‘ছবি মিয়া, আর কাইন্দো না’
ছবি মিয়া নাম তার। সে ছবি আঁকে না। ঘাটপাড়ে তার ভাতের হোটেল আছে একটি। সে লুঙ্গি পরে ক্যাশ কাউন্টারে বসে থাকে। আস্তে কথা বলতে পারে না। টিনের দেয়ালে বিশাল বড় একটা ইলিশের ছবি টানানো আছে। ছবি লাগানোর পর থেকেই সবাই তাকে ছবি মিয়া নামে ডাকে কেন যেন। আসল নাম ফারুক। ভাতের হোটেলের ব্যবসা করতে এসে তার ফারুক নামটা আর নেই, ফারুক নামটা ছবির ইলিশের পেটের ভেতর ঢুকে গিয়েছে।
আজ দুই মাস হয়ে গেল তার দোকান বন্ধ করে দেওয়ার। মানুষেরা ভাত খাওয়া ছেড়ে দেয়নি, তবে কেউ এখন আর ছবি মিয়ার দোকানে এসে ভাত খায় না আরকি। লোকজন খেতে চাইলেও প্রশাসনের নিষেধ আছে। ছবি মিয়া লুকিয়ে কয়েক দিন দোকান খুলেছিল, কিন্তু পুলিশ এসে বন্ধ করে দিয়েছে। কয়েকবার পুলিশদের বলেছিল, ‘আপনাদের জন্য তিন বেলা ফ্রি খাওয়া।’ এটা বলার পর দুই-তিনটা কিলঘুষিও খেতে হয় তাকে। মাংস আর মাছের তরকারির বড় পাত্র নিয়ে কোনোমতে দৌড়ে বাড়ি পৌঁছাতে পারে। ভেবেছিল, ঠিকমতো তরকারির বড় পাত্র নিয়ে দৌড় প্র্যাকটিস করতে থাকবে। কিন্তু বয়স যে এটা-সেটা করতে গিয়ে হুট করে কী করে বেড়ে গেল, টের পাওয়া যায়নি। এই বয়সে দৌড় দিলে না শ্বাস উল্টে যায়, লুঙ্গি খুলে যায়।
তার হোটেলে কাজ করে সুমন, ১২ বছরের ছেলে। কাজে কোনো মন নাই, ক্রেতাকে খাবার দিতে গেলে চুপিচুপি মুখে দিয়ে দেয়। এই চোরটাকে নিয়ে ছবি মিয়ার অনেক যন্ত্রণা। ছবি মিয়া মাংসের বাটিটা তার কাউন্টারেই রেখে দেয় তার নিজের রানের মাংসের ওপর, সুমনের চুরি থেকে রক্ষা পেতে। কাস্টমার মাংস চাইলে সুমনকে এসে ছবি মিয়ার কাছ থেকেই নিতে হয়। কিছু কাস্টমার মাঝেমধ্যে তো বারবার বলে, ‘এক্সট্রা দেন আরেকটু, এক্সট্রা দেন আরেকটু।’ তখন ছবি মিয়ার রাগ ওঠে আর বলে, ‘ফকিন্নির পুতাইন, জীবনে গরু দেহস নাই, আজকা আর নাই, কইরে সুমন আমার রানের মাংস রাইন্দাদে এই ফহিন্নির পুতাইনরে, আর রান্ধার বালায় ঝাল বেশি দিতে কইবি, মিডা পাইয়ালাইছে।’
এখন দোকান বন্ধ ছবি মিয়ার। নেই কোনো চিৎকার, নেই ক্রেতা, প্রতিদিন বেলা আড়াইটায় টিভির সামনে বসে করোনার আপডেট দেখে আর রাগ ওঠে তার আর ছোট ভাই রবিনকে নিয়ে চিন্তা করে। ভাইয়ের সাথে তার সম্পর্ক এত ভালো নয়। ঢাকায় কেমনে কী করে, কোনো খোঁজ রাখে না। মাসে এক-দুইবার কথা হয়, কথা কখনো সুন্দরভাবে শেষ হয় না। হয় ছবি রেগে যায়, না হয় তার ভাই। গালাগালি আর ঘৃণাতে শেষ হয়। তবু ছবির আজ খারাপ লাগছে। আজ যখন শুনতে পারে, ঢাকায় মানুষের মৃত্যুসংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, তখন ছবির মনটা আরও দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। মোবাইলে ২০ টাকা রিচার্জ করে আজ ভাইকে জিজ্ঞেস করবে সুন্দর করে, কী দিয়া ভাত খাইছে, হাতে টাকাপয়সা আছে কি না। যদি রবিন রাগ করে, তবু আজ ছবি রাগ করবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ‘গালি দিলে দিক, ভাই-ই তো। ভাই ছাড়া তো রক্তের আর কেউ নেই। ভাইটাই তো আমাকে ফারুক ভাই বলে ডাকে, সবাই তো ছবি ছবি করে ভেঙ্গাইতেই থাকে, বাবা নাই, মা নাই, আমিই তো তার গার্জিয়ান এখন।’ এসব ভাবতে ভাবতে ছবির মনটা নরম হয়ে যায়।
৩০ মিনিট ধরে ফোন করে রবিনকে পায় না ছবি। লুঙ্গির ফাঁকে গুঁজে রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে অনবরত ফোন দিতেই থাকে। হাটে যাওয়া মানুষ ছবিকে দেখে বলতে থাকে,
‘বিড়ি টাইনো না মিয়া, বিড়ি খাইলে নাকি করোনা বেশি ধরে।’
‘রবিনরে ফোনে পাইতেছি না। মোবাইলের বেডি তো খালি দুঃখিত কয়।’
‘আরে ঘুমটুম দিছে মনে হয়। রাইতের বেলা দিয়ো।’
সারা রাত ছবির ঘুম হয়নি। রবিনকে ফোনে পাওয়া যায়নি। সকাল সকাল পুলিশসহ এলাকার চেয়ারম্যান ছবির বাসায় আসে। পুলিশ দেখেই ছবি ভাবতে থাকে, হয়তো কিছুদিন হোটেল খোলা রাখার জন্য তাকে ধরতে আসছে। এখন আর পালানোর কোনো ইচ্ছা নাই। সে চেয়ারম্যানকে বলবে, জেলে নিতে চাইলে সে যাবে, কিন্তু তার ভাইটার একটু খোঁজ যদি এনে দিতে পারে।
‘তো, ছবি মিয়া, তোমার লাইগা একটা গরম খবর আছে।’
‘স্যার, ভাতের হোটেল খুলছিলাম মাইনষেরে খাওয়াইতে। মাইনষের পেটের খিদা আমার সহ্য হয় না, মাফ কইরা দেইন, আমার একটা কথা আছিল, স্যার।’
‘আরে রাহো তোমার কথা, তোমার ভাইয়ের বাজে রোগ অইছে। আইছিল নাকি বাড়িতে রাইতের বেলা ইদানীং লুকাইয়া?’
‘কী হইছে রবিনের, স্যার?’
দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ছবি মিয়া। তার মাথায় পাহাড় ভেঙে পড়ে।
‘স্যার, রবিনের লগে আমার একটু কথা কউয়াইয়া দেন।’
‘ওইটা দিমুনে। তুমি এখন থাইক্কা ১৪ দিন ঘর থেকে বাইর হইবা না। যদি এক পা বাইরে দিছ, তবে বাকি আরেক পা আমি কবরে রাইখা আসমু। আমি আছি, পুলিশ আছে, বেবাক মানুষ আছে, তোমার খাওয়ান-দাওয়ান আমরা দেখমু, অনেক তো খাওয়াইলা আমরারে।’
ভারী শরীরের ছবি মিয়া মাসুম বাচ্চার মতো কাঁদতে থাকে। তার পা ভারী হয়ে যায়, সে আর হাঁটতে পারছে না। এক দৌড়ে ইচ্ছা হচ্ছে তার ভাইয়ের কাছে চলে যেতে। ছবি মিয়াকে ঘরের বাইরে থেকে তালা মেরে যায়। দাঁত কিড়মিড় করতে করত ছবি মিয়া রবিনকে নিয়ে ভাবে। তার ভাইটা বাঁচবে তো?
রাতের বেলায় সুমন ছবি মিয়াকে দেখতে আসে। সুমন ছবি মিয়ার ইশারায় তালা ভাঙে। মাঝরাতে সুমন এলাকা ছেড়ে পালায়। পকেটে ২ হাজার ৫০০ টাকা। ঢাকায় যাওয়ার কোনো বাস নাই, ইতিমধ্যে রবিন কোন হাসপাতালে আছে, তা জানা হয়ে গেছে ছবির। কিন্তু এখান থেকে ঢাকা ২০০ কিলোমিটারের পথ, চাইলেই হেঁটে যেতে পারবে না। কাঁথা মুড়িয়ে বাসস্টেশনের বড় রেইনট্রিগাছের আড়ালে ঘুমিয়ে থাকে সে, সকাল সকাল বাস-ট্রাক যা-ই পাবে, তা দিয়েই ঢাকার দিকে যাবে।
রবিনের ফোনে ঘুম ভাঙে ছবির।
‘ভাই, শইলডা বালা না বেশি। তয় ঠিক হইয়া যাইব। তুমি কিমুন আছো?’
‘ভাই, কিচ্ছু হইব না। আমি ঢাকা আইতেছি। তর কিচ্ছু হইব না, ভাই।’
‘তরে অনেক বড় ডাক্তার দেখামু। তর বড় ভাই থাকতে তর কিচ্ছু হইব না।’
‘ভাই, আব্বার কথা অনেক মনে পড়তেছে। মন চাইতেছে আব্বার লগে নামাজ পড়তে। আমার সাথের এক রোগীর মোবাইল থেকে ফোন দিছি ভাই, এখন রাইখা দেই।’
এই প্রথমবারের মতো অনেক দিন পর দুই ভাইয়ের কোনো দ্বন্দ্ব ছাড়াই কথা বলা শেষ হয়। ছবি এক সবজি বহনকারী ট্রাকে করে ঢাকায় যায়। রবিন যে নম্বর থেকে ফোন দিয়েছিল, সেই নম্বরে এখন ফোন দিলে অন্য একজন ধরে আর বলে, যার ফোন, সে আইসিইউতে আছে এখন। অবস্থা ভালো না।
‘আরে, আপনি বারবার ফোন দিচ্ছেন কেন, আমার ছেলে আইসিইউতে।’
‘আমার ভাই রবিনরে একটু দিবাইন, ভাই?’
‘সরি, আমি কোনো রবিনকে চিনি না।’
হাসপাতালের চারপাশেও ঘুরেও কোনো হদিস মেলেনি রবিনের।
অবশেষে সকাল সকাল হাসপাতাল থেকে ফোন আসে।
রবিনের মৃত্যুসংবাদ শুনতে পায় ছবি মিয়া। ছবি মিয়ার একমাত্র ছোট ভাইয়ের মৃত্যু। সব উৎকণ্ঠা, অপেক্ষা থেমে যায় এক মৃত্যুর খবরে। কারণ, এখন যা-ই কিছু করা হোক না কেন, তার ভাইকে আর জীবিত পাওয়া যাবে না।
সকালে নাশতা খেতে গিয়ে রবিনের জন্য খিচুড়ি কিনেছিল। গরু, খিচুড়ি, রবিন খিচুড়ি পছন্দ করত। খিচুড়ির প্যাকেট হাতেই তালতলার দিকে রওনা হয় ছবি। বৃষ্টি হচ্ছে আজ। স্তব্ধ ছবির হাত থেকে খিচুড়ির প্যাকেট ফেলে দিয়ে তাকে মাস্ক, পিপিই দেওয়া হয়।
‘আমার ভাই খিচুড়ি খাইব’, বলে চিৎকার করতে থাকে ছবি।
রবিন আর খিচুড়ি খায় না। মৃত মানুষের খিদে পায় না। দূর থেকে একটু দেখা যায় রবিনকে। রবিন শুয়ে আছে। ছোট ভাই আমার শুয়ে আছে। ভাই আমার আব্বার কাছে চলে যাচ্ছে।
‘আব্বা গো, তোমার লগে নামাজ পড়তে চাইছিল আমার ভাইটা, আমার রবিনটা।’
গ্রাম থেকে পালিয়ে যাওয়ার জন্য ছবিকে খুঁজছে পুলিশ। ছবি মিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে বলতে থাকে,
‘আমি হাইরা গেছি, আমার আর কিচ্ছু নাই।’