শুক্রবারের সন্ধ্যাটা
সপ্তাহে মনে হয় একটা দিনই ভালো করে ঘুমাতে পারি—শুক্রবার। হলে পুরো সপ্তাহে ঘুম বলে কিছুই থাকে না। তিন ফুটের একটা বেড, তাতে দুজন মিলে ঠাসাঠাসি করে থাকা, চারপাশে রুমমেটদের নিরন্তর গল্প, দরজার ক্যাচক্যাচ শব্দ। একটানা সেই শব্দের ভেতর ঘুম যেন হারানো বিলাসিতা। তাই প্রতি সপ্তাহে কষ্ট করে ঢাকা থেকে বাড়ি ফিরি, শুধু দুটি রাত একটু শান্তিতে ঘুমানোর জন্য।
আজ শুক্রবার, ৭ নভেম্বর। বিকেলটা একটু ভারী ঘুমে কেটে যাচ্ছিল। বাইরে হালকা শীতের ছোঁয়া, দূরে মসজিদের মাইকে আজানের ধ্বনি। ঘুমের ভেতরে হঠাৎ অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখলাম—আমি যেন কর্নেল তাহেরের একটা চিঠি পড়ছি, হুমায়ূন আহমেদের ‘দেয়াল’ বইয়ের সেই চিঠি। ঘুমের মধ্যেই বুকটা কেমন করে উঠল, আর আমি কান্নায় ভেঙে পড়লাম।
চোখ খুলে দেখি সন্ধ্যা নেমে এসেছে। ঘরের জানালার ফাঁক দিয়ে কমলা আলো ঢুকছে, দূরে কোনো গলিতে বাজছে মাইক—‘আজ ৭ নভেম্বর, জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস উদ্যাপন করিতে সবাইকে আমন্ত্রণ জানাই।’ বাইরে কারও হাসির শব্দ ভেসে আসছে, কেউ কেউ পতাকা হাতে আনন্দ করছে। কিন্তু আমার বুকের ভেতরটা ভার হয়ে আছে এক অদ্ভুত বিষণ্নতায়।
হুমায়ূন আহমেদের ‘দেয়াল’ আর শাহাদুজ্জামানের ‘ক্রাচের কর্নেল’ পড়েছিলাম কয়েক বছর আগে। সেই বইয়ের পাতা থেকে একরাশ প্রশ্ন ঝরে পড়েছিল আমার ভেতরে—কেন কর্নেল তাহেরকে হত্যা করা হলো? কেন রাষ্ট্র তাঁর সেবার প্রতিদান দিল শিকল আর ফাঁসির দড়ি দিয়ে?
তাহের—যিনি মুক্তিযুদ্ধের সময় আঘাতপ্রাপ্ত পা নিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন, যিনি পরাজিত সেনাদের সম্মান দিয়েছেন, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অনুপস্থিত ছিলেন, তাঁদেরও ফিরিয়ে এনেছেন সম্মান ও দায়িত্বের ছায়ায়। অথচ সেই মানুষটিকেই এক রাতে রাষ্ট্রীয়ভাবে হত্যা করা হলো—অভিযোগ তোলার আগেই রায় লেখা হয়ে গিয়েছিল, শাস্তি ঘোষণার আগেই ফাঁসির মঞ্চ প্রস্তুত।
জানি, ৩৫ বছর পর সেই বিচার নিয়ে হাইকোর্টে রিট পিটিশন হয়েছিল। মহামান্য বিচারপতি শামসুদ্দীন চৌধুরীর রায়ে লেখা হয়েছিল, ‘তাহেরকে ঠান্ডা মাথায় হত্যা করা হয়েছে।’
রায়ে আরও বলা হয়েছিল, যদি জেনারেল জিয়াউর রহমান এখনো বেঁচে থাকতেন, তাহের হত্যার জন্য তাঁর বিচার হতো। কিন্তু বাংলাদেশের আইনে মৃত ব্যক্তির বিচার হয় না।
এসব ভাবতে ভাবতেই সন্ধ্যা আরও ঘন হয়ে এল। বাইরে থেকে ভেসে আসছে নামাজের পর মানুষের হাঁটার শব্দ, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের ধ্বনি। আমি জানালার পাশে বসে ভাবছিলাম, রাষ্ট্র কত সহজে ভুলে যায় নিজের সন্তানদের, যাদের রক্তে এই মানচিত্রের রেখা টানা। যতবার আমি ’৭৫–এর সিপাহি-জনতার বিপ্লব শুনব, আমি দেখতে পাব ক্রাচে ভর করা কর্নেল তাহেরের নিঃশঙ্কচিত্ত মুখ আর এক বিশ্বাসঘাতকের প্রহসন!
তাহেরের মৃত্যুর ৫০ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু তাঁর ভাবনা, তাঁর সেই বিদ্রোহী চেতনা যেন আজও ঘুরে বেড়ায় এই মাটির ভেতর—একটা অন্য রকম স্বপ্ন হয়ে।
আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললাম—
‘নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই।’
রবীন্দ্রনাথের এই পঙ্ক্তিটা আজ নতুন করে মনে পড়ছে।
যারা কর্নেল তাহেরকে হত্যা করেছে, তারা যদি ৫০ বছর পর বাহ্যিকভাবে তাহেরের মতাদর্শের মানুষদের সঙ্গে হাত মেলায়, আমি নিশ্চিত, তারা তাদের ব্যবহার করে ক্ষমতায় ফিরে এসে শেষমেষ তাদের নিঃশেষ করার চেষ্টা করবে।
বাইরে বাতাসে শুকনো পাতার শব্দ। শুক্রবারের এই শান্ত সন্ধ্যায় মনে হলো, ইতিহাস আসলে কখনো ঘুমায় না। মাঝেমধ্যে আমাদের ঘুমের ভেতরেই সে এসে ফিসফিস করে বলে—
‘তুমি কি সত্যিই জেগে আছ?’
লেখক: নুসরাত রুষা, শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
নাগরিক সংবাদে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]