কিছুটা উৎসবমুখর হলেও হতে পারে। অন্যদিকে বিএনপি ও সমমনা দল নির্বাচন বর্জন করায় ভোটারদের অনেকেই ভোট দিতে আসতে নাও পারেন। তবে আবদুল আলীমের আশঙ্কা, শক্তিশালী প্রার্থীরা ভোটের দিন সহিংসতা করলে সুষ্ঠু পরিবেশ ক্ষুণ্ন হবে। এ জন্য নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসনকে কঠোর হস্তক্ষেপ করতে হবে।
রাজনীতির জটিল সমীকরণে শেষ মুহূর্তে প্রার্থীরা দলীয়, নিরপেক্ষ ও ফ্লোটিং ভোট কতটা টানতে পারছেন, সেটি বিবেচ্য বিষয়। ভোটাররা দলীয় পরিচয়ের বাইরে গিয়ে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীকে কীভাবে ভোট দেবেন, সেটি বিবেচ্য বিষয়। সুতরাং যেসব প্রার্থী ভোটারদের বুঝিয়েসুজিয়ে শেষ মুহূর্তে নিজের পক্ষে কেন্দ্রে সুষ্ঠুভাবে ভোট দিতে আনতে পারবেন, তাঁর মুখেই দেখা যাবে চওড়া হাসি!
*লেখক: বায়েজিদ আহমেদ, সাংবাদিক এবং বাংলাদেশের নির্বাচন বিষয়ে এমফিল গবেষক